গ্রিক পুরাণ এক আলো-আঁধারের জগত। গ্রিক পুরাণের গল্পগুলো এতো বিস্ময়কর ও মন মোহনীয় যে যুগ যুগ ধরে মানুষ এগুলো প্রাণ ভরে শুনে আসছে। এইসব গল্প আমাদের যেমন মুগ্ধ করে, তেমনি চিন্তা ও চেতনায় ফেলে দারুন প্রভাব। গ্রিক পুরাণে ইকো ও নার্সিসাস বিস্ময়কর দুই চরিত্র।
জিউসের ছিলো পরনারীতে খুব আসক্তি। হেরা এটা পছন্দ করতেন না। তাই জিউসকে ধরার জন্য তিনি লাগিয়েছিলেন গুপ্তচর। একবার এক বনে জিউস মিলিত হয়েছিলো এক বননারীর সাথে। গুপ্তচররা তাকে প্রায় ধরেই ফেলেছিলো। কিন্তু বনদেবী ইকো, যার কণ্ঠছিলো অসাধারণ মধুময় আর কণ্ঠে ছড়াতে পারতেন মায়া। তিনি জিউসের প্রণয়নারীর কথার প্রতিধ্বনি তৈরি করে বিব্রম তৈরি করায় গুপ্তচররা জিউসকে আর হাতেনাতে ধরতে পারেনি। এতে স্বর্গরানী হেরা ক্ষিপ্ত হয়ে অভিশাপ দিলেন ইকোকে, তোর জিহ্বা এখন হতে আর কোন কথা উচ্চারণ করতে পারবে না।” সাথে সাথে বোবা হয়ে যায় ইকো। হয়তো সে চিরদিনের জন্যই বোবা হয়ে যেত, যদি না হেরা কথার সাথে জুড়ে দিতেন,”শুধু অন্যের কথার প্রতিধ্বনি করা ছাড়া।” আতঙ্কগ্রস্ত ইকো মনের অজান্তেই বলে উঠে, ”শুধু অন্যের কথার প্রতিধ্বনি করা ছাড়া?” নিজের মনের কথা বলার অধিকার হারিয়ে, ইকো মনের দুঃখে বনে-পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতো।
এইদিকে এক সুদর্শন যুবক ছিলো ‘নার্সিসাস’ নামের। তার রূপ সৌন্দর্যে পাগল ছিলো সব নারী। কিন্তু নার্সিসাস ছিলো অহঙ্কারি। কাউকে পাত্তা দিতো না। অথচ, নিজেকে সে কখনো দেখেওনি ভালো করে। তারপরও পুরুষ হয়ে তার রূপের দেমাক। কাউকেই সে নিজের যোগ্য ভাবতো না। যাইহোক একদিন বনে শিকারে গেলে নার্সিসাসকে দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে যায় ইকো। কিন্তু বেচারিরতো নিজের মনের কথা বলার শক্তি নাই। কী করে বলবে সে নার্সিসাসকে ‘ভালোবাসি’! একবার নার্সিসাস একা বনে শিকারে গেলে ইকো তার পেছনে পেছনে যায়। নার্সিসাস টের পায় যে কেউ একজন তার সাথে সাথে আসছে। সে চিৎকার করে জানতে চায়, এখানে কি কেউ আছে? ইকো প্রতিধ্বনি করে, ‘আছে, আছে, আছে...’। নার্সিসাস বলে, ‘তাহলে সামনে এসো।’ ইকো গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে দুহাত বাড়িয়ে প্রতিধ্বনি করে, ‘এসো, এসো, এসো...’ নার্সিসাস বুঝতে পারে ইকোর মনের কথা। কিন্তু যে কথা বলতে পারে না ভালো করে তার সাথে আবার কিসের প্রেম! নার্সিসাস মুখ ঝামটা দিলো, ‘আমার দেহে প্রাণ থাকতে, তুমি আমাকে পাবে না।’ কোন পাত্তাই দিলো না সে ইকোকে। ইকো মনের কষ্টে কেঁদে ফেললো। দেবতাদের কাছে দাবী জানালো, নার্সিসাস যেন প্রেমের না পাওয়ার কষ্টটুকু অনুধাবন করতে পারে। দেবতারা ইকোর কথা শুনলেন। নার্সিসাস হরিণ শিকার করার পর ক্লান্ত হয়ে পানি পানের জন্য এলো ডোনাকন নদীর তীরে। এই নদীর পানিতে কেউ কখনো স্পর্শ রাখেনি আগে। এতো স্বচ্ছ এর পানি যে তাতে আয়নার মতো ছায়া পড়ে নিজের।
এই প্রথম জলের প্রতিবিম্বে নিজেকে দেখলো নার্সিসাস আর প্রেমে পড়ে গেলো নিজের। এতো সুন্দর! সে চোখ ফেরাতে পারে না। অথচ ধরতে গেলে নেই। নিজের প্রেমে দ্বগ্ধ হয়ে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মরে যায় নার্সিসাস। নার্সিসাস মরে গেলে তার দেহের অধিকার পায় ইকো। কিন্তু ইকো নার্সিসাসের দেহ ছুঁতেই তা মাটিতে মিশে গিয়ে একটি ফুলগাছের জন্ম হলো। তাতে ধরলো শাদা শাদা রঙের ফুল, যে ফুলগুলো তাকিয়ে থাকতো পানিতে নিজের ছায়ার দিকে। আর নিজের ছায়া ধরার জন্য ঝরে পড়তো কিছুক্ষণের মাঝেই। সেই ফুলের নামও হলো নার্সিসাস। আমাদের দেশে অবশ্য নার্গিস নামে চিনি। নিজের কারণে নিজের প্রেমিকের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারে নাই হতভাগী ইকো। সে বেদনায় পাথর হয়ে যায়। আর হারিয়ে যায় এ পৃথিবী থেকে। কিন্তু বনে পাহাড়ে তার কণ্ঠ রয়ে গেছে; যার কারণে কেউ বনে-পাহাড়ে গিয়ে কথা বললে এখনো তার প্রতিধ্বনি শুনতে পায়।