সূর্য দেবতা রা আর আকাশের দেবী নাটের ছিলো চার সন্তান। ওসিরিস, সেত, আইসিস আর নেপথিস। দুই ভাইয়ের মাঝে ওসিরিস জন্মালো আগে আর তার দুই দিন পর জন্ম নিলো সেত। ওসিরিস ছিলো কালচে আর উর্বর ভূমির মতো পরিপূর্ণ। অন্যদিকে সেত ছিলো মরুভূমির মতো ফ্যাকাসে এবং মুখ ছিলো লাল। ওসিরিস পছন্দ করতো শান্তি আর সেত যুদ্ধ।
মিশরীয় রাজবংশের নিয়ম অনুযায়ী ওসিরিসের সাথে বিয়ে হলো আইসিসের আর সেতের সাথে বিয়ে হলো নেপথিসের। রীতি অনুযায়ী বয়সে বড় বলে ওসিরিস হলো ফারাও। মিশেরের শাসক। ওসিরিস ছিলো সুশাসক। তার শাসনে প্রজারা সন্তুষ্ট ছিলো। ছিলো মিশরে শান্তি। সবাই ওসিরিসকে ভালোবাসতো, পছন্দ করতো। পছন্দ করতো না শুধু একজন। সে হলো তারই ছোট ভাই সেত। দুই দিনের ছোট হওয়ায় সে ফারাও হতে পারলো না- এই ছিলো তার ক্ষোভ। আর সকলেই ওসিরিসের প্রশংসা করে, এতে তার খুব হিংসে হতো। সেত পরিকল্পনা করলো কীভাবে মেরে ফেলা যায় ওসিরিসকে। কোনভাবে কোনভাবে ওসিরিসকে মেরে ফেলা গেলেই সে হতে পারে ফারাও। অবশেষে সে এক বুদ্ধি আটলো।
আবলুস কাঠ দিয়ে বানালো সে এক চমৎকার কফিন, কফিনের কাঠে করলো সোনারূপার কারুকাজ। এক রাজ অনুষ্ঠানের দিন সেত সেই কফিন নিয়ে এলো সভায়। সবাই প্রশংসা করলো এর। সেত সবাইকে আহ্বান করলো সেটাতে শোয়ার জন্য, যার মাপে হবে, তাকেই সেটা উপহার দিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু কারো মাপে হয় না। কারো ছোট হয়, কারো হয় বড়। শেষে ওসিরিস গিয়ে কফিনে শুয়ে দেখলো। ওসিরিস শুতেই কফিনের ডালা বন্ধ করে পেরেক মেরে সেতের লোকেরা তা ভাসিয়ে দিলো নীল নদে।
সেতের ষড়যন্ত্র সফল হলো। সে হলো মিশরের ফারাও। আইসিস বুঝতে পারলো সেতের ষড়যন্ত্র। আইসিস নীল নদের তীরে বসে অনেক কাঁদলো প্রাণের স্বামী ওসিরিসের জন্য। তার এই কান্নার কারণে প্রতিবছর নীলনদে বন্যা হয়।
যাইহোক, আইসিস যেমন ছিলো সুন্দরী তেমনি ছিলো তার ঐশ্বরিক ক্ষমতা। সে নীল নদের তীরে তীরে খুঁজতে লাগলো স্বামীর মৃতদেহ। ও দিকে কফিন নীল নদে ভাসতে ভাসতে ব্যবলুস নামক স্থানের এক গাছের দুই শাঁখার ভেতর আটকে গেলো। কফিনকে ভেতরে রেখে গাছ বেড়ে উঠলো। গাছের কাণ্ডের ভেতর লুকিয়ে গেলো সেই কফিন। সেই গাছ ছড়াতো অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ। ব্যবলুসের রাজার কানে এ খবর পৌঁছালে সে সেই গাছ কেটে তা দিয়ে স্তম্ভ বানিয়ে রাজ প্রাসাদে রেখে দিলেন। আইসিস নীল নদের তীর ধরে খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছালো ব্যবলুসে আর ঘ্রাণ পেলো সেই অদ্ভুত কাঠের। বুঝতে পারলো এখানেই আছে তার স্বামী ওসিরিসের কফিন। আইসিস রানীর দাসী হিসেবে ঢুকে গেলো রাজপ্রাসাদে। সেখানেই থাকে সে আর রানীর সেবা করে। একদিন আর দাসীরা রানীকে জানায় রাতে ঐ স্তম্ভের ঘর থেকে পাখির কান্নার শব্দ শোনা যায়। কী ঘটে দেখার জন্য রানী চুপচাপ লুকিয়ে থাকলো সে ঘরে, মধ্যরাতে দেখতে পায় সেই কাঠের স্তম্ভ কেমন যেন আলো ছড়াচ্ছে আর তার দাসী নীল আবাবিল পাখি হয়ে সেই স্তম্ভকে ঘিরে উড়ে উড়ে কাঁদছে। রানী বুঝতে পারলো এই দাসী আসলে দেবী আইসিস। সে নত হয়ে তাকে প্রণাম করলো। আইসিস রানীর কাছে আসল রূপে আসলো। আর দাবী করলো কাঠের স্তম্ভটা নিয়ে যাওয়ার। রানী তাকে অনুমতি দিলো। কাঠের স্তম্ভ নিয়ে আইসিস চলে এলো মিশর। তার বোন নেপথিসকে জানালো সমস্ত ঘটনা। নেপথিস বোনের কষ্ট বুঝতে পারলো। আর ওসিরিসতো তারও ভাই। রাতের আঁধারে নেপথিস আইসিসকে সাহায্য করলো মাটির তলার অন্ধকার ঘরে তাদের লুকিয়ে রাখতে। আইসিস কফিন কেটে বের করে আনলো ওসিরিসের মৃত দেহ। তারপর আগুন জ্বেলে মন্ত্র পড়ে দুই হাত প্রসারিত করতেই পাখির বিশাল ডানার মতো হয়ে গেলো। সেই ডানা দিয়ে বাতাস করতে থাকলো ওসিরিসকে। বাতাস ওসিরিসের নাকে ঢুকতেই শ্বাস নিতে শুরু করলো সে, জীবিত হয়ে উঠলো। সেই রাতে আইসিস আর ওসিরিস পরম আনন্দে কাটালো অন্ধকার ঘরে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্নান করতে গেলো আইসিস। তার গর্ভে তখন সঞ্চারিত ওসিরিসের ভ্রুণ। কিন্তু সকাল বেলা আবলুস কাঠের টুকরা দেখে খোঁজ পেয়ে গেলো সেত। আবিষ্কার করলো মাটির তলার অন্ধকার কক্ষে ঘুমন্ত ওসিরিসকে। মুহূর্ত সময় অপেক্ষা না করেই তার দেহকে কেটে ১৪ টুকরা করে ছড়িয়ে দিলো সমস্তু মিশরে।
আইসিস স্নান শেষে ফিরে এসে দেখে ওসিরিসের রক্ত ভেজা ঘর। বুঝতে পারলো বড় র্দুঘটনা ঘটে গেছে। সে সমগ্র মিশর ঘুরে খুঁজে খুঁজে একত্রিত করলো ওসিরিসের শরীরের ১৪ টুকরা। তারপর সেগুলো সেলাই করে লিনেন কাপড়ে প্যাঁচিয়ে কফিনে ভরে ঔষধি গাছের রসে ডুবিয়ে রাখলো। এটাই ছিলো মিশরের প্রথম মমি। ওসিরিসের প্রাণ চলে গেলো পাতালে, সে হয়ে উঠলো পাতালের রাজা। আর আইসিস মর্তে জন্ম দিলো এক পুত্র সন্তানের, নাম তার হোরাস।