কামাল সিদ্দিকী
ফিক করে হেসে আদৃতা বাবার কোল থেকে নেমে মাকে আধো আধো ভাবে বকল কি মজা কি মজা বাবা আমাকে নিয়ে বাগানে বসে চা খাবে, তোমাকে দেবে না— তোমাকে নেবে না—
মা এটি বিশ্বাস করছে না বলে সে বাবাকে সাক্ষী মানে। এরপর ফ্রেশ হয়ে বাবা মেয়ে দু'জনে বাগানে রাখা চেয়ার টেবিল দখল করে নেয়, মা ট্রে হাতে চা বিস্কুট নিয়ে হাজির হন। এ সময় আদৃতা বলে বাবা, মাকে তুমি আর বকবে না, আমরা তিনজনা মিলেই চা গল্প করব, তাই না- বাবা?
বাবা বললেন, ভেরি গুড । টোস্টে কামড় বসিয়েই আদৃতার মনে পড়ে গেল সেই সুন্দর বাবুটির কথা, তাই সে বলল, আচ্ছা বাবা খবরের কাগজে এই ছবি ছাপা শুরু করল কে?
সঙ্গে সঙ্গে বাবা বললেন, ও তুমি জানতে চাও— কে এই মহত্ কাজটি করেছেন?
হ্যাঁ বাবা—
বাবা বললেন তবে শোন—
এই মহত্ কর্মটির উদ্ভাবক একজন বাঙালি। যিনি নিজে একজন শিশু সাহিত্যিক, হস্তরেখাবিদ, বেহালাবাদক, সাংবাদিক। তার নাম হচ্ছে উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী।
জন্ম— বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার মাহুয়া গ্রামে। ১৮৬৩ সালের ১০ই মে। উপেন্দ্র কিশোর তার প্রকৃত নাম নয়। প্রকৃত নাম হচ্ছে কামদা রঞ্জন রায়। বাবা কালিদাস রায়, কামদার বয়স যখন মাত্র ৫ বছর তখন তাকে দত্তক নেন নিঃসন্তান জমিদার কিশোর রায় চৌধুরী। জমিদার বাবু কামদাকে নিজ পুত্রবাত্সল্যতা দিয়ে গড়ে তোলেন। এমনকি নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখেন উপেন্দ্র। পুরো নাম উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী।
প্রথমে বালক উপেন্দ্র স্থানীয় স্কুলে বিদ্যা শিক্ষা শুরু করেন। ১৭ বছর বয়সে তিনি ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এন্ট্রাস পাস করেন। এরপর তিনি দেশের আর জমিদার পুত্রদের মতো কলকাতায় পাড়ি জমান। নৌপথে বজরা সাজিয়ে উপেন্দ্রকে পাঠানো হয় কলকাতায়, সেখানে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। তবে এখান থেকে তার বিএ পাস হয়ে ওঠেনি। তিনি কলকাতারই মেট্রো পলিটন ইন্সটিটিউট থেকে বিএ পাস করেন। তখন অবশ্য ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ঢাকা কলেজ ১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠা পায়। যাই হোক, এখান থেকে লেখাপড়া শেষে তিনি নতুন নতুন আবিষ্কারে মেতে ওঠেন। সে সময় সংবাদপত্রের পাতায় কোন ছবি ছাপা হত না। এদেখে তার ভেতরে নতুন এক ভাবনা জাগ্রত হলো। তিনি ভাবলেন ইস যদি কাগজের পাতায় ছবিগুলো ছাপা যেতো তবে কতই না ভালো হত। যেই ভাবা সেই তিনি কাজে নেমে পড়লেন। অনেক চেষ্টা তদবিরের পর তিনি জিংকের ব্লক আবিষ্কার করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলেন। এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করেই খবরের কাগজের পাতায় ছবি ছাপানো শুরু। উপেন্দ্র কিশোর যে শিশুদের জন্য ভাবতেন। ছোটদের তিনি বন্ধু ছিলেন বলেই প্রকাশ করলেন 'সন্দেশ'। নামটা কেমন মিষ্টি না। এক ধরনের মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে, আদৃতা দেখ নামটা বলার সঙ্গে সঙ্গে পিঁপড়েরা সারিবদ্ধ ভাবে এগিয়ে আসছে।
সেদিনের শিশুরাও এই 'সন্দেশ' বের হবার পরই তা পেতে চেয়ে থাকতো। শিশুদের জন্য তিনি প্রচুর লিখেছেন। তার লেখার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ছোটদের রসায়ন, (১৮৯৪-৯৫), সে কালের কথা (১৯০৩), ছোটদের মহাভারত (০৯), মহাভারতের কথা (১৯০১) ইত্যাদি।
আরে তার সেরাদের সেরা লেখাটির নামটাই বলা হলো না। দুরছাই- সেটি এড়িয়ে গেল কিভাবে? আদৃতা জেনে নাও যেটি তার পুস্তক। পরবর্তীতে তার নাতি সিনেমা বানিয়ে বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন— সেটি হচ্ছে - বাঘাবাইন আর গোপী গাইন—
উপেন্দ্র কিশোরের নাতিকে জান?
তিনি হচ্ছেন বিশ্ববিখ্যাত, অস্কার প্রাপ্ত বাঙালি চলচ্চিত্রকার সত্যজিত্ রায়। আবার উপেন্দ্র কিশোরের ছেলেও বিখ্যাত ছিলেন। তিনি ছিলেন ছড়াকার। সেই যে 'বাবু রাম সাপুড়ে' - তো তারই লেখা-
উপেন্দ্র কিশোরকে শিশু সাহিত্যের জনক বলা হয়। তবে তিনি এই যে ব্লক আবিষ্কার করে সংবাদপত্র শিল্পকে সমৃদ্ধ করলেন সেটাও কিন্তু তার বড় কীর্তি।
আদৃতা এবারে নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারলে তোমার এক শিশু বন্ধুর প্রতিভার কারণেই সেকালে সংবাদ পত্রের পাতায় ছবি ইচ্ছে মতো ছাপানো হতো। আর একারণেই তুমি পত্রিকার পাতায় সুন্দর সুন্দর বাবুদের দেখতে পাও। কি জানা হলো তো। এসো এবারে তোমাকে একটা জাদু দেখাই বলেই আদৃতাকে কোলে নিয়ে তিনি ঘরের দিকে হাঁটতে থাকেন।