আজ প্রিয়ার জন্মদিন। তাই খুব সুন্দর পরিপাটি হয়ে সাজগোজ করেছে সে। অফিসে ঢুকে নিজের চেয়ারে বসতে গিয়ে চোখ পরল, টেবিলে রাখা বিশাল এক প্যাকেটের ওপর। কাছে টেনে নিতে দেখল- “জন্মদিনে বাবা এই উপহারটি তাকে পাঠিয়েছে”। গতবার প্রিয়া বাবার সাথে ছিল। কিন্তু এবার কাজের প্রয়োজনে, একটু দূরে আসতে হয়েছে। ইদানিং তাই খুব বেশি মিস করছে বাবাকে। কোন কিছুই ভাল লাগছেনা বাবাকে ছাড়া।
ছোটবেলার আমিঃ
বাবার চোখে আমি একটু দুরন্ত। চোখের আড়াল করলে বেড়ে যেতো দুরন্তপনা। বাবা সাথে ছিল দুষ্টু আমি’র যত খেলা। আজ বিড়াল পোষা, কাল মত্ত লুকোচুরি খেলায়। বাবার সাথে প্রথম স্কুলে যাওয়া। আর ফেরার পথে যতসব বায়না ধরা। রাত হলেই বাবাকে নিয়ে টানাটানি, ঘুমের দেশে একসাথে যেতে হবে বলে। কত অযাচিত বায়না করেছি, তার ত হিসেব নেই। এখন মনে পড়লে খুব হাসি পায়। আর বাবা সেগুলো হাসিমুখে সহ্য করে গেছে। সেই থেকে আজ অবধি বাবা প্রতিনিয়ত আমার জীবনকে প্রভাবিত করে আসছে। তার কারণ- একটি স্পষ্ট ধারণা থেকে, সম্পর্কটি আজ এই অবধি এসেছে। গড়ে উঠেছে এক মধুর সম্পর্ক। ছোটবেলা থেকে এই মধুরতা না প্রকাশ পেলে, সম্পর্কটিতে শুধু দূরত্ব আর ব্যর্থতার চিত্র ফুটে উঠত। কখনই তা স্পর্শ করা যেতো না, সবকিছু হতো অবহেলিত। তাই একটা সম্পর্কে আসতে হলে, তা মজবুত করতে চাইলে একদম প্রথম থেকে অনুভব করতে হয়। নিজের চোখ দিয়ে দেখে, অনেক কিছু বুঝে নিতে হয়। এজন্য নিজের ইচ্ছা আর মনোযোগ দুটোরই প্রয়োজন খুব বেশি।
বিশ্বাস/ক্ষমাঃ
সব সম্পর্কে বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন। বাবার সাথে মেয়ের সম্পর্কের মধ্যেও এটি আনতে হবে। খুব স্বাভাবিকভাবে মেয়ের জীবনে এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। বাবা হিসেবে সন্তানের কাছে বিশ্বাসের জায়গাটুকু করে নিতে- কথায় এবং কাজে মিল থাকতে হবে। সব কাজে সন্তানের সাথে সরাসরি সংযোগ রাখতে হবে। মেয়ে সন্তানের বৃদ্ধির সময় তার পাশে থেকে সাহস এবং স্নেহ দিতে হবে। এইসময় মাঝে মাঝেই আচরণ, গতিবিধি পরিবর্তন হয়। এমন সময়টায় এই পৃথিবীর কিছুই যেন ভাল লাগেনা। লজ্জা, ভয় কাজ করে। তাই সন্তানের পাশে থেকে বিমর্ষতা আর নানারকম জটিলতা থেকে তাকে মুক্ত রাখতে হবে। মেয়েকে বিভিন্নভাবে ব্যস্ত রাখতে হবে। যদি বাবা কোন ভুল করে ফেলেন- তাহলে সন্তানের কাছে ক্ষমা চাইতে দ্বিধা করবেন না। যার ফলাফল হবে- বাবা হিসেবে সন্তানের কাছে বিশ্বাসের জায়গাটুকু পূর্ণতা পাবে এবং ভবিষ্যতে পুরুষজাতি সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা মেয়ের মনে তৈরি হবে। সমগ্র নারীজাতির ওপর শ্রদ্ধা আর সম্মান, বিশ্বাসের মাত্রাকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে। পরবর্তীতে বিশ্বাস এবং ক্ষমা তার জীবনে খুব সহজে পরিলক্ষিত হবে। আরও বেশি যদি ভাবা যায়- তার এই স্বভাব, জীবনসঙ্গী হিসেবে যথার্থ ব্যক্তিকে খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।
নির্ভরশীলতাঃ
বাবা এবং মেয়ের সম্পর্কটিতে দুইজন তখনই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারবে, যখন তাদের মধ্যে থাকবে নির্ভরশীলতা। পাশাপাশি চলতে গিয়ে ভাললাগা, মন্দলাগা ব্যপারগুলো থাকবেই। একটা সময় পরে যেন এসব দুজনের ওপর সমানভাবে নির্ভর করে। দুজনের অনুভূতি ধীরে ধীরে একই রকম, হয়ে মিলে যায়। সব আবদার, সব অভিমান, সব আনন্দ মিশে থাকে এই সম্পর্কের মাঝে। ছোটবেলা থেকে দেখা যায়- বাবা পুরো সংসারের দায়িত্ব পালন করে আসছে। পরিবারে তার ছিল বলিষ্ঠ অবস্থান, সবকিছু ছিল খুব দক্ষ। মাঝে মাঝে খুব অবাক হয়ে যেতাম যে- কিভাবে এতকিছু একসাথে পরিচালনা করতে পারে। তাই তখন থেকেই ভাবতাম, বড় হয়ে বাবার মতন হব। বাবা হবে আমার আদর্শ। আমার চলার পথের সঙ্গী আর সামনে দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
সম্পর্কের উন্নতিঃ
সব সময় প্রেরণা দিতে হবে- নতুন কিছু করার, ভাল কিছু করার। সততার, নৈতিকার বিষয়গুলো বুঝিয়ে ধীরে ধীরে সম্পর্ককে মজবুত করা যেতে পারে। সেইক্ষেত্রে মিথ্যা এবং কপটতা থেকে দূরে থাকতে হবে। যথাসম্ভব বাস্তববাদী এবং ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে হবে। প্রয়োজনে, উপযুক্ত সময়ে সেগুলো আপনার সন্তানের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। যাতে মেয়েটি বুঝতে শেখার পর সবকিছু সহজ করে নিতে পারে, প্রতিটি কাজে বুদ্ধিমত্তা এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে শুরু করতে পারে। খুব সাধারণভাবেই তার অনুভূতিগুলোর প্রতি যত্নশীল হতে হবে। চিন্তাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে, যে ব্যপারগুলোতে সে আগ্রহী ও কৌতূহলী সেই বিষয়ে সচেতন আচরণ প্রদর্শন করতে হবে। খেলা, গল্প, গান, ছড়া এসবের মাধ্যমে তার মনোজগতে প্রবেশ করতে হবে। খেলার ছলে তাকে বাস্তবিক ধারণা দিতে হবে। “না” শব্দটি উচ্চারণ না করে, বয়সের সাথে সাথে ভালো মন্দের পার্থক্য বুঝিয়ে দিতে হবে। স্পষ্ট, ইতিবাচক ধারণা দিয়ে- আত্মসম্মান উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আত্মবিশ্বাসী মনোভাব জাগ্রত করতে হবে। অনুপ্রেরণা দিয়ে নিজের দক্ষতা সম্বন্ধে নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতেঃ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোহিত কামাল বলেন- “অভিভাবককে সব-ব্যাপারে অবশ্যই সহনশীল হতে হবে। সন্তানের খেলার সাথী হয়ে, সময় দিতে হবে। আজকাল কম্পিউটার গেমসের যুগে, সাপ-লুডু খেলা একদম উঠে গেছে। কিন্তু আমি বলবো এসব খেলা বাচ্চাদের ধৈর্যশীল ও সহনশীল করে তোলে। সন্তান যতই বড় হয়ে উঠুক না কেন, তারা সব সময় চায় তাদের জীবনে অভিভাবকের উপস্থিতি এবং একটু যত্নশীল আচরণ। আর ভালোবাসা ছাড়া তো কোন ভালো কাজ, ভালো সৃষ্টি সম্ভব নয়। তাই সর্বোপরি, সব সম্পর্কে যেন ভালবাসার জয়।
-ইলোরা শারমিন