তানভীর আশিক
সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। তখন গ্রিসের থিবেস রাজ্যের রাজা ছিলেন লেয়াস আর তার রানী জোকাস্টা। প্রজাদের নিয়ে রাজ্যে তারা সুখে-শান্তিতেই বসবাস করছিলেন। কিন্তু তাদের মনে একটাই দুঃখ - তাদের কোন সন্তান-সন্ততি নাই। সন্তান প্রাপ্তির জন্য রাজা-রানী এমন কিছু নাই যা করেননি, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। একদিন রাজার কাছে মন্ত্রী এসে জানালো, রাজ্যের বাইরে এক পুরনো মন্দির আছে, সেখানে আছে এক সাধক। তার আর্শীবাদ নিলে নাকি মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয়। রাজা ছুটলেন রানীকে নিয়ে। সাধকের কাছে মিনতি করলেন রানী, ‘আমার সব আছে, কিন্তু ব্যর্থ মনে হয় এই জীবন-এই বেঁচে থাকা, যখন মনে হয় আমি নিষ্ফলা।’ রাজা বললেন, ‘একটা সন্তান থাকলে আমার সুনাম বাড়তো। প্রজাদের কাছে গুছতো আঁটকুড়ে র্দুনাম। পুত্র হলে হতো আমার উত্তরাধিকার।’ সব শুনে সাধক বললেন, ‘বাছা, সন্তান কেবল সুনামের কারণ হয় না, সুনাম নষ্টও করে সন্তান....’ সাধকের কথা শেষ হওয়ার আগেই রানী বললো, ‘না, না, বাবা, আমি আমার সন্তানকে সু-সন্তান হিসেবেই গড়ে তুলবো। আপনি যে কোন কিছুর বিনিময়ে আমাকে একটা সন্তান দেন।’ চোখ বন্ধ করে মৃদু হাসলো সাধক, বললেন, ‘ফিরে যা’। ফিরে এলো রাজা-রানী। কিছুদিন পরই গর্ভবতী হলেন রানী। জন্ম দিলেন এক পুত্র সন্তানের। দাসী এসে জানালো রাজাকে সু-সংবাদ, ‘মহারাজ, আপনি পুত্র সন্তানের পিতা হয়েছেন।’ রাজাতো মহাখুশি। কিন্তু সাথে সাথে এক দৈববাণী এলো রাজার কাছে, ‘ওহে গর্দভ! শুনলিনাতো সাধুর কথা সবটা! এই পুত্রই তোকে হত্যা করবে আর তোর রানীকে বানাবে নিজের রানী।’ রাজা শুনে ক্ষেপে উঠলেন। দরকার নাই এমন পুত্রের! তিনি জোকাস্টার কোল থেকে কেড়ে নিলেন শিশু সন্তানকে। তারপর তুলে দিলেন জল্লাদের হাতে, ‘নিয়ে যাও ওকে। পাহাড়ে নিয়ে হত্যা করে ফেলে দাও পাহাড়ের ওপাশে।’ জল্লাদ নিয়ে গেলো শিশুকে। পাহাড়ে চড়ে যখনি হত্যা করতে যাবে শিশুটাকে তখনি ফিক করে হেসে উঠলো শিশুটা আর জল্লাদের গোঁফ ধরে খেলতে চায়লো। মায়া লেগে গেলো জল্লাদের। আহা! কী নিষ্পাপ শিশু! কিন্তু রাজার আদেশ না মানলে তো তাকেই কতল করে দিবে। সে তখন শিশুটিকে না মেরে গড়িয়ে দিলো পাহাড়ের ঢালে। ‘জীবন থাকলে বেঁচে থাক, মরণ থাকলে আমার আর কি করার আছে!’ জল্লাদ ভাবলো মনে মনে। তারপর ফিরে গেলো।
পাহাড়ের ওপাশের রাজ্যের নাম করিন্থ। পাহাড়ের পাদদেশে মেষ চড়াতে এসেছিলো এক মেষপালক। হঠাৎ শুনে শিশুর কান্না। গিয়ে দেখে কাপড়ে জড়ানো এক শিশু। কোলে নিয়ে দেখে শিশুর পায়ে আঘাত লেগে ফুলে আছে পা’দুটি। মেষপালক শিশুটির নাম রাখলো অডিপাস। ‘অডিপাস’ শব্দের অর্থ ফুলে যাওয়া পা। যাইহোক, মেষপালক শিশুটিকে নিয়ে গেলো করিন্থের রাজার কাছে। করিন্থের রাজা ছিলো পলিবাস। আর তার রানী মেরোপীর। তাদেরও ছিলো না কোন সন্তান। অডিপাসকেই নিজের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করলেন। ভাবলেন ঈশ্বর তাদের আর্জি শুনেছেন, তাই এমন ফুটফুটে একটা সন্তান পাঠিয়েছেন।
রাজা পলিবাসকে বাবা আর রানী মেরোপীরকে মা জেনেই বড় হয়ে উঠলো অডিপাস। যুবক অডিপাসের শরীরে প্রচুর বল, মাথায় তীক্ষ্ম বুদ্ধি। একদিন হলো কি এক মাতাল বন্ধু অডিপাসকে বলে বসলো, ‘অডিপাস তোমাকে দেখতে তো তোমার বাবা-মা কারো মতো লাগে না। তোমার গায়ের আকারও তাদের মতো না। সত্যি করে বলতো, তোমার বাবা-মা কে?’
অডিপাসের মাথায় ঢুকে গেলো বিষয়টা। গিয়ে জানতে চায়লো মায়ের কাছে। প্রথমে মা বলতে রাজী না হলেও, পরে ভাবলো সত্য বলা উচিত। জানানো হলো অডিপাসকে সমস্ত কিছু। তাকে আসলে পাওয়া গেছে পাহাড়ের পাদদেশে। ‘আমার কোন জন্ম পরিচয় নাই!’ ভাবলো সে। মনের দুঃখে অডিপাস রাজ্য ত্যাগ করলো। ঘুরতে থাকলো বন-পাহাড়-পর্বতে, ছুটতে থাকলো রাজ্য থেকে রাজ্যে।
চলেতে চলতে এক সংকীর্ণ পাহাড়ি পথের প্রবেশ মুখে এসে দেখে এক বৃদ্ধ রথে বসে আছে। তার রথ সমস্ত পথ দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। অডিপাস বৃদ্ধকে বললো রথ সরাতে কিন্তু বৃদ্ধ রথ সরাতে রাজী নয়। ক্ষেপে গিয়ে ঝগড়া লাগিয়ে দিলো অডিপাস। বৃদ্ধ তাকে শাসালো, ‘জানিস আমি কে!’ রক্ত উঠে গেলো অডিপাসের মাথায়। সরোষে এক ঘুষি মেরে বসলো বৃদ্ধকে, ‘জানার দরকার নেই তুই কোথাকার কোন বুড়ো!’ এক ঘুষির আঘাতেই বৃদ্ধ মৃত্যুবরণ করলে রথসহ বৃদ্ধকে ছুঁড়ে ফেললো। তারপর সেই পথ ধরেই এগুতে থাকলো। কিন্তু অডিপাস জানলো না, এ বৃদ্ধই তার পিতা রাজা লেয়াস। আর সে এগিয়ে যাচ্ছে তার জন্মভূমি থিবেসের দিকে।
আসল ঘটনা হলো থিবেসে তখন এক অদ্ভুত প্রাণী এসেছে যার মাথা ও স্তন রূপসী মেয়ের মতো, আছে পাখির মতো ডানাও আর শরীরটা সিংহের। ‘স্ফিংক্স’ বলা হয় এ দানবীকে। সে থিবেসের প্রধান ফটকে বসে থেকে লোকদের প্রতিদিন ডেকে ডেকে নিতো তারপর জিজ্ঞেস করতো একটা ধাঁধা। উত্তর দিতে না পারলে মেরে খেয়ে ফেলতো সেই রাক্ষসী। থিবেসের লোকেরা অতিষ্ট এর যন্ত্রণায়। এর মাঝে সেদিন ডাক পড়লো রাজার। সেই ভয়ে রাজা পালিয়ে যাচ্ছিলো। আর পথে দেখা হলো অডিপাসের সাথে, তারপর ঝগড়া, অডিপাসের আঘাতে রাজার মৃত্যু। এই হলো ঘটনা।
যাইহোক, অডিপাস থিবেসের প্রধান ফটকে এসে পৌঁছালে মুখোমুখি হলো ‘স্ফিংক্স’ এর। লোকজন আড়াল থেকে দেখছিলো। স্ফিংক্স জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই একটা ধাঁধার উত্তর দিতে পারবি? না পারলে আমি কিন্তু তোকে খেয়ে ফেলবো।’ অডিপাস জানতে চায়লো, ‘কিসের ধাঁধা?’ স্ফিংক্স ধাঁধা ধরলো, ‘একটা প্রাণী সকালে চারপায়ে হাঁটে, দুপুরে দুই পায়ে হাঁটে আর বিকালে তিনপায়ে, বলতো প্রাণীটার নাম?’ অডিপাস হেসে উত্তর দিলো, ‘ওরে গাধা! এটাতো মানুষ। মানুষ শৈশবে হামাগুড়ি দেয়, অর্থাৎ সকালে চারপায়ে হাঁটে, যৌবন মানে দুপুরে দুই পায়ে হাঁটে আর শেষ বয়সে লাঠি সহ তিন পা হয়।’
সঠিক উত্তর দিয়ে ফেলায় আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো স্ফিংক্স। প্রজারা দেখলো অদ্ভুত জাদুতে স্ফিংক্সকে পুড়িয়ে মারলো একটা যুবক। তারা এসে জড়িয়ে ধরলো যুবককে। নিয়ে গেলো রাজ্যের রাজপ্রাসাদে। সেখানে রাজা নাই। তারা ভেবেছে রাজাকে স্ফিংক্স মেরে ফেলেছে। তখন তারা অডিপাসকেই রাজা বানিয়ে নিয়মানুসারে বিধবা রানীর সাথে বিয়ে দিলো মহাসমারোহে।
দৈববাণীই পুরোপুরি সত্য হলো।
মা-ছেলে পরস্পরকে চেনে না। তাদের দাম্পত্য জীবন যাপনের ফলে দুই পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়। ভালোই কাটছিলো তাদের দিন। কিন্তু কিছুকাল পরেই থিবেসে এক ভয়াবহ মহামারি দেখা দেয়। মহামারিতে শয়ে শয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। লোকজনের কথায় রাজা অডিপাস ছুটে যায় সেই মন্দিরে। দৈববাণী শোনা যায় আবার, 'থিবেসে আছে এমন একজন যে তার পিতাকে হত্যা করেছে আর মাকে বিয়ে করে অভিশপ্ত করেছে এই রাজ্যকে। সে যতদিন এই রাজ্য ত্যাগ না করবে ততদিন মহামারি বন্ধ হবে না। কাটবে না এই ঘোরসংকট।'
তারপর রাজা অডিপাস খুঁজে বের করে দেখে, সেই সে অভিশপ্ত লোক। সমস্ত রহস্য উদঘাটনের পর অডিপাস নিজের চোখ তুলে ফেলে, থিবেস রাজ্যের সিংহাসন ছেড়ে চলে যায় দূর বনবাসে। আর রানী জোকাস্টা দুঃখে ও লজ্জায় আত্মহত্যা করে।
বিভাগ:

Author Name

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.