নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মাসিক আয় এবং ব্যয় একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির প্রভাব তাদের জীবনযাত্রার ওপর পড়ছে কিন্তু তাদের পারিশ্রমিক রয়ে গেছে অপরিবর্তিত।
দেশের প্রথম সারির অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারাকাত বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে নির্দিষ্ট ও মধ্যম আয়ের নাগরিকদের বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে বেশ ভালো বেগ পেতে হচ্ছে। খাদ্যসামগ্রী ছাড়া অন্যান্য এসব জিনিসের মূল্যস্ফীতির অংকটা হয়ে গেছে দ্বিগুণ যা অদূর ভবিষ্যতে কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।
অন্য একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, এসব উপযোগ মধ্যবিত্তের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা একটি নির্দিষ্ট মানের মধ্যেই তাদের জীবনযাত্রা পরিচালিত করে, তাই মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানসিকভাবেও তাদের কিছুটা ধাক্কা খেতে হয়। মধ্যবিত্তের নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশিরভাগ জিনিসের মূল্যই বৃদ্ধি পেয়েছে।
অধ্যাপক বারাকাত বলেন, বাড়িভাড়া, ডাক্তারের ফি, হাসপাতাল খরচ, সাংসারিক খরচ, বিভিন্ন ক্লাবের ফি, অনুষ্ঠানে কমিউনিটি সেন্টার ও হোটেল ভাড়া এসবের খরচ মধ্যবিত্তের জীবনে প্রভাব ফেলে। দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশই এখনো দরিদ্র।
‘বাংলাদেশে উঠতি মধ্যবিত্ত ও ভোক্তা বাজার’ শিরোনামে সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, সরকার জনসংখ্যার হার নিয়ন্ত্রণ এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মানোন্নয়নের পরও ১৫ কোটি জনগণের মধ্যে ৯ কোটি ১৮ লাখ মানুষই দরিদ্র। সেখানে দেখা গেছে, ২৫ বছরে (১৯৮৪-২০১০) দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৩ কোটি ৮৯ লাখ।
অধ্যাপক বারাকাত আরও বলেন, দরিদ্র মানুষের সংখ্যার এই বৃদ্ধি জাতীয় উন্নয়ন নীতিমালার পরিস্কার ব্যর্থতার উদাহরণ। তিনি একাধারে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি।
তিনি বলেন, দেশের মোট জনসংখ্যার ৩১.৩ শতাংশ মধ্যবিত্ত যেখানে ২.৭ শতাংশ ধনী অথবা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ।
একজন মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবি বলেন, নির্দিষ্ট আয়ের একটি পরিবার যাদের মাসিক বিদ্যুৎ বিল ছিলো ৩০০০ টাকা, তাদের বিল এক মাসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০০০ টাকায়। গত বছর অগ্রিম আয়করের পরিমাণ ছিলো ১৫ হাজার টাকা, কিন্তু এটি একধাপে বাড়িয়ে করা হয় ৩০ হাজার টাকা।
কয়েক বছর আগেও সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার চাকুরিজীবিদের তাদের বেতানের ওপর কোন কর দিতে হতো না, কারণ তাদের বেতন আয়কর পরিশোধিত বলে গণ্য হতো। কিন্তু বর্তমানে তাদেরকে নিজের পকেট থেকে আয়কর পরিশোধ করতে হয়।
মহানগরীর রাস্তা ও যানবাহনের পরিস্থিতির কারণে মধ্যবিত্ত পরিবারে একটি গাড়ি থাকা এখন অপরিহার্য। এক টুকরো জমি, একটি মাঝারি মানের ফ্ল্যাট, মফস্বল শহরে একটি নিজস্ব বাড়ি, একটি টেলিভিশন এবং একটি আইপিএস এসব এখন আর বিলাসিতার বস্তু হিসেবে দেখা হয় না। এগুলো এখন আধুনিক জীবনযাপনেরই একটি অংশ। এসবের ওপর কর আরোপের বিষয়টি সহনশীলতার সাথে এবং এগুলো এখন মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বাভাবিক চাহিদা হিসেবেই দেখা উচিৎ। যারা এই রাজস্ব এবং আর্থিক নীতি তৈরির সাথে সম্পৃক্ত তারা সাধারণত মধ্যবিত্ত পরিবারেরই হয়ে থাকে। সমাজে যারা একটি সীমিত আয়ের মাধ্যমে জীবনধারণ করেন, তাদেরকে বোঝা উচিৎ। কিন্তু এটা দেখতে খারাপ লাগে যে মধ্যবিত্তদের তারা শুধু তাদের লক্ষ্যপূরণের একটি মাধ্যম হিসেবেই বিবেচনা করে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তারেক হোসেন খান বলেন, ১৯৭০ এর বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে বাংলাদেশ অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, যেসব দেশ সবসময় বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করে, তাদের ক্ষেত্রে অমানজনক বিশেষণ ব্যবহৃত হয়। বড় ধরনের কোন খনিজ সম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়া এসব দেশের মানুষ ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার কবলে পড়ে বিপর্যস্ত থাকে। গত দশকে হরতালসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক অরাজকতা থাকা স্বত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫ থেকে ৬.৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মধ্যবিত্তরা এখন চাকুরি ও উপার্জনের ক্ষেত্রে সরকার এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কম নির্ভরশীল। মধ্যবিত্তের এই বর্ধিত সংখ্যা ক্রমবর্ধমান চাকুরির বাজারে ভূমিকা রাখছে, বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। যার ফলে একটা সময় আমাদের বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হবে না। বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আত্ম কর্মসংস্থান এবং উদ্যোক্তা হবার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ বর্তমানে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ রপ্তানি করে এবং এর ৭৮ শতাংশই রপ্তানি হয় তৈরি পোশাক খাত থেকে। মধ্যবিত্তের বর্ধিত এই সংখ্যাই তৈরি পোশাক খাতে এই উন্নতির চালিকাশক্তি।
বেতন কাঠামোর কথা উল্লেখ করে তারেক হোসেন খান বলেন, ওপরের ১০ শতাংশই বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের দুই পঞ্চমাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মত বাংলাদেশেও ধনী ও গরীবের মধ্যে এই বিস্তর ব্যবধানের কারণে সামাজিক অস্থিরতা, কখনও কখনও সহিংস বিক্ষোভে রূপ নেয়।
আরেকজন অর্থনীতিবিদ বলেন, বাংলাদেশে খুব দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে ধনী এবং গরীবের মধ্যে যখন ব্যবধান বেড়ে যাবে তখন সেটির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য উপায় খুঁজে বের করা।
অনুবাদ : মৃদুল কান্তি রায় (নিউ নেশন থেকে)

Author Name

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.