সাময়িকী.কম
মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু ও তোহুর আহমদ
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও থানা যেন ‘সোনার খনি’- এমন মন্তব্য বিভিন্ন স্তরের পুলিশ সদস্যদের। এই থানায় ওসি (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে পোস্টিং পেতে মরিয়া থাকেন অধিকাংশ পুলিশ ইন্সপেক্টরই। এমনকি কোটি টাকা খরচ করতেও রাজি থাকেন কেউ-কেউ। তবে শুধু টাকা খরচ করলেই সন্ধান মিলে না এই ‘সোনার খনি’র। টাকার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে প্রমাণ করতে হয়, তিনি কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাসীনদের অতি ঘনিষ্ঠ। আর পুলিশ কর্মকর্তারাই বলেন, ‘মাত্র এক বছর তেজগাঁও থানায় ওসিগিরি করতে পারলে সারা জীবন বসে খাওয়া যায়। জীবনে আর টাকার চিন্তা করতে হয় না।’
যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ‘সোনার খনি’ সংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই তেজগাঁও থানার অবৈধ আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ কাঁচাবাজার কারওয়ান বাজার। সেখানে রয়েছে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত আবাসিক হোটেল, মাদক, ম্যাসাজ পার্লার, জুয়ার স্পট, ভেজাল মশলা ও ফরমালিনযুক্ত বরফ কারখানা, কারওয়ানবাজারের কাঁচাবাজার ও মাছের পাইকারি আড়ত থেকে প্রতি মাসে কমপক্ষে অর্ধকোটি টাকা পুলিশের নামে তোলা হয়। এই চাঁদা তোলে পুলিশের অলিখিত নিয়োগপ্রাপ্ত শতাধিক চাঁদা আদায়কারী। যারা পুলিশ ও চাঁদা দাতাদের কাছে ‘লাইনম্যান’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। এইসব চাঁদা দৈনিক অথবা সাপ্তাহিক বা মাসিক ভিত্তিতে তোলা হয়।
কিভাবে পুলিশের লাইনম্যানরা এই টাকা তোলে তার চিত্র দেখতে বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত কারওয়ানবাজার এলাকায় সরেজমিন অবস্থান করেন যুগান্তরের দুই প্রতিবেদক। সেখানে দেখা যায়, কারওয়ানবাজারসহ আশপাশের সড়কজুড়ে কাঁচা মালের পসরা। কারওয়ানবাজারের ভেতর শুধু ট্রাকের জট, হেঁটে চলার অবস্থা নেই। সিএ ভবন এবং জনতা টাওয়ারের গলি দিয়ে একের পর এক ঢুকছে সবজিভর্তি ট্রাক। প্রবেশমুখেই পুলিশের লাইনম্যানরা বড় ট্রাক প্রতি ৭০০ এবং মিনি ট্রাক প্রতি ৩০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করছে। প্রকাশ্যেই এই চাঁদাবাজি চলছে। চাঁদা দিতে রাজি না হলে ট্রাক ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তেজগাঁও থানা এলাকায় অনেকগুলো অনৈতিক ম্যাসাজ পার্লার চলে। এসব ম্যাসাজ পার্লার থেকে দৈনিক ৫ হাজার টাকা চাঁদা নেয় পুলিশ। সরেজমিন দেখা যায়, ৬০ পূর্ব তেঁজতুরি বাজারের রহমান ম্যানশনের দোতলায় ৬টি ম্যাসাজ পার্লার চলছে। এসব ম্যাসাজ পার্লার চালায় পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী নূর ইসলাম। এসব ম্যাসাজ পার্লার থেকে থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবিও চাঁদা নেয়।
আরও জানা গেছে, কারওয়ানবাজার রেল লাইন ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই নির্বিঘেœ চলছে জমজমাট মাদক ব্যবসা। মাদক ব্যবসায়ী খুদি, জলিলের বউ, নূরুর বউয়ের তত্ত্বাবধানে চলছে এই অবৈধ ব্যবসা। আগে এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত মাদক সম্রাজ্ঞী মনোয়ারা ও জনৈক ভাণ্ডারির মেয়ে। এই মাদক আখড়া থেকে তেজগাঁও থানার নামে প্রতি মাসে ১৫ লাখ টাকা চাঁদা ওঠে। এছাড়া কারওয়ানবাজার মাছবাজারেও পুলিশের নামে চাঁদাবাজি হয়। মাছ বাজার থেকে দৈনিক ২০ হাজার টাকা চাঁদা তুলে থানায় দিয়ে আসে পুলিশের সোর্স বাবু। এখানে পুলিশের নামে চাঁদাবাজি করে থানার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী নূরু, বাবুল ওরফে সিলেটি বাবুল, পাঁচতারা মৎস্য আড়তের সভাপতি কামাল ও মোশাররফ ওরফে সর্দার মোশাররফ। জানা গেছে, মাছ বহনকারী প্রতিটি ট্রাক থেকে দৈনিক ৫০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। সূত্র জানায়, আগে তেজগাঁও থানার ক্যাশিয়ার ছিলেন এসআই আসাদ। তিনি চাঁদার হিসাব রাখতেন। তেজগাঁও থানার এক এসআই যুগান্তরকে বলেন, ওসিসহ অন্য কর্মকর্তাদের চাঁদা পরিশোধ করে মাসে এসআই আসাদ ১৬ লাখ টাকারও বেশি আয় করতেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, কারওয়ানবাজারে ১০-১৫টি আবাসিক হোটেলে পতিতাবৃত্তি চলে। প্রতি হোটেল থেকে গড়ে ১০ হাজার টাকা করে পুলিশকে মাসিক চাঁদা দেয়া হয়। বিগত মহাজোট সরকারের এক মন্ত্রীর ভাগ্নে জনৈক আরমান তেজগাঁওয়ে একাধিক জুয়ার আড্ডা নিয়ন্ত্রণ করেন। এর মধ্যে কারওয়ানবাজারের ৩/বি এসি ভবনের পঞ্চম তলায় জুয়ার আড্ডা চলছে পুলিশের শেল্টারে। এই জুয়ার আড্ডার নিয়ন্ত্রক পুলিশ ও র্যাবের তালিকাভুক্ত আসামি মোশাররফ ওরফে সর্দার মোশাররফ। মোশাররফের জুয়ার বোর্ড থেকে তেজগাঁও থানায় চাঁদা যায় মাসিক ৩০ হাজার টাকা। জানা গেছে, মোশাররফ বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন। ৬ মাস জেল খেটে বেরিয়ে আবারও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এখন পাঁচতারা মৎস্য আড়তেরও সাধারণ সম্পাদক। এখানে ৫০০ মাছের গদি আছে। একেকটি গদি থেকে প্রতিদিন গড়ে ২০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। এছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা মাছের ভেতরে আসে ফেনসিডিল। এই ফেনসিডিল পাচার চক্রের কাছ থেকেও তেজগাঁও থানার নামে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করেন মোশাররফ। সূত্র জানিয়েছে, এই ফেনসিডিল চক্রের হোতা জনৈক রাজা মোল্লা। এছাড়া কারওয়ানবাজারের জসিম মৎস্য আড়তও মোশাররফের দখলে। এই আড়তে মাছের গদি আছে ৭১টি। এই মার্কেটের মাছ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দৈনিক ২৭৫ টাকা করে গদি ভাড়া আদায় করা হয়। এর একটি বড় অংশ যায় তেজগাঁও থানায়।
চাঁদাবাজির বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে মোশাররফ ওরফে সর্দার মোশাররফ জুয়ার আড্ডা চালানোর অভিযোগ স্বীকার করে সোমবার যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন ক্লাবে জুয়া চলে। তিনিও একটি ক্লাবের মাধ্যমে জুয়ার বোর্ড চালান। এই জুয়া থেকেই ক্লাবের প্রধান আয় হয়। তবে মাৎস্য আড়তে চাঁদাবাজির অভিযোগ সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন তিনি।
সূত্রমতে তেজগাঁওয়ে বেশ কয়েকটি মদের বার আছে। এসব মদের বারে অবৈধভাবে বিদেশী মদ বেচাকেনা হয়। এ কারণে এসব মদের বার থেকেও পুলিশ চাঁদা আদায় করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তেজগাঁও থানার এক এসআই যুগান্তরকে বলেন, এ এলাকার দুটি মদের বার রেড বাটন ও সালামার থেকে প্রতি মাসে থানার ওসির নামে চাঁদা ওঠে ৩০ হাজার টাকা। হোটেল পারভেজের পেছনে আছে বাংলা মদের কারখানা। এই কারখানা থেকে তেজগাঁও থানার নামে মাসিক ৩০ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়।
কারওয়ানবাজারের বিশাল জায়গাজুড়ে ফুটপাতে হকাররা ব্যবসা করেন। জানা গেছে, এই ফুটপাতের নিয়ন্ত্রণকারী যুবলীগের কথিত নেতা লোকমান ও মনির মিরাজী। তাদের অধীনে ৫০-৬০ জন লাইনম্যান ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায় করে। পান্থপথ থেকে সোনারগাঁও পর্যন্ত ফুটপাতের চাঁদা তোলে পুলিশের লাইনম্যান মিলন। চাঁদা তুলে তেজগাঁও থানায় দেয়া হয় সপ্তাহে ২ হাজার টাকা। অবৈধ যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট বিক্রির জন্য সোনারগাঁও থেকে মসজিদ গলি পর্যন্ত সপ্তাহে ১ হাজার টাকা এবং মসজিদ গলি থেকে জনতা টাওয়ার পর্যন্ত এক হাজার টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। এরপর চাঁদা ভাগবাটোয়ারা হয় পুলিশের সঙ্গে। ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনির ওরফে পাঠা মনির পুলিশের হয়ে ভ্যান গাড়ি থেকে চাঁদা তোলে। প্রতি ভ্যান থেকে প্রতিদিন ২০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। সূত্র জানায়, কারওয়ানবাজারে ভ্যানগাড়ি চলাচল করে অন্তত ১ হাজার। ট্রাক থেকে সবজি নামানোর জন্য এসব ভ্যানগাড়িকে সিরিয়াল পাওয়ার নামে চাঁদা দিতে হয়। তা না হলে ট্রাকে ভ্যানগাড়ি ভেড়াতে দেয়া হয় না। বিএনপি নেতা নবী সোলায়মান ২ নম্বর ডিআইটি মার্কেটের পেছনে পার্কিংয়ের জায়গা দখল করে ৩০০ দোকানঘর নির্মাণ করেছেন। প্রতি দোকানের পজেশন বিক্রি করা হয়েছে ১০ লাখ টাকা করে। পুলিশ ও নবী সোলায়মান মিলে এই মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করে।
সূত্র জানায়, কাওরান বাজার মুরগি আড়ত থেকেও প্রতি সপ্তাহে ২ হাজার টাকা তোলা হয়। জানা গেছে, মুরগি বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীরা ওজন বাড়ানোর জন্য মুরগিকে পাথর খাওয়ায়। এ কারণে পুলিশ তাদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়। কারওয়ানবাজারে ভেজাল শুঁটকি বিক্রি করা হয়। এজন্য শুঁটকিপট্টির ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পুলিশ চাঁদা নেয়। সপ্তাহ ১ হাজার টাকা করে শুঁটকিপট্টি থেকে চাঁদা তোলে পুলিশের লাইনম্যান রহিম। কারওয়ানবাজারে ভেজাল মশলা ভাঙানোর দুটি মিল আছে। ভেজাল মশলা ভাঙানোর মিল থেকে মাসে ৩০ হাজার টাকা তোলা হয়। পুলিশের হয়ে এ টাকা নিয়ে আসে থানার সোর্স কাদের।
লাইনম্যান যারা : পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের লাইনম্যান হিসেবে তেজগাঁও এলাকায় যারা চাঁদা আদায় করেন, তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছেন, কালো রাজ্জাক ওরফে ভোলাইয়া রাজ্জাক, সুরুজ ওরফে ভাইগনা সুরুজ, সোহেল, জামাল খাঁ, লিটন, শহীদুল, নিপু, জিলু, মিন্টু, শহীদুল, আনিস ও উজ্জল। এছাড়া পুলিশের নামে চাঁদাবাজি করে লোকমান, মনির, আকবর, পারভেজ, আলমগীর, নজরুল, ফজলু চেয়ারম্যান, মফিজ, ফরহাদ, ফয়সাল ও লম্বা সেলিম, আনোয়ার, জামাল খাঁ, আবুল খায়ের, জহিরুল হক জিলু, আলমগীর, নজরুল, লম্বু শরীফ, রকি, রাজু, দেলু সরদার, হাতকাটা কাশেম, মকবুল, বাচ্চু, মোবারক, টাওয়ার বাবুল ও ঘাড়বাঁকা বাদশা।
ওসির অস্বীকার : চাঁদা আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে তেজগাঁও থানার ওসি মাজাহারুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, তিনি কারও কাছ থেকে চাঁদা নেন না। থানার নামেও চাঁদার টাকা ওঠে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তেজগাঁও এলাকার সব অনিয়ম, চাঁদাবাজি তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। এ কারণে হয়তো ক্ষুব্ধ হয়ে কেউ তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। সূত্র: দৈনিক যুগান্তর
মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু ও তোহুর আহমদ
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও থানা যেন ‘সোনার খনি’- এমন মন্তব্য বিভিন্ন স্তরের পুলিশ সদস্যদের। এই থানায় ওসি (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে পোস্টিং পেতে মরিয়া থাকেন অধিকাংশ পুলিশ ইন্সপেক্টরই। এমনকি কোটি টাকা খরচ করতেও রাজি থাকেন কেউ-কেউ। তবে শুধু টাকা খরচ করলেই সন্ধান মিলে না এই ‘সোনার খনি’র। টাকার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে প্রমাণ করতে হয়, তিনি কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাসীনদের অতি ঘনিষ্ঠ। আর পুলিশ কর্মকর্তারাই বলেন, ‘মাত্র এক বছর তেজগাঁও থানায় ওসিগিরি করতে পারলে সারা জীবন বসে খাওয়া যায়। জীবনে আর টাকার চিন্তা করতে হয় না।’
যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ‘সোনার খনি’ সংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই তেজগাঁও থানার অবৈধ আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ কাঁচাবাজার কারওয়ান বাজার। সেখানে রয়েছে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত আবাসিক হোটেল, মাদক, ম্যাসাজ পার্লার, জুয়ার স্পট, ভেজাল মশলা ও ফরমালিনযুক্ত বরফ কারখানা, কারওয়ানবাজারের কাঁচাবাজার ও মাছের পাইকারি আড়ত থেকে প্রতি মাসে কমপক্ষে অর্ধকোটি টাকা পুলিশের নামে তোলা হয়। এই চাঁদা তোলে পুলিশের অলিখিত নিয়োগপ্রাপ্ত শতাধিক চাঁদা আদায়কারী। যারা পুলিশ ও চাঁদা দাতাদের কাছে ‘লাইনম্যান’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। এইসব চাঁদা দৈনিক অথবা সাপ্তাহিক বা মাসিক ভিত্তিতে তোলা হয়।
কিভাবে পুলিশের লাইনম্যানরা এই টাকা তোলে তার চিত্র দেখতে বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত কারওয়ানবাজার এলাকায় সরেজমিন অবস্থান করেন যুগান্তরের দুই প্রতিবেদক। সেখানে দেখা যায়, কারওয়ানবাজারসহ আশপাশের সড়কজুড়ে কাঁচা মালের পসরা। কারওয়ানবাজারের ভেতর শুধু ট্রাকের জট, হেঁটে চলার অবস্থা নেই। সিএ ভবন এবং জনতা টাওয়ারের গলি দিয়ে একের পর এক ঢুকছে সবজিভর্তি ট্রাক। প্রবেশমুখেই পুলিশের লাইনম্যানরা বড় ট্রাক প্রতি ৭০০ এবং মিনি ট্রাক প্রতি ৩০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করছে। প্রকাশ্যেই এই চাঁদাবাজি চলছে। চাঁদা দিতে রাজি না হলে ট্রাক ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তেজগাঁও থানা এলাকায় অনেকগুলো অনৈতিক ম্যাসাজ পার্লার চলে। এসব ম্যাসাজ পার্লার থেকে দৈনিক ৫ হাজার টাকা চাঁদা নেয় পুলিশ। সরেজমিন দেখা যায়, ৬০ পূর্ব তেঁজতুরি বাজারের রহমান ম্যানশনের দোতলায় ৬টি ম্যাসাজ পার্লার চলছে। এসব ম্যাসাজ পার্লার চালায় পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী নূর ইসলাম। এসব ম্যাসাজ পার্লার থেকে থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবিও চাঁদা নেয়।
আরও জানা গেছে, কারওয়ানবাজার রেল লাইন ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই নির্বিঘেœ চলছে জমজমাট মাদক ব্যবসা। মাদক ব্যবসায়ী খুদি, জলিলের বউ, নূরুর বউয়ের তত্ত্বাবধানে চলছে এই অবৈধ ব্যবসা। আগে এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত মাদক সম্রাজ্ঞী মনোয়ারা ও জনৈক ভাণ্ডারির মেয়ে। এই মাদক আখড়া থেকে তেজগাঁও থানার নামে প্রতি মাসে ১৫ লাখ টাকা চাঁদা ওঠে। এছাড়া কারওয়ানবাজার মাছবাজারেও পুলিশের নামে চাঁদাবাজি হয়। মাছ বাজার থেকে দৈনিক ২০ হাজার টাকা চাঁদা তুলে থানায় দিয়ে আসে পুলিশের সোর্স বাবু। এখানে পুলিশের নামে চাঁদাবাজি করে থানার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী নূরু, বাবুল ওরফে সিলেটি বাবুল, পাঁচতারা মৎস্য আড়তের সভাপতি কামাল ও মোশাররফ ওরফে সর্দার মোশাররফ। জানা গেছে, মাছ বহনকারী প্রতিটি ট্রাক থেকে দৈনিক ৫০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। সূত্র জানায়, আগে তেজগাঁও থানার ক্যাশিয়ার ছিলেন এসআই আসাদ। তিনি চাঁদার হিসাব রাখতেন। তেজগাঁও থানার এক এসআই যুগান্তরকে বলেন, ওসিসহ অন্য কর্মকর্তাদের চাঁদা পরিশোধ করে মাসে এসআই আসাদ ১৬ লাখ টাকারও বেশি আয় করতেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, কারওয়ানবাজারে ১০-১৫টি আবাসিক হোটেলে পতিতাবৃত্তি চলে। প্রতি হোটেল থেকে গড়ে ১০ হাজার টাকা করে পুলিশকে মাসিক চাঁদা দেয়া হয়। বিগত মহাজোট সরকারের এক মন্ত্রীর ভাগ্নে জনৈক আরমান তেজগাঁওয়ে একাধিক জুয়ার আড্ডা নিয়ন্ত্রণ করেন। এর মধ্যে কারওয়ানবাজারের ৩/বি এসি ভবনের পঞ্চম তলায় জুয়ার আড্ডা চলছে পুলিশের শেল্টারে। এই জুয়ার আড্ডার নিয়ন্ত্রক পুলিশ ও র্যাবের তালিকাভুক্ত আসামি মোশাররফ ওরফে সর্দার মোশাররফ। মোশাররফের জুয়ার বোর্ড থেকে তেজগাঁও থানায় চাঁদা যায় মাসিক ৩০ হাজার টাকা। জানা গেছে, মোশাররফ বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন। ৬ মাস জেল খেটে বেরিয়ে আবারও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এখন পাঁচতারা মৎস্য আড়তেরও সাধারণ সম্পাদক। এখানে ৫০০ মাছের গদি আছে। একেকটি গদি থেকে প্রতিদিন গড়ে ২০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। এছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা মাছের ভেতরে আসে ফেনসিডিল। এই ফেনসিডিল পাচার চক্রের কাছ থেকেও তেজগাঁও থানার নামে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করেন মোশাররফ। সূত্র জানিয়েছে, এই ফেনসিডিল চক্রের হোতা জনৈক রাজা মোল্লা। এছাড়া কারওয়ানবাজারের জসিম মৎস্য আড়তও মোশাররফের দখলে। এই আড়তে মাছের গদি আছে ৭১টি। এই মার্কেটের মাছ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দৈনিক ২৭৫ টাকা করে গদি ভাড়া আদায় করা হয়। এর একটি বড় অংশ যায় তেজগাঁও থানায়।
চাঁদাবাজির বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে মোশাররফ ওরফে সর্দার মোশাররফ জুয়ার আড্ডা চালানোর অভিযোগ স্বীকার করে সোমবার যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন ক্লাবে জুয়া চলে। তিনিও একটি ক্লাবের মাধ্যমে জুয়ার বোর্ড চালান। এই জুয়া থেকেই ক্লাবের প্রধান আয় হয়। তবে মাৎস্য আড়তে চাঁদাবাজির অভিযোগ সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন তিনি।
সূত্রমতে তেজগাঁওয়ে বেশ কয়েকটি মদের বার আছে। এসব মদের বারে অবৈধভাবে বিদেশী মদ বেচাকেনা হয়। এ কারণে এসব মদের বার থেকেও পুলিশ চাঁদা আদায় করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তেজগাঁও থানার এক এসআই যুগান্তরকে বলেন, এ এলাকার দুটি মদের বার রেড বাটন ও সালামার থেকে প্রতি মাসে থানার ওসির নামে চাঁদা ওঠে ৩০ হাজার টাকা। হোটেল পারভেজের পেছনে আছে বাংলা মদের কারখানা। এই কারখানা থেকে তেজগাঁও থানার নামে মাসিক ৩০ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়।
কারওয়ানবাজারের বিশাল জায়গাজুড়ে ফুটপাতে হকাররা ব্যবসা করেন। জানা গেছে, এই ফুটপাতের নিয়ন্ত্রণকারী যুবলীগের কথিত নেতা লোকমান ও মনির মিরাজী। তাদের অধীনে ৫০-৬০ জন লাইনম্যান ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায় করে। পান্থপথ থেকে সোনারগাঁও পর্যন্ত ফুটপাতের চাঁদা তোলে পুলিশের লাইনম্যান মিলন। চাঁদা তুলে তেজগাঁও থানায় দেয়া হয় সপ্তাহে ২ হাজার টাকা। অবৈধ যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট বিক্রির জন্য সোনারগাঁও থেকে মসজিদ গলি পর্যন্ত সপ্তাহে ১ হাজার টাকা এবং মসজিদ গলি থেকে জনতা টাওয়ার পর্যন্ত এক হাজার টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। এরপর চাঁদা ভাগবাটোয়ারা হয় পুলিশের সঙ্গে। ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনির ওরফে পাঠা মনির পুলিশের হয়ে ভ্যান গাড়ি থেকে চাঁদা তোলে। প্রতি ভ্যান থেকে প্রতিদিন ২০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। সূত্র জানায়, কারওয়ানবাজারে ভ্যানগাড়ি চলাচল করে অন্তত ১ হাজার। ট্রাক থেকে সবজি নামানোর জন্য এসব ভ্যানগাড়িকে সিরিয়াল পাওয়ার নামে চাঁদা দিতে হয়। তা না হলে ট্রাকে ভ্যানগাড়ি ভেড়াতে দেয়া হয় না। বিএনপি নেতা নবী সোলায়মান ২ নম্বর ডিআইটি মার্কেটের পেছনে পার্কিংয়ের জায়গা দখল করে ৩০০ দোকানঘর নির্মাণ করেছেন। প্রতি দোকানের পজেশন বিক্রি করা হয়েছে ১০ লাখ টাকা করে। পুলিশ ও নবী সোলায়মান মিলে এই মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করে।
সূত্র জানায়, কাওরান বাজার মুরগি আড়ত থেকেও প্রতি সপ্তাহে ২ হাজার টাকা তোলা হয়। জানা গেছে, মুরগি বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীরা ওজন বাড়ানোর জন্য মুরগিকে পাথর খাওয়ায়। এ কারণে পুলিশ তাদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়। কারওয়ানবাজারে ভেজাল শুঁটকি বিক্রি করা হয়। এজন্য শুঁটকিপট্টির ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পুলিশ চাঁদা নেয়। সপ্তাহ ১ হাজার টাকা করে শুঁটকিপট্টি থেকে চাঁদা তোলে পুলিশের লাইনম্যান রহিম। কারওয়ানবাজারে ভেজাল মশলা ভাঙানোর দুটি মিল আছে। ভেজাল মশলা ভাঙানোর মিল থেকে মাসে ৩০ হাজার টাকা তোলা হয়। পুলিশের হয়ে এ টাকা নিয়ে আসে থানার সোর্স কাদের।
লাইনম্যান যারা : পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের লাইনম্যান হিসেবে তেজগাঁও এলাকায় যারা চাঁদা আদায় করেন, তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছেন, কালো রাজ্জাক ওরফে ভোলাইয়া রাজ্জাক, সুরুজ ওরফে ভাইগনা সুরুজ, সোহেল, জামাল খাঁ, লিটন, শহীদুল, নিপু, জিলু, মিন্টু, শহীদুল, আনিস ও উজ্জল। এছাড়া পুলিশের নামে চাঁদাবাজি করে লোকমান, মনির, আকবর, পারভেজ, আলমগীর, নজরুল, ফজলু চেয়ারম্যান, মফিজ, ফরহাদ, ফয়সাল ও লম্বা সেলিম, আনোয়ার, জামাল খাঁ, আবুল খায়ের, জহিরুল হক জিলু, আলমগীর, নজরুল, লম্বু শরীফ, রকি, রাজু, দেলু সরদার, হাতকাটা কাশেম, মকবুল, বাচ্চু, মোবারক, টাওয়ার বাবুল ও ঘাড়বাঁকা বাদশা।
ওসির অস্বীকার : চাঁদা আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে তেজগাঁও থানার ওসি মাজাহারুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, তিনি কারও কাছ থেকে চাঁদা নেন না। থানার নামেও চাঁদার টাকা ওঠে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তেজগাঁও এলাকার সব অনিয়ম, চাঁদাবাজি তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। এ কারণে হয়তো ক্ষুব্ধ হয়ে কেউ তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। সূত্র: দৈনিক যুগান্তর