সাঈদ আহসান খালিদ
আচ্ছা! মৃত্যুর ঠিক আগ মুহুর্তের অনুভূতিটা কেমন? একজন মানুষ মারা যাওয়ার সময় তাঁর কেমন লাগে?
বিখ্যাত অভিনেতা এডমন্ড গোয়েন কে মৃত্যুর আগ মুহুর্তে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, মৃত্যুর অনুভূতিকে আপনার কাছে কঠিন মনে হচ্ছে কি না? জাত অভিনেতার উত্তরটা ছিলো এরকম, “Yes, it’s tough, but not as tough as doing comedy….!”
মরে যাওয়ার অনুভূতি কি আসলেই কমেডি করার চেয়ে সোজা? ধর্মীয় বর্ণনায় যেমনটা এসেছে মৃত্যুর অনুভূতি ভয়াবহ বিশেষত পাপীদের জন্য জীবন্ত শরীর থেকে চামড়া ছিলে নেয়ার মতো যন্ত্রণাদায়ক। আবার বিজ্ঞানীরাও মৃত্যু এবং ঠিক মৃত্যুর নিকটবর্তী অভিজ্ঞতা- Near Death Experience বা NDE) নিয়ে নানান গবেষণা করেছেন।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে মৃত্যু আচমকা কোন বিষয় নয়। মৃত হতে হলে প্রথমে হার্টের কার্যক্রম বন্ধ হতে হবে, রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে ব্রেইন ও শরীরের অন্যান্য অংশে অক্সিজেন সরবরাহ থেমে যাবে- এই পর্যায়কে বলা হয় 'Clinical Death'। অক্সিজেনের অভাবে পরবর্তী ৪-৬ মিনিটের মধ্যে ব্রেইনের কোষগুলো মারা যেতে শুরু করে। ব্রেইন যখন কর্মকাণ্ড পুরোপুরি থামিয়ে দেয় তখন বলা হয় 'Biological Death' হয়েছে বা ব্যক্তিটি 'মারা' গেছেন।
কিন্তু 'ক্লিনিক্যালি ডেড' একজন ব্যক্তিও অনেক সময় জীবন ফিরে পেতে পারেন লাইফ সাপোর্টের মাধ্যমে যেটিকে বলা হয় 'cardiopulmonary resuscitation (CPR)' যার মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাসপ্রশ্বাস ও রক্ত সঞ্চালন চালু রাখা হয়। তাই হার্টবিট বন্ধ হওয়া মানেই মৃত্যু নয়। ফলে বর্তমানে মৃত্যু নির্ধারণের ক্ষেত্রে হার্ট থেমে যাওয়ার চেয়ে নির্ভরযোগ্য ঘটনা ধরা হয় ব্রেইন থেমে যাওয়াকে।
কিন্তু মজার ব্যাপার হল, কত সময় পর্যন্ত হার্ট বা ব্রেইন পুনরায় সচল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। সাধারণত ব্রেইনে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হওয়ার পর ১৫ মিনিট পার হলে মস্তিষ্কের স্থায়ী মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করা হয়।
একবার কারো মৃত্যু হয়ে গেলে যেহেতু তাঁর আর ফিরে আসার সুযোগ নেই তাই ভাবা হয় মৃত্যুর স্বাদ কেমন বা মৃত্যু পরবর্তী অভিজ্ঞতা কী তা জানা অসম্ভব। বিজ্ঞানীরা অনেক চেষ্টা করেছেন, করছেন। কিন্তু ফলাফল ঘুরেফিরে সেই একই– মারা যাওয়ার পর মানুষগুলো কোথায় যায়, তা কিছুতেই জানা যায়নি। সেক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত ধর্মবিশ্বাসই সম্বল।
তবে মৃত্যুর একেবারে নিকটবর্তী অবস্থা যেমন ক্লিনিক্যাল ডেথ বা ডিপ কোমা অবস্থা থেকে অনেকে ফিরে এসেছেন। ফিরে এসে বয়ান করেছেন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা।
কেউ বলেছেন তাঁরা স্বর্গ দেখেছেন, কেউ দেখেছেন নরক, কেউ প্রত্যক্ষ করেছেন খুব উজ্জল কোন আলোর ঝলকানি বা অন্ধকার কোন সুড়ঙ্গ থেকে আলোক উজ্জ্বল কোন টানেলে হেঁটে যাচ্ছেন। তবে International Association For Near-Death Studies (IANDS) এর তথ্যমতে বিজ্ঞানীরা এসব 'প্রায়-মৃত্যু অভিজ্ঞতা' লাভ করা ব্যক্তিদের উপর গবেষণা চালিয়ে একমত হয়েছেন যে জাতি, ধর্ম, দেশ নির্বিশেষে এসব মানুষের 'মৃত্যু অভিজ্ঞতা' প্রায় এক ও অভিন্ন।
বিশিষ্ট মৃত্যু বিশেষজ্ঞ নিউইয়র্ক শহরের উইল কর্নেল মেডিকেল সেন্টারের গবেষক ড. সাম পার্নিয়া ও তার সহকর্মীরা ইউরোপ, কানাডা ও ইউএসের ২৫টি মেডিকেল সেন্টারের ১৫০০ রোগী, যারা ‘কোমা অবস্থা’ থেকে ফিরে এসেছেন জীবনে, তাঁদের নিয়ে ৩ বছর ধরে করা একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছেন।
গবেষণায় দেখা যায় ১০ অথবা ২০ শতাংশ মানুষ যারা ‘কোমা অবস্থা’ থেকে ফিরে এসেছেন, কিছুক্ষণ বা ঘণ্টা খানিক পর তিনি চেতনা ফিরে পেয়ে কী দেখে এসেছেন সে বিষয়ে স্বকল্পিত বিবরণ দিতে পারেন। প্রায়-মৃত্যু থেকে ফিরে আসা রোগিদের অনেকে কোমা অবস্থায় 'নানামাত্রিক রঙের কারুকাজ' দেখেছেন বলে মনে করেন।
-শরীর থেকে আত্মা ছেড়ে যাওয়াঃ
অনেকে বর্ণনা করেছেন যে তাঁরা দেখতে পেয়েছেন তাঁদের দেহ থেকে আত্মা (soul) বা রূহ বের হয়ে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে এবং দেহ নিচে পড়ে আছে। অনেকে নিজেদের রূহ বা আত্মা কে দেহের পাশে দণ্ডায়মান দেখতে পান। এই সময় শরীরের কোন ব্যথা বা যন্ত্রণা আর আত্মা কে স্পর্শ করে না। কিন্তু তাঁর দেহের চারপাশ ঘিরে কী ঘটছে তা সে দেখতে পায়, এবং বুঝতে পারে যেমন- ডাক্তার- নার্সদের ছুটাছুটি, লোকজনের কথাবার্তা, দাফন-কাফন, আত্মীয় স্বজনের কান্না-কাটি সব। প্রফেসর Howard Storm ঠিক এমন এক অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন।
-কোন উজ্জ্বল টানেলের মধ্য দিয়ে ভ্রমণঃ
অনেক মৃত্যু পথযাত্রীই বলেছেন তাঁরা যেন একটি উজ্জ্বল টানেলের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। এটি খুব কমন অভিজ্ঞতা। প্রায় সব মৃত্যু পথযাত্রীরা ফিরে এসে এই অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। তাঁরা বলেছেন যে তাঁরা খুব দ্রুত গতিতে একটি আলোকোজ্জ্বল টানেলের ভেতর দিয়ে সামনের দিকে ছুটতে থাকেন কারো আহ্বানে, শঙ্কাহীন ভাবে। Betty Eadie নামে এক নারী মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার গল্প নিয়ে ১৯৯৪ সালে Embraced By The Light নামে একটি বই লেখেন যেখানে ঠিক এই ধরণের একটি অভিজ্ঞতাই উনি প্রকাশ করেছিলেন।
-সময় এবং স্থানের ধারণা পরিবর্তন হয়ে যাওয়াঃ
অনেকে জানিয়েছেন যে দেহ থেকে আত্মা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তাঁদের সময় এবং স্থান সংক্রান্ত পার্থিব ধারণা বদলে গেছে। তাঁদের আত্মা অতীত আর বর্তমানে সংঘটিত সব ঘটনা যুগপৎভাবে দেখতে পাচ্ছিল যেটি বেঁচে থাকা অবস্থায় সম্ভব না। Beverly Brodsky নামে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় প্রায় মৃত্যু থেকে ফিরে আসা এক ব্যক্তি ঠিক এমনি এক অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন 'Lessons from the Light: What We Can Learn from the Near-Death Experience' নামক বইয়ে।
-'লাইফ-রিভিউ' দেখাঃ
ফিরে আসা অনেকে বলেছেন যে, তাঁরা খুব স্বল্প সময়ে পৃথিবীতে কাটানো তাঁদের জীবনের সব মুহূর্তের একটি 'প্যানারোমিক' রিভিউ দেখেছেন, অনেকটা মুভি দেখার মতো। কৃত পাপ, পুণ্য, ভাল, মন্দ সব কাজের একটি সালতামামি উপস্থিত হয়েছিল তাঁদের সামনে।
মৃত আত্মীয়- স্বজনের সাথে সাক্ষাৎ:
কোমা বা ক্লিনিক্যাল ডেথ অবস্থা থেকে ফিরে আসা অনেকেই বলেছেন যে তাঁরা তাঁদের ইতোমধ্যে মৃত আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবের সাক্ষাৎ পেয়েছেন, কথা বলেছেন। মৃত ব্যক্তিরা তাঁদেরকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁরা পরস্পরকে চিনতে পেরেছেন এমনকি এমন অনেক মৃত ব্যক্তির সাথে তাঁদের দেখা হয়েছে যারা মারা গেছেন তাঁদের জন্মেরও আগে।
Laurelynn Martin একজন টেনিস খেলোয়াড় যিনি 'ক্লিনিক্যাল ডেথ' থেকে ফিরে এসেছিলেন তিনি তাঁর 'Searching for Home: A Personal Journey of Transformation and Healing After a Near-Death Experience' বইয়ে সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে বলেছেন যে, তিনি কোমায় থাকাকালীন তাঁর ৩০ বছর বয়সী এমন এক প্রিয়জনের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন যে কিনা এর ৭ বছর আগেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল !
-বর্তমান জীবনে ফিরে আসাঃ
কোমা বা কিনিক্যালি ডেড অবস্থা থেকে চেতনা ফিরে পেলে 'প্রায়-মৃত্যু' বা Near Death Experience এর অবসান ঘটে এবং মানুষ পার্থিব জীবনে প্রত্যাবর্তন করে। তখন মাঝখানের ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো কোন এক স্বপ্ন বা বিভ্রম বলে মনে হয়।
রূপান্তরিত জীবনঃ
যারা এ ধরণের 'প্রায়-মৃত্যু'র অভিজ্ঞতা পেয়েছে তাঁদের বেশিরভাগ বলেছেন এরপরে তাঁদের জীবনধারা ও জীবনদর্শন অনেকটাই বদলে গেছে। তাঁদের বেশিরভাগই আগের চেয়ে অনেক বেশি দয়ালু, সহানুভূতিসম্পন্ন, কম বৈষয়িক, এবং বেশি উদার হয়ে উঠেছেন- এমনটাই ভাষ্য Life After Life নামক বিখ্যাত বইয়ের লেখক Raymond A. Jr. Moody'র।
Near Death Experience এর প্রত্যক্ষদর্শী মানুষের কেসগুলোর ভিত্তিতে পরিচালিত গবেষণার সূত্র ধরেই ধারণা করা হয়েছিল হয়তো মৃত্যু পরবর্তী জীবন এর পক্ষে একটা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ খুজে পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, এগুলো নিছক-ই স্বপ্ন, বাস্তব কিছু না। বিশেষভাবে ইন্সট্রাকশন দেয়া হলে যে কেউ যেকোনো সময় এধরণের স্বপ্ন দেখে ফেলতে পারেন, এর সাথে মৃত্যুর কোনও সম্পর্ক নাই।
সে যা হোক, মৃত্যু কিংবা মৃত্যুর পরের জীবনের রহস্যপর্দা যতক্ষণ বিজ্ঞান তাঁর তত্ত্ব দিয়ে উন্মোচন না করতে পারছে, আমরা শুধু অপেক্ষাই করতে পারি। বৈজ্ঞানিক থিওরি কিংবা মৃত্যু- কোনটি যে কবে আসবে, কেউ কি আর নিশ্চিত জানে?
লেখকঃ প্রভাষক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Author Name

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.