সাময়িকী.কম

সাত থেকে নয় মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলেই পুরো রাজধানী ঢাকার রাস্তাঘাটই এখন ডুবে যাচ্ছে। এতে কর্মজীবী মানুষ থেকে শুরু করে সব ধরনের নাগরিকদের মহাদুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তবে সামন্য এ বৃষ্টিপাতে এমন জলাবদ্ধতার পেছনে রয়েছে দশ’টি কারণ। এসব কারণগুলো সমাধান করলেই নগরবাসী জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা পাবে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১০ কারণে বর্ষায় রাজধানীতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। এরমধ্যে খাল ও জলাধারগুলো বেদখল। সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নেই। ২৬০ বর্গকিলোমিটার প্রয়োজনের বিপরীতে ড্রেনেজ লাইন রয়েছে ১৫০ বর্গকিলোমিটার। বিভিন্ন সংস্থার ইচ্ছেমতো রাস্তা খুঁড়াখুঁড়ি। নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার না করা। বাসা-বাড়ির ময়লা সময়মতো অপসারণ না করা। উম্মুক্ত স্যুয়ারেজ লাইনে অপচনশীল ময়লা ফেলা। নির্মাণাধীন বাড়ির রাবিশ-বালু বৃষ্টিতে গড়িয়ে ড্রেনে পড়া। অধিকাংশ এলাকায় স্যুয়ারেজ লাইন সরু থাকা। ঢাকা বন্যামুক্ত ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণে গৃহীত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না হওয়া।


জানা গেছে, বর্তমানে রাজধানীর মাত্র ৪৫ শতাংশ এলাকা ড্রেনেজ সিস্টেমের আওতায় এসেছে। বাকি ৫৫ শতাংশ এলাকা এখনো এ সিস্টেমের বাইরে রয়ে গেছে। এরমধ্যে  ঢাকা ওয়াসার প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার ড্রেনেজ পাইপলাইন রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের রয়েছে প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার ড্রেনেজ লাইন। এর বাইরে দুই করপোরেশনের রয়েছে আরও আড়াই হাজার কিলোমিটার ভূ-উপরিস্থ (সারফেজ) ড্রেনেজ লাইন। ওয়াসার দাবি, ঘণ্টায় ১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তা বর্তমান ড্রেনেজ ব্যবস্থা ধারণ করতে পারে। কিন্তু বর্ষায় ধারণক্ষমতার প্রায় পাঁচ গুণ বেশি বৃষ্টি হয় সচরাচর। ফলে জলাবদ্ধতা থেকে সহসা নিস্তার মিলছে না।


সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নগরীতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি এবং নিরসনের সাথে সাতটি সংস্থার কার্যক্রম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। এ সব সংস্থা হলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা ওয়াসা, ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি), পরিবেশ অধিদফতর, ভূমি অধিদফতর, রেল কর্তৃপক্ষ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। এই সাতটি সংস্থা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে ৬টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে। পূর্ত ও গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজউক। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা ওয়াসা ও ডিসিসি। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিবেশ অধিদফতর। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ভূমি অধিদফতর। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে রেল কর্তৃপক্ষ। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এই সাতটি সংস্থার একক সিদ্ধান্ত ও অসমন্বয়ের কারণে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে কোন অগ্রগতি হচ্ছে না। এমনকি নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে আজ পর্যন্ত এ সাতটি সংস্থা এক সাথে বসে কোনো ধরনের আলোচনা পর্যন্ত করেনি। ফলে আজ নগরীর জলাবদ্ধতা চরম আকার ধারণ করছে। এক্ষেত্রে রাজধানীর নিম্নাঞ্চল মেরাদিয়া, বাড্ডা, মাণ্ডা, মানিকদি, বাসাবো, মুগদা, পল্লবী ও ডিএনডি বাঁধ এলাকার বসবাসকারীদের সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে রাজধানীর জলাবদ্ধতার জন্য এই সাতটি সেবা প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী। এ সব প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কার্যক্রমে রয়েছে অব্যবস্থাপনা ও দূরদর্শিতার অভাব। এই সাতটি প্রতিষ্ঠান ছয়টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে সম্মিলিত সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটে না। এক প্রতিষ্ঠান স্থাপনা উচ্ছেদ করলে আরেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে। জলাবদ্ধতা সৃষ্টির দায়ভার তারা পরস্পরের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। তবে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হলো ২৬০ বর্গকিলোমিটার প্রয়োজনের বিপরীতে নগরীতে ড্রেনেজ লাইন রয়েছে ১৫০ বর্গকিলোমিটার। খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, বছরে যে ৫৬ কোটি ঘনলিটার পানি রাজধানী থেকে নিষ্কাশিত হয়, তার মধ্যে বৃষ্টির পানি হচ্ছে ২৩ কোটি ঘনলিটার। নগরীতে রয়েছে স্টর্ম ওয়াটার লাইন ২৪০ কিলোমিটার, বক্স কালভার্ট ৮ কিলোমিটার, খোলা খাল ৬৫ কিলোমিটার। নগরীর পানি পাম্পিং স্টেশনগুলোর ক্ষমতা সীমিত। ধোলাইখাল স্টেশনের প্রতি সেকেন্ডে পাম্পিং ক্ষমতা ২২ ঘনলিটার, কল্যাণপুর পাম্পিং স্টেশনের ১০ ঘনলিটার, গোড়ান চটবাড়ি পাম্পিং স্টেশনের ২২ ঘনলিটার ও ডিসিসির নারিন্দা স্টেশনের পাম্পিং ক্ষমতা ৯ দশমিক ৬ ঘনলিটার। নগরীর সম্পূর্ণ উপরিভাগের আনুমানিক ২০ হাজার কিলোমিটার ড্রেন এবং ২০০ কিলোমিটার স্টর্ম স্যুয়ারেজ লাইন রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব ডিসিসির। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জমা হওয়া পানি নগরীর বাইরে বের করে দেয়ার জন্য ২৫০টি পাম্প ব্যবহারের কথা বলা হলেও সচল পাম্পের সংখ্যা ১৫৬টির বেশি হবে না, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত।


জানা যায়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ওয়াসা, রাজউক ও ডিসিসিসহ ৭টি সংস্থা নিজেদের কাজের বিষয়ে সচেতন থাকলেই নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ওয়ার্ড ও মহল্লার পানি ও বর্জ্য বের করে দেয়ার দায়িত্ব ডিসিসির। এ ছাড়া, দীর্ঘদিনেও নগরীর বর্জ্য অপসারণে গতি আনতে পারেনি ডিসিসি। নগরীতে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এ সব বর্জ্যরে সব অপসারণ করতে পারেনা ডিসিসি। ফলে বৃষ্টি হলে ওই সব বর্জ্য ড্রেনেজলাইন বা কালভার্টে প্রবেশ করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে।


ঢাকা ওয়াসার কাজ হচ্ছে পানি সরবরাহ ও পয়ঃশোধন। ঢাকার পয়ঃবর্জ্যরে একটি মাত্র শোধনাকেন্দ্র আছে যা ডিএনডি প্রকল্পের ভেতরে পাগলায় অবস্থিত। এখানে মোট পয়ঃবর্জ্যরে মাত্র শতকরা ১০ ভাগ (০.১২ মিলিয়ন কিউসেক মিটার) শোধিত হয়। ঢাকা ওয়াসা আরও শতকরা ১০ ভাগ পয়ঃবর্জ্য সংগ্রহ করে। কিন্তু তা কালভার্ট বা কভার্ড ড্রেনের মাধ্যমে নদীতে বা খালে ফেলে দেয়া হয়। নগরীর বাকি শতকরা ৮০ ভাগ পয়ঃবর্জ্য যায় সরাসরি খাল, জলাভূমি অথবা নদীতে। অথচ শোধনাগারের অভাবে ওই সব পয়ঃবর্জ্য ড্রেনেজলাইন বা কালভার্টের ভেতরে প্রবেশ করে। নগরীর শিল্প কারখানাগুলোকে নিজেদের জায়গার ভেতরে প্রাথমিক তরল বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণে বাধ্য করাতে পারেনি পরিবেশ অধিদফতর। নির্দিষ্ট সময়ের মেয়াদ প্রদানের পরও শিল্প কারখানাগুলো অশোধিত বর্জ্য খাল বা জলাশয়ে ফেলে দেয় যা জলাবদ্ধতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। ভূমি অধিদফতরের বিচক্ষণতার অভাবে ঢাকা মহানগরীর সরকারী নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় ৩৬ হাজার একর জমির অধিকাংশই নানাভাবে লিজের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের হাতে চলে গেছে। এ সুযোগে সুবিধাভোগীরা খাল ও জলাধারগুলো অবৈধভাবে ভরাট করে নিয়েছে যা পানি নিষ্কাশনের আয়তন কমে গেছে। রেল কর্তৃপক্ষের ঢাকা মহানগরীর কমলাপুর, ফুলবাড়িয়া, তেজগাঁও এলাকার অনেক জমি একই উপায়ে বেদখলে চলে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে পানি নিষ্কাশনের গতিপথ। মূলক সাতটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এ বিষয়ে সমন্বয়ের অভাবে আজ জলাবদ্ধতার ভয়াবহ অবস্থা।


ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বলেন, গত কদিনের বৃষ্টিতে দেখা গেছে ঢাকার বেশির ভাগ এলাকা ডুবে যায়। এ জন্য ড্রেনেজ ব্যবস্থা অনেকটাই দায়ী। অনেক এলাকায় ড্রেনেজ সিস্টেমও নেই। এ ধরনের অবস্থা উদ্বেগজনক। ড্রেনেজের দায়িত্বে ঢাকা ওয়াসা। তবে সিটি করপোরেশনেরও কাজ আছে। আমি মনে করি, সবাই মিলে এ সমস্যা দূর করতে দ্রুত উদ্যোগী হতে হবে। এ জন্য করপোরেশন, ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠক করা হবে শিগগির। জলাবদ্ধতার কারণসমূহ উল্লেখ করতে গিয়ে সুজন এর সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে নগরীতে জলাবদ্ধতা বেড়েই চলেছে। খাল ও জলাধারগুলো দখলে নিয়ে নানা অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। ফলে নগরীর পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তাই আজ জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। 
বিভাগ:

Author Name

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.