সাময়িকী.কম
মটরবাইকের পিছনে লাইসেন্স নম্বর না লিখে “চৎবংং” কিংবা “সাংবাদিক” লেখা ব্যবহার করেন অনেক সংবাদকর্মী। সংবাদকর্মীদের মধ্যে খবর সংগ্রহের প্রয়োজনে যারা এমনটি করেন তারা তাদের কাজের প্রয়োজনেই এমনটি করেন সন্দেহ নেই। কিন্তু অতি উৎসাহী কিছু আমজনতা টাইপ সংবাদকর্মীরা যে নিরেট অপব্যবহারের ইচ্ছায় প্রেস কিংবা সাংবাদিক নামটি ব্যবহার করেন এমন বিষয়েও কারো সন্দেহ রাখার সুযোগ নেই। কারণ লাইসেন্স নম্বরের স্থলে প্রেস লেখার সুবিধা অনেক। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ট্রাফিক সার্জেন্টের অহেতুক বিড়ম্বনা কিংবা অন্যান্য কাজের সহজ প্রাপ্তিতে “প্রেস” লেখাটি স্বার্থ উদ্ধারের ক্ষেত্রে টনিকের মত কাজ করে নিঃসন্দেহে।
প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক এবং অনলাইন বার্তাসংস্থার ব্যাপকতার কারণে সারাদেশে সংবাদকর্মীর সংখ্যা অজ¯্র। কবিদের প্রসংগে “দেশে কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি” প্রবাদবাক্য বহুল প্রচলিত হলেও বর্তমানে কথিত ‘সাংবাদিক’ এর প্রকৃত সংখ্যার আলোকে প্রবাদবাক্য কিভাবে উপস্থাপন করা যায় তা আপাতত ভাবতে পারছিনা। কারণ যে হারে সাংবাদিক শব্দটি যত্রতত্র ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ‘সাংবাদিক’ বলতে যে চিত্রগুলো চোখের সামনে ভেসে আসার কথা তার উল্টোটা ঘটছে- তাতে সাংবাদিক শব্দের মানে বুঝতে একটু ইতস্তত করতেই হয়।
উপরোক্ত শিরোনামে দুটো শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়- সাংবাদিক, সংবাদকর্মী। লেখাটি টাইপ করার সময় কম্পিউটারের পিছন থেকে দেখা এক ছোট ভাইর মন্তব্য- ভাই বিষয়টা চমৎকার। ঐ ছোট ভাই সদ্য চলমান এসএসসি পরীক্ষার্থী। মফস্বলের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থী হওয়ায় প্রিন্ট মিডিয়ার পাঠক কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার নিয়মিত দর্শক কোনোটাই সে না। সাংবাদিক শব্দের সাথে পরিচিত থাকায় এবং পরীক্ষার কারণে অল্প কয়েকদিন আমার কাছে থাকার কারণে- আমি একটু-আধটু লেখালেখির চেষ্টা করি বলে ঐ ছোট ভাইর ধারণা আমিও ‘সাংবাদিক’ পর্যায়ের কেউ! সংবাদপত্রে টুকটাক সংবাদ পাঠানো এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটু সক্রিয় বলেই কি আমি নিজেকে ‘সাংবাদিক’ দাবি করতে পারি?
শিরোনামের বিস্তর বিশ্লেষণের প্রয়োজনে আর একটু খোলাসা করছি। আমি নিজে একজন প্রিন্ট মিডিয়ার পাঠক এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দর্শক মাত্র। আর একটু বাড়িয়ে বললে প্রিন্ট মিডিয়ার ‘মনোযোগী পাঠক’ এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ‘মনোযোগী দর্শক’ বলতে পারি। এর বেশি কিছু না। আমি মূল সত্যিটাই বললাম। একটুও বিনয়ী হওয়ার চেষ্টা করছি না। নিয়মিত পাঠক এবং দর্শক হওয়ার সুবাদে কোন বিষয় নিয়ে লিখতে চেষ্টা করলে কয়েক লাইন লেখা চালিয়ে যেতে পারি। অতিরিক্ত প্রাপ্তি বলতে এতটুকুই। এই প্রাপ্তির উপর ভিত্তি করে সংবাদপত্রে মফস্বলে থেকে টুকিটাকি সংবাদ পাঠানোর দুঃসাহস দেখাই আর কি। আরও সত্যি বললে বলতে হয় যারা নিয়মিত সংবাদ পাঠায় তাদের সাথে সখ্যতা জমিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করে হালকা এডিটিং করে পত্রিকা অফিসে মেইল করে দেই। মফস্বলে থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ পাঠানোর বাস্তবতা অনেকের ক্ষেত্রে এমনটাই। যেহেতু আমার লেখা আমি নিজেই কম্পিউটার কম্পোজ করি তাই সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে লিখছি- অন্যের সংগ্রহ করা সংবাদ পত্রিকায় পাঠানোর ক্ষেত্রে আমার নিজের নামটি শিরোনামের পর ব্যবহার করি না। যে পত্রিকায় কাজ করি সেই পত্রিকার প্রতিনিধি উল্লেখ করি মাত্র। আর যে লেখাটির পুরোটা আমি নিজেই লিখি সেটির ক্ষেত্রে নিজের নাম ব্যবহার করি। কারণ এটা আমার প্রাপ্য বলেই ব্যবহার করার সাহস দেখাতে পারি। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে তারা অন্যের লেখার ছিটেফোটাও পরিবর্তন না করে নিজের নামে চালিয়ে দেন। সবসময় সংবাদ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়না বলে সর্বোচ্চ অন্যের প্রাপ্ত সংবাদ থেকে তথ্য নেয়া যেতে পারে। কিন্তু অন্যের লেখা সংবাদ হুবহু কপি করে নিজের নামে চালিয়ে দেয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত? আর এভাবে করে যারা বছরের পর বছর পত্রিকায় কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সংবাদ পাঠিয়ে নিজেরা ‘সাংবাদিক’ শব্দের ব্যবহার করছে এবং নামের আগে “সাংবাদিক” লিখে এক হাজার ভিজিটিং কার্ড ৪০০ টাকায় ছাপিয়ে প্রশাসনের সবগুলো দপ্তর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে; তারা আদৌ ‘সাংবাদিক’ কিংবা ‘সংবাদকর্মী’ কোনোটার পর্যায়ে পড়ে কিনা? আমিতো নিজের ক্ষেত্রে নিজেকে ‘সংবাদকর্মী’ ভাবতেই ইতস্তত করছি। কারণ একজন সংবাদকর্মীর যে দায়বদ্ধতা এবং তার কাছে সমাজের যে প্রত্যাশা রয়েছে, প্রত্যাশা থাকে তার মধ্য থেকে কতটুকু দিতে পারছি নিয়মিত? দায়বদ্ধতা কিংবা প্রত্যাশা পূরণে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে কতভাগ কাজ করা উচিত? এবং তার কতটুকু করছি? এই দুটো প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলেইতো আমার নিজের নৈতিকতাই দায় এড়ানোর পথ খুঁজতে চাইবে। আর অসময়ে ধরা খেয়ে যাবে ঠুনকো ভনিতাটুকুও!
যারা এই লেখাটির পুরোটা মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন তাদের কাছে বিনীত ক্ষমা প্রত্যাশী- কারণ দৃষ্টিনন্দন শিরোনাম ব্যবহার করে তার যথার্থ ব্যাখা দিতে পারিনি বলে। কীভাবে দেব বলুন- আমি নিজেইতো সংবাদকর্মী হওয়ার দায়বদ্ধতার পুরোটা পালন করতে পারিনা। নিজ পরিবারের সমস্যা থেকে বেরুতেই সূর্যাস্ত-সূর্যদ্বয় কখন হয়ে যায় মাঝে মাঝে টেরই পাই না! এমন পরিস্থিতিতে গণমানুষের নানামুখী সমস্যার বিপরীতে কতটাই বা ভূমিকা রাখতে পারি? কিংবা ভূমিকা রাখতে পারার সুযোগ হয়?
‘ভনিতার ইতি টেনে’ একটা তথ্য আপনাদের (বিশেষ করে তথাকথিত সংবাদকর্মীদের) জানানোটা জরুরি মনে করছি। সেটি হচ্ছে অন্যের লেখা এডিট করে সর্বোচ্চ ‘সংবাদকর্মী’ পরিচয় দেয়াটাই বাড়াবাড়ি পর্যায়ের। এমনটি করে ‘সাংবাদিক’ শব্দের ব্যবহার করার মানে হচ্ছে ‘সাংবাদিক’ শব্দের বিকৃতি করা। কারণ সাংবাদিক শব্দ ব্যবহারের আগে অন্তত একবার ভেবে দেখবেন- আপনি ন্যূনতম সংবাদকর্মী হওয়ারই যোগ্য কিনা? যদি এডিট করে হলেও সংবাদকর্মী শব্দটি লিখেন তাহলেও কিছু সময় অপেক্ষা করুন। দেখুন আপনি সংবাদ লেখার জন্য অদূর ভবিষ্যতে ফিট হবেন কিনা। যদি নাই হোন তাহলে ব্যক্তিগত কাজ উদ্ধারের জন্য সর্বোচ্চ ‘সংবাদকর্মী’ শব্দটিই ব্যবহার করুন! সাংবাদিক শব্দটি ভুলক্রমেও না। কারণ সাংবাদিক শব্দের পরিধি আমি যতটুকু বুঝি তা অনেক দায়বদ্ধতার। গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণের একটা নৈতিক হাতিয়ারের নাম গণমাধ্যম। গণমাধ্যম গণমানুষের হয়ে বলবে এটাই বাস্তবতা। আমি, আপনি সেই বাস্তবতার ব্যত্যয় ঘটিয়ে খানিকটা স্বার্থ নাই-বা উদ্ধার করলাম। সাংবাদিক এর স্থলে না হয় সংবাদকর্মী লিখেই সন্তুষ্ট থাকলেন। নিজের ব্যক্তিগত কাজও উদ্ধার হল। সাংবাদিক শব্দের মানও অক্ষুণœ থাকলো। এতটুকু স্যাক্রিফাইস না হয় গণমানুষের জন্যই করা হোক। বিবেকের দরজায় টোকা মারুক ইতিবাচক মূল্যবোধ। যারা লেখাটি পাঠ শেষ করলেন সেইসব ধৈর্যশীল পাঠকদের জন্য শুভ কামনা...
১০ ফেব্রুয়ারী, ১৬
আবদুর রহমান সালেহ
সরকারি বরিশাল কলেজ, বরিশাল।
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব যা সম্পাদকীয় নীতির আওতাভুক্ত নয় ।)