সম্রাট ডেভিড দুপুরের ঘুম শেষে বিকালে জাগলেন। সূর্যে পশ্চিমে ঢলে পড়েছে অনেকটা। হিমেল বাতাসে মিষ্টি ফুলের ঘ্রাণ। ডেভিড ছাদে হাঁটতে গেলেন। রাজপ্রাসাদের ছাদে উঠতে উঠতে ভাবছিলেন, বয়স হয়ে গেছে, শরীর আর কষ্ট করতে চায় না। রাব্বার যুদ্ধেও তিনি গেলেন না, পাঠিয়েছেন সেনাপতি উরিয়াকে। উরিয়ার উপর অবশ্য তার যথেষ্ট আস্থা আছে। যুদ্ধ পাগল লোকটার যুদ্ধের সময় মাথায় আর কিছুই থাকে না। শত্রুকে পরাজিত করতে না পারা পর্যন্ত আর কোন দিকে খেয়াল থাকে না উরিয়ার। তাই যুদ্ধ নিয়ে কোন চিন্তা ডেভিডের নেই। উরিয়া ঠিকই যুদ্ধ জয় করে ফিরবে। এইসব ভাবতে ভাবতে তিনি যখন ছাদের কিনারে এসে দাঁড়ালেন দেখলেন অদূরেই এক বাড়ির ছাদের স্নানাগারে এক সুন্দরী যুবতী সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে স্নান করছে। যুবতীর রূপ দেখে সম্রাট চোখ ফেরাতে পারেন না। যুবতীর ভেজা অঙ্গে বিকালের সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে। সোনারঙ গাত্র আরো সোনালি হয়ে চক চক করছে। যুবতীর স্নান শেষ করে চলে না যাওয়া পর্যন্ত সম্রাট তার দিকেই তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
সম্রাটের মস্তিষ্কে এই রূপসী যুবতীর রূপ গেঁথে গেলো। তিনি দূত পাঠিয়ে জানলেন, এই যুবতী আর কেউ নয়, তারই পুত্রতুল্য সেনাপতি উরিয়ার স্ত্রী। নাম বাথশেবা। ডেভিড চেষ্টা করলেন মাথা থেকে বাথশেবার নগ্নদৃশ্য সরিয়ে ফেলতে। কিন্তু যতই চেষ্টা করলেন ততোই যেন স্পষ্ট হয়ে উঠলো বাথশেবার রূপ তার মস্তিষ্ক জুড়ে। শেষে ভাবলেন, মেয়েটার সাথে কথা বললে হয়তো মাথা থেকে ব্যাপারটা দূর হবে। তিনি চিঠি লিখে পাঠালেন বাথশেবাকে তার সাথে দেখা করার কথা বলে। বাথশেবা চিঠি পেয়ে হাজির হলো সম্রাটের সামনে। আসার আগে সে পরে নিয়েছিলো উজ্জ্বল জরির পোশাক, আর গায়ে মেখেছিলো মৃগনাভীর ঘ্রাণ।
সম্রাটের সামনে এসে যখন বাথশেবা দাঁড়ালো তখন সম্রাট আবার ভুলে গেলেন সবকিছু। তার মনে হলো, এই রূপসীর রূপের আগুনে না পুড়ে মরা পর্যন্ত তার শান্তি নেই। আর কী এক কামুক ঘ্রাণ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। যুবতী বাথশেবাও সম্রাটের সেবাদানে কার্পণ্য করেনি। নিজেকে সম্রাটের হাতে তোলে দিতে পেরে যেন নিজেকে সম্মানিত বোধ করেছে। এইভাবে সম্রাট ডেভিড আর বাথশেবা পরস্পরের প্রেমে পড়ে গেলেন। আর সেই প্রেম শরীর জুড়ে পুলক হয়ে ঝরে পড়তে থাকলো প্রতি রাত। এভাবেই চলতে থাকে অবৈধ প্রণয়, গোপন সহবাস।
কিন্তু একদিন বাথশেবা সম্রাটকে জানায় যে, সে গর্ভবতী। কথাটা শোনামাত্র সম্রাটের শরীর বেয়ে নেমে গেলো শীতল ঘাম। সর্বনাশ! এ যে অধর্ম! আর জনের স্ত্রীর গর্ভে তার সন্তান লোকে জানলে লজ্জার আর শেষ থাকবে না। সম্রাট হয়ে তিনি এ অধর্ম করতে পারেন না। তিনি উরিয়ার কাছে চিঠি লিখে পাঠালেন, যেন যুদ্ধ থেকে তখনি বাড়ি ফেরে বাথশেবার সাথে দেখা করে। উদ্দেশ্য ছিলো যদি কোনভাবে কোনভাবে বাথশেবার সাথে উরিয়া কিছু সময়ের জন্যও মিলিত হতে পারে, তবে বলা যাবে- বাথশেবার গর্ভে উরিয়ার সন্তান। লোকেও সন্দেহ করবে না, উরিয়াও না। কিন্তু যুদ্ধবাজ উরিয়া যুদ্ধ ফেলে আসতে রাজী না। যুদ্ধে একটা দফারফা না করে সে ফিরবে না। কোনমতেই সে ত্যাগ করবে না যুদ্ধক্ষেত্র। সম্রাট ডেভিড পড়লেন বিপদে। বাথশেবা সম্রাটের বুকে নাক গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠলো, ‘আপনি কিছু একটা করেন, না হলে আমি বিষ খাবো। এই পোড়ামুখ কাউকে দেখাবো না। ছি! ছি!’ বাধ্য হয়ে সম্রাট গুপ্ত ঘাতক পাঠালেন উরিয়াকে মেরে ফেলার জন্য। গুপ্ত ঘাতক উরিয়াকে যুদ্ধের ময়দানে মেরে ফেললো। বিধবা হলো বাথশেবা। তখন সম্রাট তাকে বিয়ে করলেন। বৈধতা দিলেন নিজের সন্তানের জন্মকে। পরবর্তীতে ডেভিড আর বাথশেবার সন্তান সলোমন সিংহাসনে বসেন সম্রাট হয়ে।
এ গেলো বাইবেলে সম্রাট ডেভিড ও বাথশেবার প্রণয়ের গল্প। এবার নিচের পেইন্টিংটা দেখুন।
এটি বিখ্যাত চিত্রকর রেমব্রান্টের বহুল আলোচিত পেইন্টিং Bathsheba at Her Bath। যিনি এই পেইন্টিং-এ বাথশেবা রূপে স্নান করছেন তিনি স্টোফেল। অর্থাৎ এই ছবিটির জন্য ন্যূড মডেল হন হেনড্রিকজ স্টোফেল। তিনি ছিলেন রেমব্রান্টের ঝি। হেনড্রিকজ স্টোফেলকে বাসার কাজ-টাজ করার জন্যই রেমব্রান্ট নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মাঝেই তিনি হয়ে উঠলেন চিত্রকরের প্রেমিকা। স্ত্রী সাসকিয়া মারা যাওয়ার পর ডিরক্স নামে একজন পরিচারিকার সাথে সম্পর্ক ছিলো রেমব্রান্টের। তারপর স্টোফেলাকে রাখার পর দুই পরিচারিকা প্রায়ই ঝগড়া বাধিয়ে বসতো। যাইহোক, সেই স্টোফেলাকে মডেল করে, তার শৈল্পিক নগ্নতাকেই তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে তুলে ধরলেন রেমব্রান্ট। আর স্টোফেলাও দাসী থেকে রাজরানী হয়ে উঠলো। আর অমর হয়ে গেলো এই বিখ্যাত ছবির মাধ্যমে। স্টোফেলার গর্ভে রেমব্রান্টের এক কন্যা জন্ম নেয়। বিয়ে বহির্ভূত সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য স্টোফেলাকে শাস্তি দেয় চার্চ। কিন্তু রেমব্রান্ট চার্চকে পাত্তাই দিতেন না। চার্চের ধর্ম যাজকরাও আর ঘাঁটতে আসেনি তাকে।