হেরাক্লেস ছিলো গ্রিকপুরাণের শক্তিশালী বীর। রোমানরা তাকে ডাকতো হারকিউলিস। হারকিউলিস ছিলো জিউসের পুত্র। মা ছিলেন মর্তের আল্কমেনি। আল্কমেনি ছিলো পার্সেউস এর বংশধর। জিউস আর আল্কমেনির মিলনে জন্ম নেয় মহাশক্তিধর হারকিউলিস। হারকিউলিস গ্রিকপুরাণের খুবি জনপ্রিয় চরিত্র। পুরাণে হারকিউলিসের অসংখ্য প্রনয়ের কথা উল্লেখ আছে। তবে মেগারার সাথে হারকিউলিসের প্রেম কাহিনীটা বেশ হৃদয় ছোঁয়া। কাহিনীটাকে একটু পরিবর্তন করে একটি এ্যানিমেশন মুভিও তৈরি হয়েছে। হারকিউলিসকে নিয়ে তৈরি করা টিভি সিরিজ হয়েছে তুমুল জনপ্রিয়। সম্প্রতি রক অভিনীত হারকিউলিস সিনেমাও তোলপাড় করেছে বিশ্ব চলচ্চিত্রাঙ্গণ। সে যাইহোক, আসুন গল্পটা শুনে নেই।
অনেক অনেক দিন আগে গ্রিসের থিবস শহরে বাস করতো আম্ফিত্রায়ন নামক এক যোদ্ধা। তার ছিলো অপরূপ সুন্দরী এক স্ত্রী, আল্কমেনি। আল্কমেনির রূপ দেখে দেবতা জিউসতো দিওয়ানা। যেভাবেই হোক আল্কমেনিকে তার চাই। আম্ফিত্রায়ন তখন যুদ্ধে। ঘরে একা আল্কমেনি। জিউস চলে এলো আম্ফিত্রায়নের রূপ ধরে। এসে বললো, “কই গো সোনাচাঁদ, দেখো আমি যুদ্ধ থেকে ফিরেছি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ও তৃষ্ণার্ত। আমাকে সেবা দাও, প্রিয়তমা।” আল্কমেনি ভাবলো আহা! কতদিন পর যুদ্ধের ময়দান থেকে তার স্বামী ফিরে এসেছে। প্রাণ ভরে সেবাযত্ন করলো। আল্কমেনির সেবাযত্নে আম্ফিত্রায়নরূপী জিউস খুব খুশি। আল্কমেনিকেও খুশি করলো জিউস। সে তার গর্ভে এমন এক পুত্রসন্তানের বীজ দিলো যে হবে মানুষ ও দেবতাদের মধ্যে সেরা বীর। আল্কমেনি ভাবলো যুদ্ধে গিয়ে আমার স্বামী দেখি মহাবীর হয়ে গেছে! মিলনে সুখের পরিতৃপ্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো সে। কাজ শেষে জিউস উধাও। আল্কমেনির গর্ভে বীজ রেখে চলে গেলো। আল্কমেনির ঘুম ভাঙলো পরদিন সন্ধ্যায় আম্ফিত্রায়নের ডাকে। আসলে এসে হাজির হয়েছে আসল আম্ফিত্রায়ন। এসে বললো, “কই গো সোনাচাঁদ, দেখো আমি যুদ্ধ থেকে ফিরেছি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ও তৃষ্ণার্ত। আমাকে সেবা দাও, প্রিয়তমা।” আল্কমেনিতো পুরাই অবাক। প্রতিদিন কী বলে এইসব আম্ফিত্রায়ন! প্রথমে ভাবলো সে হয়তো স্বপ্ন দেখছিলো। তারপর নিজের পরিতৃপ্ত শরীরের অনুভূতিতে বুঝলো ওটা আসলে জিউস ছিলো।
যাইহোক, এইকথা তো এখন আর আম্ফিত্রায়নকে বলে লাভ নেই, বরং ক্ষতিই হবে। সে সেবাযত্ন করলো আম্ফিত্রায়নের। সেই রাতে আম্ফিত্রায়নও আল্কমেনির গর্ভে বীজ রাখলো। এরপর আল্কমেনি জন্ম দিলো দুই পুত্রের। জিউসের বীজ থেকে জন্ম নিলো হারক্লেস বা হারকিউলিস। আর আম্ফিত্রায়নের বীজ থেকে জন্ম নিলো ইফিক্লেস। ওইদিকে জিউসের স্ত্রী হেরা জেনে গেলো জিউস এক মূল্যবান বীজ রেখে এসেছে মর্তে। হিংসায় কাতর হেরা নিজের জাদুশক্তিতে পার্সেউস এর বংশে জন্মদিলো আর এক সন্তান ইরিসথিয়াসের। যে কিনা জন্ম নিলো হারকিউলিসের কয়েক মিনিট আগে। যার কারণে বড় হয়ে ইরিসথিয়াস হলো রাজা আর হারকিউলিসকে মানতে হলো তার আদেশ-উপদেশ। তবে তার আগেই হারকিউলিস যখন খুব ছোট আর সে ঘুমাচ্ছিলো বিছানায় আল্কমেনির বিছানায় শুয়ে, তখন তাকে মেরে ফেলার জন্য হেরা পাঠিয়ে দিলো দুইটা বিষধর সাপ। কিন্তু সাপ আসতেই হারকিউলিস কীভাবে যেন জেগে ওঠে আর সাপদুটিকে গলা টিপে মেরে ফেলে। এ ঘটনায় সবাই বুঝতে পারে হারকিউলিসতো শুধু ‘মানুষ হারকিউলিস’ নয়; তার মাঝে কিছু একটা আছে। তবে অনেক জায়গায় এই ঘটনাটাকে এইভাবে বলা হয় যে, আম্ফিত্রায়ন বুঝে গিয়েছিলো দুইপুত্রের একটি তার নয়, জিউসের। কিন্তু কোনটি তার আর কোনটি জিউসের সেটি বোঝার জন্য নিজেই সাপ ছেড়ে দিয়েছিলো দুই সন্তানের মাঝে। যখন ইফিক্লেস সাপ দেখেতে পেলো, সে ভয়ে ভ্যাঁও করে কেঁদে ফেললো। কিন্তু হারকিউলিস ভয় না পেয়ে সাপকে গলা টিপে মেরে ফেললো। এইভাবে আম্ফিত্রায়ন বুঝতে পারে হারকিউলিস জিউসের পুত্র। আম্ফিত্রায়ন লোক খারাপ ছিলো না। সে তখন হারকিউলিসকে পাঠালো ফিলোকতেসের গুরুগৃহে। ফিলোকতেস হারকিউলিসকে তৈরি করলো ক্রিড়া ও যুদ্ধের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এক মহান বীর হিসেবে।
হারকিউলিসের বীরত্বের কথা বললে অনেক কথাই বলতে হবে, সেটা আর একদিন বলা যাবে। আজকে যা বলতে চাচ্ছিলাম সেটা বলি— হারকিউলিসকে পছন্দ করতো সব দেবতাই, জিউসের পুত্র বলে কথা। তারপর আবার মস্ত বীর। শুধু অপছন্দ করতো জিউসের ভাই হেডস। কারণ হেডস অলিম্পিয়াসের রাজা হতে চায়। আর রাজা হওয়ার জন্য রাজা জিউস হচ্ছে তার বাধা। জিউস না থাকলেতো সেই রাজা! তাই তাকে মেরে ফেলার যত ষড়যন্ত্র করার, সে করে। তার জন্য যত কাঠখর পোড়াতে হয় সে তা পোড়াতেও রাজী। কিন্তু তিন ভাগ্যদেবী ক্লোতো, ল্যাচেসিস ও এত্রোপোস তাকে জানায় হারকিউলিসের জন্য জিউসকে মারা সম্ভব নয়। তো হয়ে গেলো হারকিউলিস হেডসের শত্রু। এইদিকে হারকিউলিস নিজেও জেনে যায় যে সে জিউসের পুত্র। সে তার পিতার কাছে আবদার জানায়, ‘যেই হেতু আমি জিউসের পুত্র, সেই হেতু আমি কেন মরার পৃথিবীতে খেটে মরবো! আমিও থাকবো স্বর্গপুরী অলিম্পিয়াসে; পাবো অমরত্ব।’ কিন্তু জিউস বলে, ‘এইখানে আসতে হলে তোমাকে বীর হইতে হইবে, পুত্রধন! বীরভোগ্যা এ অলিম্পিয়াস, বুঝলে হে?’ হারকিউলিস তার বীরত্ব দেখাতে বিশাল বিশাল সব কাজ করতে থাকে। হেডস তাকে মারতে গিয়ে সাহায্যই করে একরকম। কারণ হেডসের পাঠানো দৈত্য মেরে মেরে সে পৃথিবীর মহাবীরে পরিণত হয়। এবার হারকিউলিস আবার জিউসকে বলে, পিতা, দেখো আমি কতোগুলা দৈত্য মারছি! আমি কত বড় বীর!’ পিতা জিউস বলে, ‘পুত্র, বীরদের কোন দুর্বলতা থাকতে নাই। তোমার হৃদয়ে যে দুর্বলতা টের পাই! সেইটা দূর করো।’
হারকিউলিস তার দুর্বলতা খুঁজতে থাকে। শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারে কোথায় তার দুর্বলতা। হারকিউলিস যখন গুরুগৃহ থেকে ফিরছিলো তখন সে দেখতে পায় অরণ্যে এক দানব যার আধেক দেহ মানুষের আর আধেক দেহ ঘোড়ার, সে এক অপরূপ সুন্দরী মেয়েকে আক্রমন করেছে। হারকিউলিস সেই দানবকে হত্যা করে মেয়েটিকে রক্ষা করে। এই মেয়েটিই থিবসের রাজা ক্রিয়নের কন্যা মেগারা। যাকে পরবর্তীতে হারকিউলিসে ভালোবেসে বিয়ে করে। তার এই দুর্বলতার কথা জেনে যায় হেডসও। হেডস বুদ্ধি করে মেগারাকে অপহরণ করে। সাইক্লোপস নামের এক চক্ষুওয়ালা এক দানব পাঠিয়ে দেয় হারকিউলিসকে হত্যা করতে। হারকিউলিস সাইক্লোপসকে হত্যা করে, মেগারাকে উদ্ধার করে। আসলে হেডস একদিকে হারকিউলিসকে ব্যস্ত রেখে অন্যদিকে জিউসকে মেরে ফেলার জন্য পাঠায় টাইটান নামক এক দৈত্যকে। কিন্তু বীরপুত্র হারকিউলিস থাকতে কে মারবে জিউসকে?
হারকিউলিস টাইটানকে হত্য করে নিরাপত্তা দেয় জিউসকে। দেবতারা সব হারকিউলিসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু হেরা এটা মেনে নিতে পারে না। কার না কার গর্ভে জন্ম নেয়া এই পুত্র পৃথিবী আর স্বর্গপুরীতে দাপটে চলবে- এটা মেনে নেয়া হেরার জন্য খুব কষ্টের। তাই হারকিউলিস মেগারার কাছে ফেরার পথে হেরা জাদুমন্ত্রে হারকিউলিসের মাথায় ঢুকিয়ে দিলো বিষ। হারকিউলিস পাগলের মতো হয়ে গেলো। ফিরে এসে মেগারাকে হত্যা করে ফেললো। কিন্তু বিষের ক্রিয়া যখন শেষ হলো, তখন দেখলো মেগারাকে সে হত্যা করে ফেলেছে। এই ভয়ঙ্কর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে ভেঙ্গে পড়লো হারকিউলিস। তার প্রিয়তমা মেগারাকে ছাড়া সে বাঁচতে চায় না। দরকার নাই অমরত্বের, দরকার নাই স্বর্গের। সে আত্মহত্যা করতে চাইলো। জিউসের কাছে প্রার্থনা করলো যেন তাদের দুজনের আত্মা এক সাথে রাখা হয়। শেষে ভালোবাসার কারণে এই আত্মাহুতির ইচ্ছার জন্য জিউসসহ সকল দেবতা হারকিউলিসকে সত্যিকারের বীরের মর্যাদা দেয় আর ফিরিয়ে দেয় মেগারার জীবন।
অতঃপর হারকিউলিস আর মেগারা পৃথিবীতে ‘সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো’ যতদিন না পর্যন্ত হেরা আবার নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে।
অতঃপর হারকিউলিস আর মেগারা পৃথিবীতে ‘সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো’ যতদিন না পর্যন্ত হেরা আবার নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে।