অ
নিলয় জিন্দাবাজার
থেকে তার বাসায় এসেছে মাত্র। চোখে মুখে তার কেমন হতাশার ভাব। আকাশ মোটেই অন্ধকারাচ্ছন্ন
নয় কিন্তু তারই রূপক প্রতিচ্ছায়া যেন তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। কোন অজ্ঞাত বেদনার
কষাঘাতে হয়ত সে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছে। মনের সব খবরই ঘটা করে বলা যায় না,কিন্তু
মুখের বাহ্যিক অবয়বে অনেকটাই অনুমান করা যায়। মানুষের মুখই হচ্ছে তার মনের প্রতিচ্ছবি।
জিন্স প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে কারও সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু সংযোগ
পায় না। পুনরায় চেষ্টা করে। করতেই থাকে। এক সময় তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে- ধ্যাৎ! বিরক্তির
চিহ্ন তার চোখে মুখে ভেসে ওঠে। মানুষের মনটা এমনই যে আকাশের মত ক্ষণ পর পরই তার স্বরূপ
বদলে যায়। নিলয় মোবাইল পকেটে ভরে রাখে। জানালার পর্দা সংকোচন করে দূর দিগন্তে তাকায়।
দূর বহু দূর,দিগন্তের সীমারেখায়। অধিকাংশ মানুষই বিষণ্ন মন নিয়ে জানালা দিয়ে দূর দিগন্তের
পানে তাকায়। হয়ত আকাশ নীলিমার বিশালতার সাথে সৈরাচারী মন নিজেকে আবিষ্কার করে চলে নতুন
ভাবে।
হঠাৎ দরজার বাহিরে পায়ের ঈষৎ আওয়াজ পাওয়া যায়। বুয়া হয়ত এসেছে। এ আওয়াজ তার কাছে অপরিচিত নয়। কিন্তু অন্য সব দিনের মত গলা কেশে রান্না ঘরে ঢুকে নি। নাই বা ঢুকলো ! এসব নিয়ে তার বিন্দুমাত্রও মাথাব্যথা নেই। কম্পিউটার চালু করে গান শুনার চেষ্টা করে। গানের রাজ্যে মন ভাসিয়ে দেয়। তার চোখ বুজে আসে। হাত পাও দুর্বল হয়ে আসে। সারা দিন বেশ একটা ধকল গেছে। যদিও এই সময়ে অন্যকোন দিনই সে বাসায় থাকে না।
বাহিরে
ফিসফিস শব্দ। শব্দ ক্রমে নিচ তলার দিকে যেতে যেতে একসময় থেমে যায়। আজ বাসায় নিলয় ছাড়া
অন্য কেউ নেই। মামার বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য অনেক আত্মীয়ই দুপুরের দিকে বেরিয়ে
গেছে। তার শরীরটা এমনই দুর্বল লাগছে । ইচ্ছা
থাকা সত্ত্বেও বাহিরে সে বের হল না। নিজের উপর অনেক সময়ই মনের নিয়ন্ত্রন চলে না। বাহিরে হঠাৎ গৃহপালিত কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে উঠল।
কুকুরটা অবশ্য প্রায়ই সময়ে অসময়ে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। নিলয়ের মোবাইলে কল আসে। রিসিব করে
বিভিন্ন রঙ্গ রসের আলাপে মত্ত হয়ে ওঠে। আলাপ চলতেই থাকে। কখন যে সন্ধ্যা হয়ে রাত গভীর
হয়েছে তা সে টেরও পায় নি। আবেগ তাড়াত আলাপ কর্মঠ মানুষকে যেমন করে তুলতে পারে অলস তেমনি
অলসকেও করে তুলতে পারে কর্মঠ।
দরজায় হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ হয়। মোবাইলের সংযোগও কেটে যায়। ঘড়ির দিকে তাকায়, রাত ৮টা বাজে।
- ও
মাই গড! অজান্তেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে যায় বাক্যটি। স্রষ্টার নামগুলো ছোটবেলা থেকেই
মুখস্ত করতে হয় কিনা যে কারণে স্নায়ুর সাথে তা একবারে মিশে যায়। তাড়াতাড়ি করে দরজা
খোলে। - কিরে এতক্ষণ ধরে বসে বসে কি করছিলি? সেই
কখন থেকে দরজায় কড়া নাড়ছি ! কথাগুলো বিরতিহীন ভাবে বলে গেল অপূর্ব। সে নিলয়ের ভার্সিটির
বন্ধু। বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনেই অপূর্ব নিলয়ের বাসায় আসে। কিছুটা আশ্চর্য হয়ে নিলয় পাল্টা
প্রশ্ন করে- কেমন আছিস? আজ কোন ফোন-টোন না করেই আসলি যে?
- মনটা
ভাল নেই ।
- কেন?
- ছোট
বোনের বিয়ের কেনাকাটা করা সব স্বর্ণের জিনিসগুলো,লেপটপ,মোবাইল
সেট,কাপড়-চোপড়,বেশ কিছু টাকা আজ চুরি হয়ে গেছে।
- কিভাবে? কখন?
নিলয়ের
কথায় উৎকণ্ঠা ভাব ফুটে ওঠে। প্রচণ্ড রোদ্রে পুড়লে মানুষের মুখ মণ্ডলে যেমন এক ধরনের
কৃষ্ণকায় ছাপ পড়ে তেমনি হঠাৎ অপ্রত্যাশিত কিংবা রূঢ় কথা শুনলেও চোখে মুখে মুহূর্তেই
একধরনের ছাপ পড়ে। যদিও ক্ষণপরে অবস্থাদৃষ্টে তা ম্লান হয়ে যায় কিংবা গভীরতর হয়। নিলয়ের
চোখে মুখেও তেমনি বিষণ্নতার ছাপ।
ভ্রু
কুচকে বলে – সত্যিই? না আমার সাথে ফান করছিস?
- এইসব
বিষয় নিয়ে তর সাথে ফান করে লাভ কী?
- কখন নিয়ছে?
তার
যেন বিশ্বাসই হতে চাচ্ছে না। এত নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরেও কিভাবে চুরি হয় এই কথাটি
বিশ্বাস করতেই তার কষ্ট হচ্ছে। মানব মনে বিশ্বাস সৃষ্টি হতে অনেক সময় লাগে বটে কিন্তু তা ভেঙ্গে যতে মুহূর্তটিও লাগে না। তবু বিশ্বাস
নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। যাচাই করতে চায়
না,হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে। অবিশ্বাস আজ বিশ্বাসের
গভীরে ,পরজীবীরা যেমন অন্ত্রে! চরম বিষ্মিত হয়ে সে অপূর্বর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে
থাকে উত্তরের আশায়। বেদনার্ত কণ্ঠে অপূর্ব বলে
- আজ
সন্ধ্যার দিকে। কে যে নিল সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় নি।
-বাসার
অন্য সবাই কোথায়?
- মামার বিয়েতে।
কথাটি
বলেই সে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সে দীর্ঘশ্বাসে আলোছায়ার মত সুসংবাদ এবং দুঃসংবাদ উভয়ই
যেন ঢেউ খেলে গেল। নিজেক একটু সংযত করে মুখে একটু কৃত্রিম হাসি এনে বলল - আমাদের বাসার
চোর ধরতে না পারলেও কিন্তু তোদের বাসার চোর ধরতে পেরে বড্ড আনন্দ লাগছে। নিজেকে সি
আই ডি সি আই ডি মনে হচ্ছে !
-আমাদের
বাসার চোর! বলিস কি? তামাসা করছিস?
-গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় নিয়ে আমি কখনোই তোর সাথে তামাসা করি না। চল বাহিরে চল, চোর
দেখবি।
- কি বলিস তুই? তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?
এর পর অনেকটা হাত ধরে জোর করেই নিলয়কে বাহিরে টেনে আনে অপূর্ব। প্রথমে একটু জোর করলেও পরে নিলয় নিজেই অন্ধের মত তাকে অনুসরণ করে। ওমা! একি! বুয়া তুমি? তোমার তো সন্ধ্যার সাথে সাথে আসার কথা! এত রাত করলে যে? অসুখ টসুক করেছে নাকি?
বুয়া নীরব। ঈষৎ অন্ধকার। আলো-আধাঁরে তার মুখের অবয়বটা বেশ একটা বুঝা গেল না। বিরবির করে কোন উত্তর দিল কিনা তাও স্পষ্ট বুঝা গেল না। কিন্ত সে কোন উত্তর দিচ্ছে না কেন? তবে কি.......? না না না। এ হতেই পারে না। নিজের মনের সাথে হিসাব মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে নিলয়। কিন্তু মিলে না। জীবন পরিক্রমায় অবশ্য সব সময়ই হিসাব মিলে না। বুয়ার সাথে অন্য এক মহিলাও এসেছে। হয়ত চুরি করতে সহযোগিতা করার জন্য।
আ
অদূরেই মেঝেতে পড়ে রয়েছে লেপটপ, মোবাইল,কাপড়-চোপড়,গহনার বাক্স, মানিব্যাগ,বড় দুটি রুই মাছ। বাসার সামনের মেইন গেট ভেতর থেকে তালা মারা। বিদ্যুতের আলোয় সে সব অবশ্য অনেকটা পরিস্কারই দেখা যাচ্ছে। নিলয়ের বিষ্ময়ের ঘোর কাটতেই চায় না। নিলয়কে দেখেই পোষা কুকুরটা দৌড়ে এল। পায়ের কাছে এসে বারবার লেজ নাড়াতে লাগলো। প্রভুভক্ত কুকুরেরা নাকি এমনই হয়! নিলয় বুয়াকে ঠান্ডা মাথায় বলল-কাজটা মোটেই ভাল কর নি। তোমার বেতনের বাইরেও যখন যা চেয়েছ তার চেয়ে বেশিই পেয়েছ। তোমার টাকার প্রয়োজন বললেই পারতে! ছি! ছি!
বেশ একটা ভারাক্রান্ত উদাস ভাব নিয়ে অপূর্বকে বলল - দরজাটা খুলে দে, বুয়াকে কোন প্রকার গালিগালাজ কিংবা মারপিট না করে কেবল অভিমানের স্বরে বলল – আববু আম্মু আসার আগেই এখান থেকে চলে যাও। আর কোন দিন আমার সম্মুখে এসো না। ঐ মানিব্যাগে রাখা টাকাগুলোও নিয়ে যাও।
অপূর্ব
কোন প্রশ্ন না করে দরজাটা খুলে দেয়। নিভৃতে বুয়া চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। গেটের কাছ
থেকে কি মনে করে ফিরে এসে নিলয়কে পায়ে সালাম করে। সালাম করার সময় কয়েক ফোটা চোখের জল
নিলয়ের পায়ে পড়ে। শব্দহীন কান্না। তারপর চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে যায়। নিলয় প্রধান গেটের
দিকে নিস্পলকভাবে তাকিয়ে আছে। সে চাহনিতে বিষ্ময় আর অজ্ঞাত কতক প্রশ্ন ঢেউ খেলে যায়।
সমাধান হয়েও হয় না।
মুনশি আলিমজাফলং, গোয়াইনঘাট, সিলেট