পু
রনো টায়ার বেচে সন্তানদের জন্য কিছু খাবার যোগার করেছেন এইমাত্র। রাতের খাবার কোথা থেকে আসবে- সে সম্পর্কে কোন ধারনাই ছিলনা। বিমর্ষভঙ্গীতে জননী চেয়েছিলেন সন্মুখপানে। ‘সন্মুখ’ শব্দটিও বোধহয় যথার্থ হলনা। ত্রিশ বছর বয়সী জননী ফ্লোরেন্স থম্পসনের সামনে যে সে সময় নিকষ আঁধার ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলোনা।
১৯৩০ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে সাত সাতটি সন্তানসহ ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় আটকে যাওয়া জননীটির দুর্দশার ছবি ছবি তুলেছিলেন আলোকচিত্রি ডরোথি ল্যাইন।
ল্যাইনের তোলা এই ছবিটিই পরবর্তীতে বিশ্বখ্যাত হয় ‘মাইগ্রেন্ট মাদার (Migrant Mother)’ নামে। গ্র্যাফ্লেক্স ক্যামেরায় তোলা ছবিটির মূল নেগেটিভের আকার ছিল ৪x৫”। মাইগ্রেন্ট মাদার ছবিটি পরবর্তীতে এমন খ্যাতি পেয়ে যাবে- সেটি আলোকচিত্রী ল্যাইনও ঠিক বুঝতে পারেননি। তবে বিশ্লেষকরা এ সাধাসিধে ছবিটির মাঝেই খুঁজে পেয়েছিলেন সময় ও সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ কিছু অনুষঙ্গ।
প্রথমত, মাইগ্রেন্ট মাদার ছবিটি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কে ধারন করে আছে। ১৯৩০ ও এর পরবর্তী সময়ের অর্থনৈতিক মন্দাটিকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ আর দীর্ঘতম মন্দাগুলোর একটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
আজকের যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মোড়ল হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কথায় কথায় বিপুল পরিমানে ত্রাণ (কিংবা যুদ্ধবিমান) পাঠিয়ে দেয়, ১৯৩০ সালের মন্দায় সেই মার্কিন মুলুকের বাসিন্দাদেরই না খেয়ে মরার দশা হয়েছিল, বেকারত্বের হার একলাফে সেসময় বেড়েছিল ২৫% পর্যন্ত। দুর্ভিক্ষের কারন হিসেবে ইতিহাসবিদরা কিছু প্রধান ব্যাংকের পতন, ষ্টক মার্কেট ধ্বস সহ নানান অর্থনৈতিক কারন তুলে ধরলেও, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের কারনে সৃষ্ট তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার ব্যাপারটিও আলোচনায় উঠে এসেছে ঘুরেফিরে।
বটম লাইনের সন্ধানে গেলে- মা ফ্লোরেন্স থম্পসনের এমন দুর্দশার মধ্যে পড়ার পেছনে যতটা না প্রকৃতি দায়ী ছিল, তারচেয়ে বেশি ছিল মনুষ্যসৃষ্ট কিছু কারন। প্রকৃতির এমন সময়োপযোগী পাঠ সত্ত্বেও মানুষ কি কখনো শিক্ষা নিতে সচেষ্ট হয়েছে! মোটেও না!
অস্ত্র ব্যবসায়ীরা বিক্রিবাট্টা বাড়াতে প্রতিনিয়তই এখানে সেখানে বাঁধিয়ে দিচ্ছে ঝগড়াঝাঁটি, মারপিট আর যুদ্ধ।
আর একারনেই মাইগ্রেন্ট মাদার পুরো সভ্যতার জন্যই এতটা অর্থবহ আর জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্যালারী, পত্রিকা কিংবা ইন্টারনেট এ যতবারই ছবিটি প্রদর্শিত হয়, ততবারই এক দীনহীন মা যেন করুন স্বরে মিনতি করছেন- ‘বাছারা! এভাবে মারপিট করে নিজেদের থাকার জায়গাটাকেই যে ধ্বংস করছিস তোরা! ’
যুদ্ধ-বিগ্রহের দিকটি গেলে দ্বিতীয় যে পরিপ্রেক্ষিতটি অবশিষ্ট থাকে, সেটিই মূলত মাইগ্রেন্ট মাদারের বিখ্যাত হবার পেছনে মূল কারন হিসেবে কাজ করেছে।
আর একারনেই মাইগ্রেন্ট মাদার পুরো সভ্যতার জন্যই এতটা অর্থবহ আর জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্যালারী, পত্রিকা কিংবা ইন্টারনেট এ যতবারই ছবিটি প্রদর্শিত হয়, ততবারই এক দীনহীন মা যেন করুন স্বরে মিনতি করছেন- ‘বাছারা! এভাবে মারপিট করে নিজেদের থাকার জায়গাটাকেই যে ধ্বংস করছিস তোরা! ’
যুদ্ধ-বিগ্রহের দিকটি গেলে দ্বিতীয় যে পরিপ্রেক্ষিতটি অবশিষ্ট থাকে, সেটিই মূলত মাইগ্রেন্ট মাদারের বিখ্যাত হবার পেছনে মূল কারন হিসেবে কাজ করেছে।
যুদ্ধ, মন্দা কিংবা দারিদ্রতা- এতো কিছুর ডামাডোলে মাইগ্রেন্ট মাদার সভ্যতার যে অবিসংবাদিত দিকটি তুলে ধরেছে- সেটি হচ্ছে মাতৃত্ব। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সেই মা হয়েছেন সাত সাতটি সন্তানের। কপাল আর চোখের আশেপাশের বলিরেখাগুলো নির্মমভাবে মুছে দিয়েছে তার যৌবন।
এতো দারিদ্রতা ক্ষুধা আর অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও জননী হাল ছাড়েননি। সন্মুখের নিশ্ছিদ্র আঁধার ভেদ করে আলো দেখার যে বাসনা- সে তো তার সন্তানদের জন্যই। স্বার্থপর পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীই যখন নিজ ভাগের প্রতিটি শস্যকণা খুঁটে খুঁটে খেয়েছে, দরিদ্র গৃহের সে জননীটিই একমাত্র নিজে না খেয়ে সন্তানদের মুখে তুলে দিয়েছে রুটির শেষ অংশটি।
স্বার্থপরের মত পালিয়ে গেলে কেউ টেরই পেতনা। জননী তবু সন্তানদের আঁকড়ে ধরেই খুঁজে বেড়িয়েছেন হিসেবি পৃথিবীর সাথে লড়াইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ। আর একারণেই মাতৃত্ব এতো অনন্য, বিস্ময়কর, অভূতপূর্ব। আর এভাবেই মাতৃত্বের চিরন্তন রূপটি মেলে ধরে মাইগ্রেন্ট মাদার হয়ে গেছে জগদ্বিখ্যাত।