সাময়িকী.কম
চলচ্চিত্রকার হিসেবে তারেক মাসুদ আর আমি যে পথ পেরিয়ে এসেছি, গত বছরখানেক ধরে আমরা নিবিড়ভাবে তার পুনর্মূল্যায়ন করছিলাম। চলচ্চিত্র যে একটি সংকটকাল পার হচ্ছে, তার নানা চিহ্ন চারপাশে ছড়িয়ে ছিল। যে দেশে একটি সংগতিপূর্ণ চলচ্চিত্রনীতি নেই, সেখানে ছবি বানানো যোগ্য কোনো কাজ বলে আর মনে হচ্ছিল না। এই সংকটের কারণ ও তার সমাধানের খোঁজে আমরা গবেষণা করতে শুরু করি। এই রচনা আমাদের নানা অনুসন্ধানের এক সংশ্লেষ। লেখাটি আমি উৎসর্গ করছি তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের উদ্দেশে: চলচ্চিত্রের জন্য যাঁরা আত্মনিবেদন করেছিলেন, চলচ্চিত্র নিয়ে যাঁদের ছিল বিরাট স্বপ্ন, চলচ্চিত্রের নতুন এক অভিযাত্রার পথে যাঁরা একত্রে মৃত্যুবরণ করেছেন।
বিগত বছরগুলোতে অনেক কিছুই আমরা ভাগ করে নিয়েছি। আমরা অনেকে নানা কিছু বদলানোর ও অর্জনের জন্য সংগ্রাম করেছি। ছবি বানাতে এসে শুরুতে আমরা অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু সম্প্রতি এর পরিমাণ এত বেড়ে গিয়েছিল যে মনে হচ্ছিল, কিছু সুনির্দিষ্ট কাঠামোগত সমস্যার সমাধান না হলে চলচ্চিত্রশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রচেষ্টাই নিরর্থক হয়ে হবে। কী অদ্ভুত এক শিল্পই না এই চলচ্চিত্র, যা গড়ে ওঠে একরাশ স্থিরচিত্রের অনুক্রমে এবং দৃষ্টিজড়তার কারণে চলিষ্ণু ছবি হিসেবে আমাদের সামনে হাজির হয়। প্রযুক্তির অভাবিত প্রয়োগ ও সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ায় এই ছলনাময় চলমান চিত্রমালা সম্মিলিত হয়ে একটি গল্পকে উপস্থাপন করে। এই শিল্পমাধ্যমটির সম্ভাবনা ঠিকঠাক ব্যবহার করতে হলে বিচিত্র মেধা এক হতে হয়। থাকতে হয় গল্প বলা ও চিত্রনাট্য লেখার ক্ষমতা, সংগীত ও ছন্দজ্ঞান, দৃশ্যায়নের ব্যতিক্রমী মেধা, প্রযুক্তিতে দখল, অভিনয় সম্পর্কে ধারণা ও শিল্পীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ, উচ্চমানের ব্যবস্থাপনা-দক্ষতা। আর বাংলাদেশের মতো জায়গায় আরও থাকতে হয় বিদঘুটে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পেরোনোর অসীম ধৈর্য। এসব তো চলচ্চিত্র তৈরির দিক মাত্র। আসল চ্যালেঞ্জ আসে এর পরে। চলচ্চিত্রটিকে নিয়ে যেতে হয় দর্শকের কাছে। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের প্রক্রিয়াটিই সবচেয়ে জটিল, যা বাংলাদেশে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। চলচ্চিত্র একটি জনসংস্কৃতির বিষয়। তাই দর্শকের কাছে উপস্থাপন করা না গেলে ছবি বানানোর আর কোনো অর্থই থাকে না।
চলচ্চিত্রই একমাত্র শিল্পকলা যা তৈরির জন্য একদিকে এর পেছনে একটি জোরালো অবকাঠামো ও শিল্প খাত থাকতে হয়, আবার মানুষের কাছে তা পৌঁছে দিতেও এর পেছনে থাকতে হয় আরেকটি শিল্প খাত। একদিকে উৎপাদনকাঠামো, অন্যদিকে পরিবেশন ও প্রদর্শনের কাঠামো। দুঃখের কথা, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন থেকে দ্বিতীয় কাঠামোটির কোনো অস্তিত্ব নেই। চলচ্চিত্র বাংলাদেশে না ‘শিল্প’, না ‘শিল্প খাত’।
বাংলাদেশে সব শিল্পের মধ্যে চলচ্চিত্র ‘নমঃশূদ্র’! এটি সব সময়ই সবচেয়ে কম গুরুত্ব পাওয়া একটি মাধ্যম। অন্য সব শিল্পমাধ্যমেরই—থিয়েটার, সংগীত, চিত্রকলা বা সাহিত্যের—নিজস্ব জাতীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু ‘জাতীয় চলচ্চিত্রকেন্দ্র’ বলে এখানে কিছু নেই। অযাচিত নিয়ন্ত্রণ ও সেন্সরশিপের প্রয়োজনেই হয়তো বাংলাদেশে চলচ্চিত্র এখনো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বদলে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। চলচ্চিত্রকে দেখা হয়ে থাকে প্রচারণার স্থূল মাধ্যম বা কুরুচিপূর্ণ নৃত্যগীত ও মারপিট-সংবলিত বিনোদনের প্রচেষ্টা হিসেবে। এমন ব্যতিক্রমী ঘটনা খুব কমই ঘটে, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে চলচ্চিত্র শিল্পও বটে। চলচ্চিত্রের জন্য এখানে ভব্য কোনো সমাধিক্ষেত্রও নেই। জাতীয় চলচ্চিত্র আর্কাইভ, যেটিকে অন্যত্র আমি ‘চলচ্চিত্রের বধ্যভূমি’ নাম দিয়েছি, চরম অব্যবস্থাপনা ও অসহযোগিতার কবলে পড়ে ৩০ বছর ধরে স্থবির হয়ে আছে। যেসব চলচ্চিত্র ও দলিল ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সেখানে সংরক্ষিত ছিল, তার সবই হয় হারিয়েছে, নয়তো ধ্বংস হয়েছে। যথাযথ প্রযুক্তিসুবিধাসহ একটি স্থায়ী ভবন না পেলে, মৌলিক চলচ্চিত্রবস্তুর কোনো সংরক্ষণশালা এটি হতেই পারে না।
যদি শিল্প খাতের কথা বলি, তাহলে চলচ্চিত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রে এফডিসি হোক বা প্রদর্শনের জন্য প্রেক্ষাগৃহই হোক, পশ্চাৎপদ নীতির কারণে সেসব প্রায় ধ্বংসের প্রান্তে গিয়ে ঠেকেছে। মুক্ত চলচ্চিত্রের অবস্থা এর চেয়ে কিছুটা ভালো। স্থানীয় প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে একটু ভালো মানের চলচ্চিত্র উপহার দেওয়ার আশায় লাল ফিতার দৌরাত্ম্য পেরিয়ে নির্মাতারা যাওয়ার চেষ্টা করেন দেশের বাইরে। ব্যয়বহুল সে প্রক্রিয়ার শেষে ফিরে এসে তাদের মুখোমুখি হতে হয় প্রদর্শন-সংকটের। মধ্যবিত্ত দর্শকদের ছবি দেখার মতো ভদ্রস্থ সিনেপ্লেক্স এই শহরে মাত্র একটি। তা ছাড়া এসব যৎসামান্য ভালো মানের চলচ্চিত্রগুলোও প্রিমিয়ার হচ্ছে টেলিভিশনে। বিজ্ঞাপনের আধিক্যে সেসব দেখাও দায়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এই সার্বিক দুরবস্থার কারণ খুঁজতে গেলে সব দিকেই তাকাতে হবে। রাষ্ট্রের বিপুল বিনিয়োগধন্য এফডিসি নামের প্রতিষ্ঠানটি কেন বাণিজ্যিক নির্মাতাদের বাকির সুবিধা দিচ্ছে? দেশি নির্মাতারা যখন ছবি বানিয়ে দর্শকদের চাহিদা মেটাতে পারছে না, তখন ভারতীয় সিনেমার ক্ষেত্রে কেন রক্ষণাত্মক নীতি অবলম্বন করা হচ্ছে? সবেধন নীলমণি শাকিব খান কিছু দিনের জন্য দর্শক টেনেছিলেন। কিন্তু এফডিসির একঘেয়ে পুনরাবৃত্তিতে তাঁকে নিয়েও দর্শকেরা এখন ক্লান্ত। শুধু মানের বিচারে নয়, সংখ্যায়ও এফডিসি-নির্ভর চলচ্চিত্র ভীষণভাবে পিছিয়ে পড়েছে। কুড়ি বছর আগেও প্রতিবছর এফডিসি থেকে ৮০ থেকে ১০০টি পর্যন্ত চলচ্চিত্র বেরোত। ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনো দেশের চেয়ে এ সংখ্যা ছিল সর্বাধিক। কিন্তু বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০-৪০টিতে। এর অনেকগুলোই আবার ৩৫ মিলিমিটারে বানানো নয়। ডিজিটাল ফরম্যাটে বানিয়ে রূপান্তর করা হচ্ছে ৩৫ মিলিমিটারে। বেশির ভাগ ‘বাণিজ্যিক’ ছবিই মুখ থুবড়ে পড়ছে বক্স অফিসে। এফডিসি অনেক আগেই দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার আখড়ায় পর্যবসিত হয়েছে। এর অধঃপতন আর রোধ করা যাচ্ছে না। এখানে সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে হলে একে বাকি দেওয়ার সুবিধা ও সুরক্ষা দেওয়ার নীতিটি আপাদমস্তক পর্যালোচনা করতে হবে। মজার ব্যাপার হলো, শুধু ভারতীয় হিন্দি ছবি নয়, হলিউড, কলকাতা ও পাকিস্তানের উর্দু ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেও ষাটের দশকে এখানে বহু ভালো ছবি নির্মিত হয়েছে। এ ধরনের সুরক্ষা কোনো চলচ্চিত্রশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। এখানে চলছে কিছু মানুষের কালোটাকা সাদা করার প্রক্রিয়া। আর তা চলছে এক দুর্নীতিগ্রস্ত সুবিধা প্রদানব্যবস্থার মাধ্যমে, যার টাকা খুব কম ক্ষেত্রেই আর ফেরত আসে।
এবার আসি এফডিসির বাইরে নির্মিত মুক্ত চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্র প্রযোজনায় টেলিভিশন চ্যানেল বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যুক্ত হওয়ার নতুন একটি ইতিবাচক ধারা শুরু হয়েছে। এই ছবিগুলো এফডিসি থেকে বাকির সুবিধা পায় না। তাই এসব ছবির কিছুটা মান-সচেতন নির্মাতারা ছবি বানান এই ব্যবস্থার বাইরে থেকে। বিদেশি ল্যাবরেটরি ব্যবহারের কারণে তাদের খরচও বেশি হয়। এগুলোর লাভের অঙ্কও তাই মোটা হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু প্রদর্শন খাতের সীমাবদ্ধতার কারণে দুর্ভাগ্যক্রমে এদের লাভ করার কোনো সুযোগই প্রায় থাকে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব ছবি অল্প কয়েকটি হলে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর দ্রুত বিনিয়োগের টাকা ওঠানোর জন্য টেলিভিশন ‘প্রিমিয়ার’ করা হয়। দ্রুত টাকা ফেরত পেতে ইচ্ছুক প্রযোজকের দিক থেকে এসব ছবিতে টাকা লগ্নি করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থাকে। যেসব নির্মাতা বড় বাজেটে ছবি করতে যান তাঁরা হয় অর্ধ-উন্মাদ, নয়তো তারা অনুদান বা সাদা হতে ইচ্ছুক কালোটাকার বিনিয়োগ পেয়েছেন। এই ‘বাজেট-প্রতিবন্ধকতা’ থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় প্রচলিত প্রেক্ষাগৃহগুলোর বাইরে বিকল্প প্রদর্শনব্যবস্থা। মুক্তির গান ও রানওয়েতে এটাই আমাদের অভিজ্ঞতা। এই ব্যবস্থায় প্রযোজক নিজেই পরিবেশক-প্রদর্শক। তিনি নিজেই বিজ্ঞাপন দেন, হল বুক করেন, টিকিট-পোস্টার ছাপেন, প্রচারের কাজ করেন। প্রদর্শন ও শব্দযন্ত্র ভাড়া করে জেলায় জেলায় ঘুরে নিজের ছবি দেখান। এতে দর্শকের সঙ্গে নির্মাতার সরাসরি আনন্দময় যোগাযোগ ঘটে বটে, তবে সৃজনশীল নির্মাতার জন্য এটি সময় ও শ্রমেরও অপচয়। এই সময়টা তিনি পরের ছবিটির জন্য দিতে পারতেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে প্রেক্ষাগৃহ ছিল এক হাজার ২০০টি। এখন টিকে আছে পাঁচ থেকে ছয় শ। অধিকাংশের অবস্থাই ভয়াবহ। টিনের চাল ভেঙে পড়েছে, কাঠের বেঞ্চি কোনোমতে টিকে আছে। স্থানীয়ভাবে বানানো প্রজেক্টরে চালানোর পর সপ্তাহ ঘোরার আগেই ছবির নতুন প্রিন্টের দশা বেহাল হয়ে পড়ে। সাদা রং করা সস্তা চট বা সুতির কাপড়ের পর্দার ওপর কয়েক যুগের ধূলি-ময়লা। সেই পর্দায় প্রজেক্টরের দুর্বল আলোয় যা দেখা যায়, তা নিছক ক্ষীণ ছায়া। এফডিসির দুর্বল ডাবিংয়ের ওপর হলের মারাত্মক শব্দব্যবস্থার কারণে আওয়াজেরও বড় দুরবস্থা। মানুষের কণ্ঠস্বর সেখানে কাকের মতো শোনায়। ৭০-৮০টি প্রেক্ষাগৃহের অবস্থা কিছুটা ভালো। ২০-৩০টি হয়তো মধ্যবিত্ত দর্শকের দেখার উপযোগী। আর হাতে গোনা মাত্র কয়েকটির রয়েছে ভালো মানের প্রদর্শন ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। বিশ্বব্যাপী মাল্টিপ্লেক্স গড়ে ওঠার প্রবণতার বাইরে ঢাকাই একমাত্র শহর, যেখানে মাত্র একটি মাল্টিপ্লেক্স। ঢাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, এমনকি ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী বা উত্তরার মতো উত্তম আবাসিক এলাকাতে কোনো প্রেক্ষাগৃহই নেই। এটা স্পষ্ট, চলচ্চিত্রের আসল পৃষ্ঠপোষক যে মধ্যবিত্ত, তারা প্রেক্ষাগৃহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
প্রেক্ষাগৃহই সেই বাজার, যেখানে চলচ্চিত্র বিক্রি হয়ে থাকে। তাই একের পর এক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে প্রদর্শন ও পরিবেশনা-ব্যবস্থা যেমন আজকে ভেঙে পড়েছে, সেভাবে এই শিল্পও একদিন বিলীন হয়ে যাবে। প্রেক্ষাগৃহ এ শিল্পের সেই অংশ, যার সঙ্গে জনগণের পাশাপাশি সরকারও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই চলচ্চিত্রশিল্পকে বাঁচাতে হলে আগে প্রেক্ষাগৃহকে বাঁচাতে হবে।
রানওয়ে প্রদর্শনের সময় আমরা দেখেছি, দেশে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই একটি করে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেশব্যাপী। ডিসেম্বর ২০১০ থেকে মার্চ ২০১১ পর্যন্ত তারেক মাসুদ ১২টি জেলায় এই বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রেক্ষাগৃহের প্রামাণ্যচিত্র ধারণ করেছে। প্রেক্ষাগৃহের মালিক, কর্মচারী ও দর্শকের সঙ্গে কথা বলেছে। একদল বলেছে দুর্বল চলচ্চিত্রের কথা, আরেক দল প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশের কথা। ব্রিটিশ আমল থেকেই টিকিটপ্রতি আদায় করা ১৫০ শতাংশের মাত্রাতিরিক্ত করই ছিল প্রদর্শন খাত বিকাশের প্রথম বাধা। ১৯৯০-এর শেষ দিকে এটি কমিয়ে ১০০ শতাংশ করা হলেও পৃথিবীতে করের এই হারই সর্বোচ্চ। এ কারণে পরবর্তী ছবির প্রদর্শনে বিনিয়োগ করার মতো খুব সামান্য টাকাই প্রেক্ষাগৃহের মালিকের কাছে থাকে। প্রযোজকের লাভ দূরে থাক, লগ্নির টাকা তুলে আনাই মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া ঢাকার বাইরের প্রেক্ষাগৃহগুলোকে ছবির বুকিং দেওয়ার জন্য ‘মিনিমাম গ্যারান্টি’ (এমজি) হিসেবে নির্দিষ্ট অঙ্কের জামানত দিতে হয়। প্রযোজক ও পরিবেশক মনে করেন, এ ছাড়া লগ্নি তুলে আনার যথার্থ কোনো পদ্ধতি নেই। কারণ, হলগুলোর হিসাবরক্ষণের অব্যবস্থাপনা ও অসততার ভয়ে তাদের ওপর বিশ্বাস রাখা যায় না। এমজি ব্যবস্থাও এই খাতটিকে রক্তশূন্য করে দিয়েছে। এই ব্যবস্থা চলতে থাকায় বাইরের ছোট হলগুলো বড় অঙ্ক দিয়ে ভালো ছবি দেখানোর সাহস করতে পারছে না। তারা নিয়মিত দেখিয়ে চলেছে পুরোনো ও সস্তা ছবি।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর ভারতীয় ছবি এ দেশে নিষিদ্ধ করা হয়। আদিতে এর কারণ ছিল রাজনৈতিক, কিন্তু স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্রকে সুরক্ষা দেওয়ার নামে এই ব্যবস্থা বলবৎ থেকে যায়। ভাবনা যতই মহৎ হোক, এই নীতিটিও পরে বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। কারণ, হিন্দি ছবি পাওয়া যায় সবখানেই—ডিভিডি, স্যাটেলাইট চ্যানেল, কম্পিউটার, এমনকি মুঠোফোনে। সিনেমার একটি টিকিটের দামে জনপ্রিয় হিন্দি ছবির সিডি কেনা সম্ভব। এতে প্রেক্ষাগৃহ বঞ্চিত হচ্ছে ব্যবসা থেকে, সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল রাজস্ব থেকে। আমাদের দেশ যথেষ্ট পরিমাণে মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র উৎপাদন করতে সমর্থ হলে দৃশ্যটা অন্য রকম হতো। কিন্তু তার বদলে কী হচ্ছে, তা আমরা সবাই জানি।
প্রশ্ন হতে পারে, এত দুশ্চিন্তা কিসের? চলচ্চিত্রের মান যদি খারাপ হয়ে যায়, যদি এফডিসিসহ সব প্রেক্ষাগৃহ ধসে পড়ে, যদি মুক্ত ধারার ছবিও আর দেখার মতো না হয়, তাতে সমস্যা কী? সব শেষ হয়ে যাক। আমরা মুঠোফোনের ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি বানিয়ে ‘ইউটিউবে’ তুলে দেব। মানুষ ঘরে বসে ইন্টারনেটে দেখে নেবে। কিন্তু আরও বড় একটি পটভূমি আমাদের সামনে আছে। প্রথমত, সমস্ত সমস্যার পরও এই শিল্পের উৎপাদন ও প্রদর্শন খাতে জড়িয়ে আছেন অজস্র কর্মী ও তাঁদের পরিবার। চলচ্চিত্রকে ঘিরে পরোক্ষভাবে গড়ে ওঠা আরও অসংখ্য পেশায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আছেন আরও লাখ লাখ। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে এটি অর্থনীতির অপার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর সর্বত্র বিনোদনবঞ্চিত মানুষের জন্য চলচ্চিত্রই বিনোদনের মুখ্য মাধ্যম। বিশেষত, রাজধানীর বাইরে এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এলাকায় চলচ্চিত্রই জনসংস্কৃতির সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যম। এ ছাড়া চলচ্চিত্র তরুণসমাজকে মন্দ কাজ থেকে সরিয়ে সুস্থ অবসরযাপনেরও সুযোগ করে দেয়। ১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লবের পর ইরান সরকার নিজ উদ্যোগে সারা দেশে ৫০০টি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করে।
চলচ্চিত্রচর্চা স্বাস্থ্যকর হলে তা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সামাজিক মূল্যবোধ ও জাতীয় পরিচয় রক্ষা করতে পারে। লক্ষ করার বিষয়, ভারতের মতো নানা ভাষা, জাতি ও সংস্কৃতিতে বিভক্ত একটি দেশে কয়েক দশক ধরে বলিউডি ছবি কীভাবে একটি জাতীয় পরিচয় গড়ে তুলেছে। এ ছাড়া অন্যায়ের চিত্র তুলে ধরে, সহিষ্ণুতাকে উৎসাহিত করে এবং বৈচিত্র্যকে উদ্যাপন করে চলচ্চিত্র একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। সুষ্ঠুভাবে পুনরুজ্জীবিত করতে পারলে সরকার যে বিপুল রাজস্ব এখান থেকে পেতে শুরু করবে, সে তো বলাই বাহুল্য।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, মৃতপ্রায় এই শিল্প খাতটিকে কীভাবে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব? এই কাজটি ঘটানোর মতো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা আমরা কোথায় পাব? সত্যি বলতে কি, আমাদের আশপাশের দেশগুলো এমন বহু কিছু করেছে, যা মডেল হিসেবে নেওয়া যায়। দুঃখজনকভাবে চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নতির জন্য কিছু না করার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র পিছিয়ে পড়া দেশ।
১০ বছর আগেও ভারতের অনেক রাজ্যের প্রেক্ষাগৃহের টিকিটের ওপর বিনোদন কর ছিল ১৫০ শতাংশ। চলচ্চিত্রকে যে সময় অভিজাতদের চিত্তবিনোদন বলে ভাবা হতো, এটা ছিল সেই ব্রিটিশ আমলের আইন। ১৯১৮ সালের পুরোনো লাইসেন্স দেওয়ার আইনে নতুন প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ ছিল সেখানে অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার, যা বাংলাদেশে এখনো আছে। চলচ্চিত্রে তখন অধিকাংশ বিনিয়োগ আসত মাফিয়া ও কালোটাকার মালিকদের কাছ থেকে। দুর্নীতি ও হিসাবনিকাশের অব্যবস্থাপনার কারণে প্রযোজক ও পরিবেশকেরা অল্প টাকাই ফিরে পেতেন। বাংলাদেশে এ দৃশ্য এখনো অটুট। ১৯৮০ সালের পর থেকে প্রেক্ষাগৃহগুলো ব্যবসা হারাতে শুরু করে।
২০০১ সালে ভারতে সবকিছু বদলে যায়। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের চাপে সরকার চলচ্চিত্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে শিল্প খাতের মর্যাদা দেয়। সহজ করা হয় সরকারি নীতিমালা। কমিয়ে দেওয়া হয় কর। এই খাতে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করা হয় ব্যাংকগুলোকে। মাফিয়ারা পিছু হটতে শুরু করে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আগ্রহী ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করার জন্য সরকার নতুন মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণের ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের কর অবকাশ ঘোষণা করে। এ ছাড়া ভূমি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির মতো অন্যান্য প্রাসঙ্গিক করও কমিয়ে দেয়। টিকিটের ওপর কর রাজ্যভেদে ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশে নামিয়ে আনে। তামিলনাড়ুতে এ হার মাত্র ১৫ শতাংশ। হিন্দির বাইরে প্রাদেশিক চলচ্চিত্রকে উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। যেমন, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ছবিকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য হিন্দি ছবির ওপর উচ্চহারে কর প্রয়োগ করা হয়। বাংলা ছবির ক্ষেত্রে তা হয় নামেমাত্র।
কয়েক বছরের মধ্যে ভারতে চলচ্চিত্রের নাটকীয় উত্থান ঘটে। সেখানে সিনেপ্লেক্স ও মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণের হিড়িক পড়ে যায়। ২০১০ সালের মধ্যে সারা ভারতে প্রায় ৭০০ মাল্টিপ্লেক্স নির্মিত হয়। এক হিসাবে দেখা যায়, ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ দর্শকের মারফতই ১৩ হাজার প্রেক্ষাগৃহের মাধ্যমে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ আয় চলে আসে। মাল্টিপ্লেক্সগুলো উচ্চ প্রযুক্তির প্রদর্শনব্যবস্থা চালু করে। এর ফলে একজন প্রযোজক একটি ছবি একসঙ্গে অনেক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিতে খুব অল্প খরচেই অসংখ্য প্রিন্ট করতে পারেন। মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে টিকিট বিক্রয় ও হিসাবরক্ষণ-প্রক্রিয়া চালু হওয়ায় প্রযোজকের লভ্যাংশ ফেরত পাওয়া সহজ হয়ে যায়। এ ছাড়া মানসম্মত মাল্টিপ্লেক্স গড়ে ওঠায় রুচিমান দর্শকেরা যেমন আকৃষ্ট হয়; ছবির গল্প, চিত্রনাট্য ও শৈলীতেও তেমনই আসে বৈচিত্র্য। মাল্টিপ্লেক্সকে ঘিরে শপিংমল ও রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠায় তা হয়ে ওঠে ব্যবসারও প্রাণকেন্দ্র। বিপুল করের বোঝা নিয়ে একটিমাত্র পর্দায় ছবি দেখানোর বদলে একই স্থানে গড়ে ওঠে সীমিত আসনের কয়েকটি পর্দা। এতে করের পরিমাণও হয় সীমিত। সব মিলিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে নতুন জাগরণ ঘটে। প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে মাল্টিপ্লেক্স ফিল্ম হওয়ার কারণে ভারতীয় চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও জায়গা করে নেয়। সরকারি রাজস্বের খাতায় যুক্ত হতে থাকে বৃহৎ অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা।
শুধু ভারত নয়, চলচ্চিত্র খাতের সংস্কার পাকিস্তানের ছবিও পাল্টে দিয়েছে। তাদের স্বর্ণযুগ ছিল ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশক। কিন্তু এই শতকের গোড়ায় এসে তাদের চলচ্চিত্রশিল্পও প্রায় ধসে পড়ে। ১৯৯০ সালে যেখানে ছিল ৭৫০টি প্রেক্ষাগৃহ, ২০০২ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১৭৫টিতে। তখন চলচ্চিত্রকে পুনরুদ্ধার করতে এবং মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণকে উৎসাহ দিতে কর ১৫০ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। প্রথম মাল্টিপ্লেক্স নির্মিত হয় ২০০২ সালে, করাচিতে। বছর খানেকের মধ্যে গড়ে ওঠে আরও ডজন খানেক। ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহগুলোকে বিনোদন কর দেওয়া থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রাখা হয়। ২০০৮ সালে এসে পাকিস্তান সরকার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়। ১৯৬৫ সালে নেওয়া ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধের আইনটি তারা বাতিল করে দেয়। এর ফলে একই বছর পাকিস্তানি ছবি খোদা কে লিয়ে ভারতের শতাধিক প্রেক্ষাগৃহে সগৌরবে মুক্তি পায় এবং কল্পনাতীত ব্যবসা করে।
শ্রীলঙ্কায় ২০০৭ সালের বাজেটে চলচ্চিত্রের জন্য বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। নতুন প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের জন্য সেখানে ১০ বছর কর মওকুফ করা হয়। আধুনিক প্রযুক্তিসহ প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণে উৎসাহ দেওয়ার জন্য নীতিমালাও করা হয়। সে নীতিমালা অনুসারে পুরোনো প্রেক্ষাগৃহের উন্নয়নের জন্য পাঁচ বছর কর মওকুফ করা হয়। কর কমানো হয় যন্ত্রপাতি আমদানিতে, কমানো হয় ল্যাব চার্জ, সহজ করা হয় পরিবেশনার পদ্ধতি। কর হিসেবে পাওয়া রাজস্বকে একই খাতে পুনর্বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিষ্ঠা করা হয় ফিল্ম সিটি ও ফিল্ম ইনস্টিটিউট।
নেপালের মতো ছোট্ট চলচ্চিত্র খাতও সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট মনোযোগ পেয়েছে। আধুনিক প্রদর্শন পদ্ধতিসহ মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণকে উৎসাহিত করার জন্য কর মওকুফ করার পাশাপাশি দেওয়া হয়েছে নানা সহযোগিতা। নেওয়া হয়েছে ‘টু টায়ার’ করপদ্ধতি। সেখানে হিন্দিসহ বিদেশি চলচ্চিত্রের ওপর করের হার ২৫ শতাংশ, কিন্তু দেশীয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তা মাত্র ১৩ শতাংশ। কাঠমান্ডুর মতো মাত্র ১০ লাখ অধিবাসীর শহরে গড়ে উঠেছে আটটি আধুনিক মাল্টিপ্লেক্স, নির্মাণাধীন রয়েছে ১৯টি নতুন প্রেক্ষাগৃহ।
এসব সাফল্য থেকে দেখা যায়, সংস্কার কঠিন ব্যাপার নয়, দরকার শুধু সরকারের সামান্য সদিচ্ছা। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের প্রক্রিয়াটি আধুনিক করে তুললেই বর্তমান সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। প্রয়োজনীয় স্থানে কর মওকুফ করে ও কমিয়ে, নতুন মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণে ও পুরোনো প্রেক্ষাগৃহ আধুনিকীকরণে উৎসাহ দিয়ে মৃতপ্রায় চলচ্চিত্র খাতকে বাঁচিয়ে তোলা যায়। বিদেশি ছবিতে উচ্চহারে কর আরোপ করে, দেশীয় ছবিতে কর রেয়াত দিয়ে এবং প্রাপ্ত রাজস্ব পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে খুব সহজেই সফলতা পাওয়া সম্ভব। এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব তুলে ধরা হলো:
আধুনিক প্রযুক্তি ও টিকিট বিক্রির সুবিধাসহ মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণের ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের জন্য কর মওকুফ করা।
পুরোনো প্রেক্ষাগৃহের মানসম্পন্ন সংস্কারের জন্য কমপক্ষে তিন বছরের জন্য কর মওকুফ করা।
প্রেক্ষাগৃহের জন্য অবকাঠামোগত কর—যেমন জমি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি—কমানো।
ডিজিটাল প্রজেকশন ও স্যারাউন্ড সাউন্ডকে উৎসাহিত করার উদ্যোগ নেওয়া।
বিদেশি চলচ্চিত্রের ওপর উচ্চহারে এবং দেশীয় চলচ্চিত্রের ওপর স্বল্পহারে কর আরোপ করা। বাংলাদেশ-ভারত চলচ্চিত্র আদান-প্রদানের জন্য নীতিগত চুক্তির উদ্যোগ নেওয়া।
নতুন প্রেক্ষাগৃহ বা মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণে উৎসাহ দিতে লাইসেন্স দেওয়ার পদ্ধতি সহজ করা। রাজধানীর বাইরে প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করা।
প্রেক্ষাগৃহগুলোর পাঁচ ও তিন বছর মেয়াদি কর অবকাশের সময় পার হওয়ার পর বিদেশি ছবিতে ৫০ শতাংশ এবং দেশীয় ছবিতে ১০ শতাংশ হারে ‘টু-টায়ার’ পদ্ধতির কর প্রয়োগ।
কর মওকুফ করা বা কমানোর সুবাদে টিকিটের দাম কমানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা। পরিবেশকের পক্ষ থেকে ‘মিনিমাম গ্যারান্টি’ পদ্ধতি তুলে নেওয়া।
শিশুতোষ চলচ্চিত্রের জন্য কর সম্পূর্ণভাবে মওকুফ করা।
সংস্কারের উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র খাতও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। ছবি প্রদর্শনের জন্য মানসম্পন্ন মাল্টিপ্লেক্স পেলে প্রযোজকেরা বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন, চলচ্চিত্রের মানও বাড়বে। তখন মধ্যবিত্ত দর্শকদের আবার চলচ্চিত্রের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পাওয়া যাবে। সুষ্ঠু প্রদর্শন-প্রক্রিয়া চালু হলে ব্যবসা পরিচালনা করতে পরিবেশনা প্রতিষ্ঠানগুলো আগ্রহী হবে। নির্মাতারাও ভালো বাজেটে ভালো ছবি বানাতে উৎসাহিত হবেন। কিন্তু এসব কেবল সংস্কার-প্রক্রিয়ার সূচনা। এফডিসিকে কার্যকর করা, সেন্সর বোর্ডকে যুগোপযোগী করা, চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সহজ করার জন্য আরও বহু সংস্কারের প্রয়োজন হবে। তবে আসল সূচনাটা হবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করার এবং সবার সঙ্গে তা ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যমে, যাতে আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে বাংলাদেশে পুনরুজ্জীবিত চলচ্চিত্রশিল্পের দিকে এগিয়ে যেতে পারি।
দৃক-এর ২২ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘দ্য স্টেট অব মুভিং ইমেজ: বাংলাদেশ’ শিরোনামে মূল প্রবন্ধ হিসেবে পঠিত
চলচ্চিত্রই একমাত্র শিল্পকলা যা তৈরির জন্য একদিকে এর পেছনে একটি জোরালো অবকাঠামো ও শিল্প খাত থাকতে হয়, আবার মানুষের কাছে তা পৌঁছে দিতেও এর পেছনে থাকতে হয় আরেকটি শিল্প খাত। একদিকে উৎপাদনকাঠামো, অন্যদিকে পরিবেশন ও প্রদর্শনের কাঠামো। দুঃখের কথা, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন থেকে দ্বিতীয় কাঠামোটির কোনো অস্তিত্ব নেই। চলচ্চিত্র বাংলাদেশে না ‘শিল্প’, না ‘শিল্প খাত’।
বাংলাদেশে সব শিল্পের মধ্যে চলচ্চিত্র ‘নমঃশূদ্র’! এটি সব সময়ই সবচেয়ে কম গুরুত্ব পাওয়া একটি মাধ্যম। অন্য সব শিল্পমাধ্যমেরই—থিয়েটার, সংগীত, চিত্রকলা বা সাহিত্যের—নিজস্ব জাতীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু ‘জাতীয় চলচ্চিত্রকেন্দ্র’ বলে এখানে কিছু নেই। অযাচিত নিয়ন্ত্রণ ও সেন্সরশিপের প্রয়োজনেই হয়তো বাংলাদেশে চলচ্চিত্র এখনো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বদলে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। চলচ্চিত্রকে দেখা হয়ে থাকে প্রচারণার স্থূল মাধ্যম বা কুরুচিপূর্ণ নৃত্যগীত ও মারপিট-সংবলিত বিনোদনের প্রচেষ্টা হিসেবে। এমন ব্যতিক্রমী ঘটনা খুব কমই ঘটে, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে চলচ্চিত্র শিল্পও বটে। চলচ্চিত্রের জন্য এখানে ভব্য কোনো সমাধিক্ষেত্রও নেই। জাতীয় চলচ্চিত্র আর্কাইভ, যেটিকে অন্যত্র আমি ‘চলচ্চিত্রের বধ্যভূমি’ নাম দিয়েছি, চরম অব্যবস্থাপনা ও অসহযোগিতার কবলে পড়ে ৩০ বছর ধরে স্থবির হয়ে আছে। যেসব চলচ্চিত্র ও দলিল ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সেখানে সংরক্ষিত ছিল, তার সবই হয় হারিয়েছে, নয়তো ধ্বংস হয়েছে। যথাযথ প্রযুক্তিসুবিধাসহ একটি স্থায়ী ভবন না পেলে, মৌলিক চলচ্চিত্রবস্তুর কোনো সংরক্ষণশালা এটি হতেই পারে না।
যদি শিল্প খাতের কথা বলি, তাহলে চলচ্চিত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রে এফডিসি হোক বা প্রদর্শনের জন্য প্রেক্ষাগৃহই হোক, পশ্চাৎপদ নীতির কারণে সেসব প্রায় ধ্বংসের প্রান্তে গিয়ে ঠেকেছে। মুক্ত চলচ্চিত্রের অবস্থা এর চেয়ে কিছুটা ভালো। স্থানীয় প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে একটু ভালো মানের চলচ্চিত্র উপহার দেওয়ার আশায় লাল ফিতার দৌরাত্ম্য পেরিয়ে নির্মাতারা যাওয়ার চেষ্টা করেন দেশের বাইরে। ব্যয়বহুল সে প্রক্রিয়ার শেষে ফিরে এসে তাদের মুখোমুখি হতে হয় প্রদর্শন-সংকটের। মধ্যবিত্ত দর্শকদের ছবি দেখার মতো ভদ্রস্থ সিনেপ্লেক্স এই শহরে মাত্র একটি। তা ছাড়া এসব যৎসামান্য ভালো মানের চলচ্চিত্রগুলোও প্রিমিয়ার হচ্ছে টেলিভিশনে। বিজ্ঞাপনের আধিক্যে সেসব দেখাও দায়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এই সার্বিক দুরবস্থার কারণ খুঁজতে গেলে সব দিকেই তাকাতে হবে। রাষ্ট্রের বিপুল বিনিয়োগধন্য এফডিসি নামের প্রতিষ্ঠানটি কেন বাণিজ্যিক নির্মাতাদের বাকির সুবিধা দিচ্ছে? দেশি নির্মাতারা যখন ছবি বানিয়ে দর্শকদের চাহিদা মেটাতে পারছে না, তখন ভারতীয় সিনেমার ক্ষেত্রে কেন রক্ষণাত্মক নীতি অবলম্বন করা হচ্ছে? সবেধন নীলমণি শাকিব খান কিছু দিনের জন্য দর্শক টেনেছিলেন। কিন্তু এফডিসির একঘেয়ে পুনরাবৃত্তিতে তাঁকে নিয়েও দর্শকেরা এখন ক্লান্ত। শুধু মানের বিচারে নয়, সংখ্যায়ও এফডিসি-নির্ভর চলচ্চিত্র ভীষণভাবে পিছিয়ে পড়েছে। কুড়ি বছর আগেও প্রতিবছর এফডিসি থেকে ৮০ থেকে ১০০টি পর্যন্ত চলচ্চিত্র বেরোত। ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনো দেশের চেয়ে এ সংখ্যা ছিল সর্বাধিক। কিন্তু বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০-৪০টিতে। এর অনেকগুলোই আবার ৩৫ মিলিমিটারে বানানো নয়। ডিজিটাল ফরম্যাটে বানিয়ে রূপান্তর করা হচ্ছে ৩৫ মিলিমিটারে। বেশির ভাগ ‘বাণিজ্যিক’ ছবিই মুখ থুবড়ে পড়ছে বক্স অফিসে। এফডিসি অনেক আগেই দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার আখড়ায় পর্যবসিত হয়েছে। এর অধঃপতন আর রোধ করা যাচ্ছে না। এখানে সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে হলে একে বাকি দেওয়ার সুবিধা ও সুরক্ষা দেওয়ার নীতিটি আপাদমস্তক পর্যালোচনা করতে হবে। মজার ব্যাপার হলো, শুধু ভারতীয় হিন্দি ছবি নয়, হলিউড, কলকাতা ও পাকিস্তানের উর্দু ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেও ষাটের দশকে এখানে বহু ভালো ছবি নির্মিত হয়েছে। এ ধরনের সুরক্ষা কোনো চলচ্চিত্রশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। এখানে চলছে কিছু মানুষের কালোটাকা সাদা করার প্রক্রিয়া। আর তা চলছে এক দুর্নীতিগ্রস্ত সুবিধা প্রদানব্যবস্থার মাধ্যমে, যার টাকা খুব কম ক্ষেত্রেই আর ফেরত আসে।
এবার আসি এফডিসির বাইরে নির্মিত মুক্ত চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্র প্রযোজনায় টেলিভিশন চ্যানেল বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যুক্ত হওয়ার নতুন একটি ইতিবাচক ধারা শুরু হয়েছে। এই ছবিগুলো এফডিসি থেকে বাকির সুবিধা পায় না। তাই এসব ছবির কিছুটা মান-সচেতন নির্মাতারা ছবি বানান এই ব্যবস্থার বাইরে থেকে। বিদেশি ল্যাবরেটরি ব্যবহারের কারণে তাদের খরচও বেশি হয়। এগুলোর লাভের অঙ্কও তাই মোটা হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু প্রদর্শন খাতের সীমাবদ্ধতার কারণে দুর্ভাগ্যক্রমে এদের লাভ করার কোনো সুযোগই প্রায় থাকে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব ছবি অল্প কয়েকটি হলে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর দ্রুত বিনিয়োগের টাকা ওঠানোর জন্য টেলিভিশন ‘প্রিমিয়ার’ করা হয়। দ্রুত টাকা ফেরত পেতে ইচ্ছুক প্রযোজকের দিক থেকে এসব ছবিতে টাকা লগ্নি করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থাকে। যেসব নির্মাতা বড় বাজেটে ছবি করতে যান তাঁরা হয় অর্ধ-উন্মাদ, নয়তো তারা অনুদান বা সাদা হতে ইচ্ছুক কালোটাকার বিনিয়োগ পেয়েছেন। এই ‘বাজেট-প্রতিবন্ধকতা’ থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় প্রচলিত প্রেক্ষাগৃহগুলোর বাইরে বিকল্প প্রদর্শনব্যবস্থা। মুক্তির গান ও রানওয়েতে এটাই আমাদের অভিজ্ঞতা। এই ব্যবস্থায় প্রযোজক নিজেই পরিবেশক-প্রদর্শক। তিনি নিজেই বিজ্ঞাপন দেন, হল বুক করেন, টিকিট-পোস্টার ছাপেন, প্রচারের কাজ করেন। প্রদর্শন ও শব্দযন্ত্র ভাড়া করে জেলায় জেলায় ঘুরে নিজের ছবি দেখান। এতে দর্শকের সঙ্গে নির্মাতার সরাসরি আনন্দময় যোগাযোগ ঘটে বটে, তবে সৃজনশীল নির্মাতার জন্য এটি সময় ও শ্রমেরও অপচয়। এই সময়টা তিনি পরের ছবিটির জন্য দিতে পারতেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে প্রেক্ষাগৃহ ছিল এক হাজার ২০০টি। এখন টিকে আছে পাঁচ থেকে ছয় শ। অধিকাংশের অবস্থাই ভয়াবহ। টিনের চাল ভেঙে পড়েছে, কাঠের বেঞ্চি কোনোমতে টিকে আছে। স্থানীয়ভাবে বানানো প্রজেক্টরে চালানোর পর সপ্তাহ ঘোরার আগেই ছবির নতুন প্রিন্টের দশা বেহাল হয়ে পড়ে। সাদা রং করা সস্তা চট বা সুতির কাপড়ের পর্দার ওপর কয়েক যুগের ধূলি-ময়লা। সেই পর্দায় প্রজেক্টরের দুর্বল আলোয় যা দেখা যায়, তা নিছক ক্ষীণ ছায়া। এফডিসির দুর্বল ডাবিংয়ের ওপর হলের মারাত্মক শব্দব্যবস্থার কারণে আওয়াজেরও বড় দুরবস্থা। মানুষের কণ্ঠস্বর সেখানে কাকের মতো শোনায়। ৭০-৮০টি প্রেক্ষাগৃহের অবস্থা কিছুটা ভালো। ২০-৩০টি হয়তো মধ্যবিত্ত দর্শকের দেখার উপযোগী। আর হাতে গোনা মাত্র কয়েকটির রয়েছে ভালো মানের প্রদর্শন ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। বিশ্বব্যাপী মাল্টিপ্লেক্স গড়ে ওঠার প্রবণতার বাইরে ঢাকাই একমাত্র শহর, যেখানে মাত্র একটি মাল্টিপ্লেক্স। ঢাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, এমনকি ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী বা উত্তরার মতো উত্তম আবাসিক এলাকাতে কোনো প্রেক্ষাগৃহই নেই। এটা স্পষ্ট, চলচ্চিত্রের আসল পৃষ্ঠপোষক যে মধ্যবিত্ত, তারা প্রেক্ষাগৃহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
প্রেক্ষাগৃহই সেই বাজার, যেখানে চলচ্চিত্র বিক্রি হয়ে থাকে। তাই একের পর এক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে প্রদর্শন ও পরিবেশনা-ব্যবস্থা যেমন আজকে ভেঙে পড়েছে, সেভাবে এই শিল্পও একদিন বিলীন হয়ে যাবে। প্রেক্ষাগৃহ এ শিল্পের সেই অংশ, যার সঙ্গে জনগণের পাশাপাশি সরকারও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই চলচ্চিত্রশিল্পকে বাঁচাতে হলে আগে প্রেক্ষাগৃহকে বাঁচাতে হবে।
রানওয়ে প্রদর্শনের সময় আমরা দেখেছি, দেশে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই একটি করে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেশব্যাপী। ডিসেম্বর ২০১০ থেকে মার্চ ২০১১ পর্যন্ত তারেক মাসুদ ১২টি জেলায় এই বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রেক্ষাগৃহের প্রামাণ্যচিত্র ধারণ করেছে। প্রেক্ষাগৃহের মালিক, কর্মচারী ও দর্শকের সঙ্গে কথা বলেছে। একদল বলেছে দুর্বল চলচ্চিত্রের কথা, আরেক দল প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশের কথা। ব্রিটিশ আমল থেকেই টিকিটপ্রতি আদায় করা ১৫০ শতাংশের মাত্রাতিরিক্ত করই ছিল প্রদর্শন খাত বিকাশের প্রথম বাধা। ১৯৯০-এর শেষ দিকে এটি কমিয়ে ১০০ শতাংশ করা হলেও পৃথিবীতে করের এই হারই সর্বোচ্চ। এ কারণে পরবর্তী ছবির প্রদর্শনে বিনিয়োগ করার মতো খুব সামান্য টাকাই প্রেক্ষাগৃহের মালিকের কাছে থাকে। প্রযোজকের লাভ দূরে থাক, লগ্নির টাকা তুলে আনাই মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া ঢাকার বাইরের প্রেক্ষাগৃহগুলোকে ছবির বুকিং দেওয়ার জন্য ‘মিনিমাম গ্যারান্টি’ (এমজি) হিসেবে নির্দিষ্ট অঙ্কের জামানত দিতে হয়। প্রযোজক ও পরিবেশক মনে করেন, এ ছাড়া লগ্নি তুলে আনার যথার্থ কোনো পদ্ধতি নেই। কারণ, হলগুলোর হিসাবরক্ষণের অব্যবস্থাপনা ও অসততার ভয়ে তাদের ওপর বিশ্বাস রাখা যায় না। এমজি ব্যবস্থাও এই খাতটিকে রক্তশূন্য করে দিয়েছে। এই ব্যবস্থা চলতে থাকায় বাইরের ছোট হলগুলো বড় অঙ্ক দিয়ে ভালো ছবি দেখানোর সাহস করতে পারছে না। তারা নিয়মিত দেখিয়ে চলেছে পুরোনো ও সস্তা ছবি।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর ভারতীয় ছবি এ দেশে নিষিদ্ধ করা হয়। আদিতে এর কারণ ছিল রাজনৈতিক, কিন্তু স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্রকে সুরক্ষা দেওয়ার নামে এই ব্যবস্থা বলবৎ থেকে যায়। ভাবনা যতই মহৎ হোক, এই নীতিটিও পরে বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। কারণ, হিন্দি ছবি পাওয়া যায় সবখানেই—ডিভিডি, স্যাটেলাইট চ্যানেল, কম্পিউটার, এমনকি মুঠোফোনে। সিনেমার একটি টিকিটের দামে জনপ্রিয় হিন্দি ছবির সিডি কেনা সম্ভব। এতে প্রেক্ষাগৃহ বঞ্চিত হচ্ছে ব্যবসা থেকে, সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল রাজস্ব থেকে। আমাদের দেশ যথেষ্ট পরিমাণে মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র উৎপাদন করতে সমর্থ হলে দৃশ্যটা অন্য রকম হতো। কিন্তু তার বদলে কী হচ্ছে, তা আমরা সবাই জানি।
প্রশ্ন হতে পারে, এত দুশ্চিন্তা কিসের? চলচ্চিত্রের মান যদি খারাপ হয়ে যায়, যদি এফডিসিসহ সব প্রেক্ষাগৃহ ধসে পড়ে, যদি মুক্ত ধারার ছবিও আর দেখার মতো না হয়, তাতে সমস্যা কী? সব শেষ হয়ে যাক। আমরা মুঠোফোনের ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি বানিয়ে ‘ইউটিউবে’ তুলে দেব। মানুষ ঘরে বসে ইন্টারনেটে দেখে নেবে। কিন্তু আরও বড় একটি পটভূমি আমাদের সামনে আছে। প্রথমত, সমস্ত সমস্যার পরও এই শিল্পের উৎপাদন ও প্রদর্শন খাতে জড়িয়ে আছেন অজস্র কর্মী ও তাঁদের পরিবার। চলচ্চিত্রকে ঘিরে পরোক্ষভাবে গড়ে ওঠা আরও অসংখ্য পেশায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আছেন আরও লাখ লাখ। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে এটি অর্থনীতির অপার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর সর্বত্র বিনোদনবঞ্চিত মানুষের জন্য চলচ্চিত্রই বিনোদনের মুখ্য মাধ্যম। বিশেষত, রাজধানীর বাইরে এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এলাকায় চলচ্চিত্রই জনসংস্কৃতির সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যম। এ ছাড়া চলচ্চিত্র তরুণসমাজকে মন্দ কাজ থেকে সরিয়ে সুস্থ অবসরযাপনেরও সুযোগ করে দেয়। ১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লবের পর ইরান সরকার নিজ উদ্যোগে সারা দেশে ৫০০টি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করে।
চলচ্চিত্রচর্চা স্বাস্থ্যকর হলে তা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সামাজিক মূল্যবোধ ও জাতীয় পরিচয় রক্ষা করতে পারে। লক্ষ করার বিষয়, ভারতের মতো নানা ভাষা, জাতি ও সংস্কৃতিতে বিভক্ত একটি দেশে কয়েক দশক ধরে বলিউডি ছবি কীভাবে একটি জাতীয় পরিচয় গড়ে তুলেছে। এ ছাড়া অন্যায়ের চিত্র তুলে ধরে, সহিষ্ণুতাকে উৎসাহিত করে এবং বৈচিত্র্যকে উদ্যাপন করে চলচ্চিত্র একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। সুষ্ঠুভাবে পুনরুজ্জীবিত করতে পারলে সরকার যে বিপুল রাজস্ব এখান থেকে পেতে শুরু করবে, সে তো বলাই বাহুল্য।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, মৃতপ্রায় এই শিল্প খাতটিকে কীভাবে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব? এই কাজটি ঘটানোর মতো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা আমরা কোথায় পাব? সত্যি বলতে কি, আমাদের আশপাশের দেশগুলো এমন বহু কিছু করেছে, যা মডেল হিসেবে নেওয়া যায়। দুঃখজনকভাবে চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নতির জন্য কিছু না করার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র পিছিয়ে পড়া দেশ।
১০ বছর আগেও ভারতের অনেক রাজ্যের প্রেক্ষাগৃহের টিকিটের ওপর বিনোদন কর ছিল ১৫০ শতাংশ। চলচ্চিত্রকে যে সময় অভিজাতদের চিত্তবিনোদন বলে ভাবা হতো, এটা ছিল সেই ব্রিটিশ আমলের আইন। ১৯১৮ সালের পুরোনো লাইসেন্স দেওয়ার আইনে নতুন প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ ছিল সেখানে অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার, যা বাংলাদেশে এখনো আছে। চলচ্চিত্রে তখন অধিকাংশ বিনিয়োগ আসত মাফিয়া ও কালোটাকার মালিকদের কাছ থেকে। দুর্নীতি ও হিসাবনিকাশের অব্যবস্থাপনার কারণে প্রযোজক ও পরিবেশকেরা অল্প টাকাই ফিরে পেতেন। বাংলাদেশে এ দৃশ্য এখনো অটুট। ১৯৮০ সালের পর থেকে প্রেক্ষাগৃহগুলো ব্যবসা হারাতে শুরু করে।
২০০১ সালে ভারতে সবকিছু বদলে যায়। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের চাপে সরকার চলচ্চিত্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে শিল্প খাতের মর্যাদা দেয়। সহজ করা হয় সরকারি নীতিমালা। কমিয়ে দেওয়া হয় কর। এই খাতে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করা হয় ব্যাংকগুলোকে। মাফিয়ারা পিছু হটতে শুরু করে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আগ্রহী ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করার জন্য সরকার নতুন মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণের ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের কর অবকাশ ঘোষণা করে। এ ছাড়া ভূমি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির মতো অন্যান্য প্রাসঙ্গিক করও কমিয়ে দেয়। টিকিটের ওপর কর রাজ্যভেদে ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশে নামিয়ে আনে। তামিলনাড়ুতে এ হার মাত্র ১৫ শতাংশ। হিন্দির বাইরে প্রাদেশিক চলচ্চিত্রকে উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। যেমন, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ছবিকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য হিন্দি ছবির ওপর উচ্চহারে কর প্রয়োগ করা হয়। বাংলা ছবির ক্ষেত্রে তা হয় নামেমাত্র।
কয়েক বছরের মধ্যে ভারতে চলচ্চিত্রের নাটকীয় উত্থান ঘটে। সেখানে সিনেপ্লেক্স ও মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণের হিড়িক পড়ে যায়। ২০১০ সালের মধ্যে সারা ভারতে প্রায় ৭০০ মাল্টিপ্লেক্স নির্মিত হয়। এক হিসাবে দেখা যায়, ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ দর্শকের মারফতই ১৩ হাজার প্রেক্ষাগৃহের মাধ্যমে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ আয় চলে আসে। মাল্টিপ্লেক্সগুলো উচ্চ প্রযুক্তির প্রদর্শনব্যবস্থা চালু করে। এর ফলে একজন প্রযোজক একটি ছবি একসঙ্গে অনেক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিতে খুব অল্প খরচেই অসংখ্য প্রিন্ট করতে পারেন। মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে টিকিট বিক্রয় ও হিসাবরক্ষণ-প্রক্রিয়া চালু হওয়ায় প্রযোজকের লভ্যাংশ ফেরত পাওয়া সহজ হয়ে যায়। এ ছাড়া মানসম্মত মাল্টিপ্লেক্স গড়ে ওঠায় রুচিমান দর্শকেরা যেমন আকৃষ্ট হয়; ছবির গল্প, চিত্রনাট্য ও শৈলীতেও তেমনই আসে বৈচিত্র্য। মাল্টিপ্লেক্সকে ঘিরে শপিংমল ও রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠায় তা হয়ে ওঠে ব্যবসারও প্রাণকেন্দ্র। বিপুল করের বোঝা নিয়ে একটিমাত্র পর্দায় ছবি দেখানোর বদলে একই স্থানে গড়ে ওঠে সীমিত আসনের কয়েকটি পর্দা। এতে করের পরিমাণও হয় সীমিত। সব মিলিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে নতুন জাগরণ ঘটে। প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে মাল্টিপ্লেক্স ফিল্ম হওয়ার কারণে ভারতীয় চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও জায়গা করে নেয়। সরকারি রাজস্বের খাতায় যুক্ত হতে থাকে বৃহৎ অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা।
শুধু ভারত নয়, চলচ্চিত্র খাতের সংস্কার পাকিস্তানের ছবিও পাল্টে দিয়েছে। তাদের স্বর্ণযুগ ছিল ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশক। কিন্তু এই শতকের গোড়ায় এসে তাদের চলচ্চিত্রশিল্পও প্রায় ধসে পড়ে। ১৯৯০ সালে যেখানে ছিল ৭৫০টি প্রেক্ষাগৃহ, ২০০২ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১৭৫টিতে। তখন চলচ্চিত্রকে পুনরুদ্ধার করতে এবং মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণকে উৎসাহ দিতে কর ১৫০ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। প্রথম মাল্টিপ্লেক্স নির্মিত হয় ২০০২ সালে, করাচিতে। বছর খানেকের মধ্যে গড়ে ওঠে আরও ডজন খানেক। ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহগুলোকে বিনোদন কর দেওয়া থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রাখা হয়। ২০০৮ সালে এসে পাকিস্তান সরকার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়। ১৯৬৫ সালে নেওয়া ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধের আইনটি তারা বাতিল করে দেয়। এর ফলে একই বছর পাকিস্তানি ছবি খোদা কে লিয়ে ভারতের শতাধিক প্রেক্ষাগৃহে সগৌরবে মুক্তি পায় এবং কল্পনাতীত ব্যবসা করে।
শ্রীলঙ্কায় ২০০৭ সালের বাজেটে চলচ্চিত্রের জন্য বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। নতুন প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের জন্য সেখানে ১০ বছর কর মওকুফ করা হয়। আধুনিক প্রযুক্তিসহ প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণে উৎসাহ দেওয়ার জন্য নীতিমালাও করা হয়। সে নীতিমালা অনুসারে পুরোনো প্রেক্ষাগৃহের উন্নয়নের জন্য পাঁচ বছর কর মওকুফ করা হয়। কর কমানো হয় যন্ত্রপাতি আমদানিতে, কমানো হয় ল্যাব চার্জ, সহজ করা হয় পরিবেশনার পদ্ধতি। কর হিসেবে পাওয়া রাজস্বকে একই খাতে পুনর্বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিষ্ঠা করা হয় ফিল্ম সিটি ও ফিল্ম ইনস্টিটিউট।
নেপালের মতো ছোট্ট চলচ্চিত্র খাতও সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট মনোযোগ পেয়েছে। আধুনিক প্রদর্শন পদ্ধতিসহ মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণকে উৎসাহিত করার জন্য কর মওকুফ করার পাশাপাশি দেওয়া হয়েছে নানা সহযোগিতা। নেওয়া হয়েছে ‘টু টায়ার’ করপদ্ধতি। সেখানে হিন্দিসহ বিদেশি চলচ্চিত্রের ওপর করের হার ২৫ শতাংশ, কিন্তু দেশীয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তা মাত্র ১৩ শতাংশ। কাঠমান্ডুর মতো মাত্র ১০ লাখ অধিবাসীর শহরে গড়ে উঠেছে আটটি আধুনিক মাল্টিপ্লেক্স, নির্মাণাধীন রয়েছে ১৯টি নতুন প্রেক্ষাগৃহ।
এসব সাফল্য থেকে দেখা যায়, সংস্কার কঠিন ব্যাপার নয়, দরকার শুধু সরকারের সামান্য সদিচ্ছা। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের প্রক্রিয়াটি আধুনিক করে তুললেই বর্তমান সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। প্রয়োজনীয় স্থানে কর মওকুফ করে ও কমিয়ে, নতুন মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণে ও পুরোনো প্রেক্ষাগৃহ আধুনিকীকরণে উৎসাহ দিয়ে মৃতপ্রায় চলচ্চিত্র খাতকে বাঁচিয়ে তোলা যায়। বিদেশি ছবিতে উচ্চহারে কর আরোপ করে, দেশীয় ছবিতে কর রেয়াত দিয়ে এবং প্রাপ্ত রাজস্ব পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে খুব সহজেই সফলতা পাওয়া সম্ভব। এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব তুলে ধরা হলো:
আধুনিক প্রযুক্তি ও টিকিট বিক্রির সুবিধাসহ মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণের ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের জন্য কর মওকুফ করা।
পুরোনো প্রেক্ষাগৃহের মানসম্পন্ন সংস্কারের জন্য কমপক্ষে তিন বছরের জন্য কর মওকুফ করা।
প্রেক্ষাগৃহের জন্য অবকাঠামোগত কর—যেমন জমি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি—কমানো।
ডিজিটাল প্রজেকশন ও স্যারাউন্ড সাউন্ডকে উৎসাহিত করার উদ্যোগ নেওয়া।
বিদেশি চলচ্চিত্রের ওপর উচ্চহারে এবং দেশীয় চলচ্চিত্রের ওপর স্বল্পহারে কর আরোপ করা। বাংলাদেশ-ভারত চলচ্চিত্র আদান-প্রদানের জন্য নীতিগত চুক্তির উদ্যোগ নেওয়া।
নতুন প্রেক্ষাগৃহ বা মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণে উৎসাহ দিতে লাইসেন্স দেওয়ার পদ্ধতি সহজ করা। রাজধানীর বাইরে প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করা।
প্রেক্ষাগৃহগুলোর পাঁচ ও তিন বছর মেয়াদি কর অবকাশের সময় পার হওয়ার পর বিদেশি ছবিতে ৫০ শতাংশ এবং দেশীয় ছবিতে ১০ শতাংশ হারে ‘টু-টায়ার’ পদ্ধতির কর প্রয়োগ।
কর মওকুফ করা বা কমানোর সুবাদে টিকিটের দাম কমানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা। পরিবেশকের পক্ষ থেকে ‘মিনিমাম গ্যারান্টি’ পদ্ধতি তুলে নেওয়া।
শিশুতোষ চলচ্চিত্রের জন্য কর সম্পূর্ণভাবে মওকুফ করা।
সংস্কারের উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র খাতও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। ছবি প্রদর্শনের জন্য মানসম্পন্ন মাল্টিপ্লেক্স পেলে প্রযোজকেরা বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন, চলচ্চিত্রের মানও বাড়বে। তখন মধ্যবিত্ত দর্শকদের আবার চলচ্চিত্রের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পাওয়া যাবে। সুষ্ঠু প্রদর্শন-প্রক্রিয়া চালু হলে ব্যবসা পরিচালনা করতে পরিবেশনা প্রতিষ্ঠানগুলো আগ্রহী হবে। নির্মাতারাও ভালো বাজেটে ভালো ছবি বানাতে উৎসাহিত হবেন। কিন্তু এসব কেবল সংস্কার-প্রক্রিয়ার সূচনা। এফডিসিকে কার্যকর করা, সেন্সর বোর্ডকে যুগোপযোগী করা, চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সহজ করার জন্য আরও বহু সংস্কারের প্রয়োজন হবে। তবে আসল সূচনাটা হবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করার এবং সবার সঙ্গে তা ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যমে, যাতে আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে বাংলাদেশে পুনরুজ্জীবিত চলচ্চিত্রশিল্পের দিকে এগিয়ে যেতে পারি।
দৃক-এর ২২ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘দ্য স্টেট অব মুভিং ইমেজ: বাংলাদেশ’ শিরোনামে মূল প্রবন্ধ হিসেবে পঠিত
অনুবাদ: প্রসূন রহমান
ছবিঃ ২ অক্টোবর, ২০১০, ‘রানওয়ে’ ছবির মুক্তির দিনে ক্যাথরিন মাসুদ ও তারেক মাসুদ
ছবিঃ ২ অক্টোবর, ২০১০, ‘রানওয়ে’ ছবির মুক্তির দিনে ক্যাথরিন মাসুদ ও তারেক মাসুদ
ক্যাথরিন মাসুদ: চলচ্চিত্র নির্মাতা। প্রয়াত তারেক মাসুদের সহধর্মিনী