তানভীর আশিক
তপোবনে মুনি কন্বের আশ্রমেই বেড়ে ওঠে শকুন্তলা। কন্বকে সে পিতা বলেই মানে। বন থেকে ফল সংগ্রহ করে কন্ব। বনের ফল আর ঝর্ণার জলে দু’টি প্রাণের দিন ভালোই কাটছিলো। দেখতে দেখতে ষোল বছর কেটে গেলো। শকুন্তলার বয়স হলো ষোল। বয়সের দুরন্তপনা আর শরীরে যৌবনের সৌন্দর্য।
বনের গাছ, পাখি ও আর আর প্রাণিও যেন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে শকুন্তলার সৌন্দর্যে। ছোট্ট একটা হরিণ শাবক তার খেলার সাথী। সারাদিন বনে ছোটাছুটি। ফুল তোলে মালা গাঁথা। ফুলের অলঙ্কার বানিয়ে শরীরে জড়িয়ে রাখা। আর ঝর্ণা থেকে একবেলা ঘটি ভরে জল নিয়ে আসাই তার কাজ।
একদিন শকুন্তলা পোষা হরিণ শাবকটিকে নিয়ে গভীর বনে গিয়েছিলো নতুন ঘ্রাণের ফুল আনতে। ফুল তোলে এক জলপাই গাছের নীচে বসে মালা গাঁথছিলো। হরিণ শাবকটি এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছিলো। হঠাৎ হরিণ শাবকটি অস্থির হয়ে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে আশ্রয় নিলো শকুন্তলার বুকে। ‘কী হয়েছে? ভয় পেয়েছিস কেন?’ বলে উঠে দাঁড়াতেই দেখলো ঝোঁপের আড়াল থেকে তীর ধনুক হাতে বের হয়ে এসেছে এক সুপুরুষ। গায়ে সুন্দর পোশাক, মিষ্টি একটা গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে যেন, সেই ঘ্রাণে মোহগ্রস্ত শকুন্তলা পুরুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে। পুরুষটির চোখে দৃষ্টি আটকে আছে তার। চোখ ফেরাতে পারে না শকুন্তলা। কথা ভুলে গেছে সে।
পুরুষটি আর কেউ নন। গান্ধারের রাজা দুষ্মন্ত। এসেছিলেন শিকারে। কিন্তু বনের মধ্যে এই রকম অপরূপ সুন্দরী কন্যার দেখা পাবেন তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। কন্যার রূপে তিনি সব ভুলে গেলেন। তার কাজলকালো দুটি চোখের গভীরে কী যেন আছে, কিছুতেই তিনি চোখ ফেরাতে পারছেন না। আর মেয়েটির শরীরে জড়ানো বুনো ফুল থেকে আসছে কামুক গন্ধ। তিনি উতলা হয়ে উঠলেন।
আসলে রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলা পরস্পর পরস্পরের প্রেমে পড়ে গেলেন প্রথম দেখাতেই। দুষ্মন্ত জানালেন, তিনি গান্ধারের রাজা। আর জানতে চাইলেন শকুন্তলার পরিচয়, কীভাবে এই গহীন বনে এই অপরূপ রূপসী কন্যার আগমন? শকুন্তলা তার পরিচয় দিলো। সব শুনে দুষ্মন্ত বললো, হে বনদেবী, অতুলনীয় রূপবতী, “তোমার রূপের অনলে তো আমি পুড়ে ছাই হয়ে গেলাম। এই ভিখারিকে প্রেম দাও, সিক্ত করো। না হয় তেষ্টায় মরে গেলে, এ মৃত্যুর দায় তো কন্যা তোমাকেই নিতে হবে।” শকুন্তলা রাজা দুষ্মন্তকে নিয়ে আশ্রমে গেলেন। জল পান করতে দিলেন। জলপান শেষে দুষ্মন্ত বললেন, জলে যে তৃষ্ণ মেটলো না সখি। আরো গভীর তৃষ্ণা বুকের ভেতর জমাট বেঁধে আছে তোমার রূপ-যৌবনের। শকুন্তলা জানালো, এই রকম তৃষ্ণা তারও বুকের ভেতর, ভেতরকার সমস্তই নিঙড়ে নিচ্ছে সে তৃষ্ণা। কিন্তু কিছুই তো করার নেই।
সমাধান দিলো রাজা, তবে চলো বিয়ে করি। কিন্তু কন্ব না আসা পর্যন্ত শকুন্তলা রাজী হচ্ছিলো না। শেষে দুষ্মন্তের জোরাজুরিতে গান্ধর্ব মতে দুষ্মন্তকে বিবাহ করতে শকুন্তলা রাজী হলো এই শর্তে যে, শকুন্তলার গর্ভজাত সন্তান সিংহাসনে বসবে। এরপর তারা মিলিত হলো।
কন্ব ফিরে এসে সব জেনে অমত করলেন না। রাজা দুষ্মন্ত কন্ব আশ্রমে কয়েকদিন কাটালেন। হঠাৎ খবর আসলো রাজধানী হস্তিনাপুরে শত্রু আক্রমণ করেছে। রাজা হন্তদন্ত হয়ে ছুটলেন। বিদায় নিলেন শকুন্তলার কাছ থেকে, কথা দিলেন খুব শীঘ্রই ফিরে এসে নিয়ে যাবেন শকুন্তলাকে রাজপ্রাসাদে। বিদায়ের সময় একটা চুম্বন এঁকে দিলেন শকুন্তলার কপালে আর নিজ হাতের আঙুল থেকে খুলে একটি রাজ অঙ্গুরীয় পরিয়ে দিলেন শকুন্তলার আঙুলে। তারপর চলে গেলেন।
শকুন্তলার খালি মন উদাস লাগে। কিছুতেই আর মন বসে না। অধীর অপেক্ষা তার, কবে ফিরে আসবে প্রাণনাথ! প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষায় দিন যায়, রাত যায়। শকুন্তলা গাছের পাতায় দুষ্মন্তকে চিঠি লেখে। তারপর নদীজলে ভাসিয়ে দেয়। যদি নদীতে ভাসতে ভাসতে সেই চিঠি দুষ্মন্তের কাছে পৌঁছে কোনদিন!
একদিন উদাস হয়ে বসেছিলো শকুন্তলা। ভাবছিলো রাজা দুষ্মন্তের কথা। তখন দুর্বাসা মুনি এলেন কন্বের আশ্রমে। শকুন্তলার সামনে দিয়ে তিনি গেলেন কিন্তু শকুন্তলা খেয়ালই করলো না। রেগে গেলেন মুনি দুর্বাসা। অভিশাপ দিলেন, যার কথা তুই এতো ভাবছিস তন্ময় হয়ে, সে-ই তোকে ভুলে যাবে। শকুন্তলার ঘোর ভাঙ্গলো। মুনির কাছে ক্ষমা চাইলো। শাপ ফিরিয়ে নিতে বললো। কিন্তু বলে ফেলা মুখের কথাতো আর ফিরিয়ে নেয়া যায় না। তিনি শুধু যোগ করলেন, তবে মনে পড়বে যদি কখনো তার দেয়া জিনিস তার সামনে তুলে ধরিস।
যাইহোক, বেশ কিছুদিন চলে গেলো। কন্ব বললেন, চল মা শকুন্তলা, আমরাই যাই রাজার কাছে। শকুন্তলাও যেতে রাজী হলো। তপোবন ছেড়ে যেতে কষ্ট হলো তার। এতো দিনের মায়া! গাছপালা, হরিণ, ফুলবন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শকুন্তলা কন্বের সাথে চললো হস্তিনাপুরের দিকে। দূরের পথ। পথে নদীতে স্নান করার সময় শকুন্তলার আঙুল থেকে খুলে নদীতে পড়ে গেলো দুষ্মন্তের দেয়া অঙ্গুরীয়। আর একটা মাছ এসে গিলে ফেললো সেটা। অনেক খুঁজলো শকুন্তলা কিন্তু পেলো না।
যাইহোক, বেশ কিছুদিন চলে গেলো। কন্ব বললেন, চল মা শকুন্তলা, আমরাই যাই রাজার কাছে। শকুন্তলাও যেতে রাজী হলো। তপোবন ছেড়ে যেতে কষ্ট হলো তার। এতো দিনের মায়া! গাছপালা, হরিণ, ফুলবন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শকুন্তলা কন্বের সাথে চললো হস্তিনাপুরের দিকে। দূরের পথ। পথে নদীতে স্নান করার সময় শকুন্তলার আঙুল থেকে খুলে নদীতে পড়ে গেলো দুষ্মন্তের দেয়া অঙ্গুরীয়। আর একটা মাছ এসে গিলে ফেললো সেটা। অনেক খুঁজলো শকুন্তলা কিন্তু পেলো না।
শেষে পৌঁছালো তারা দুষ্মন্তের দরবারে। কন্ব দরবারে বিস্তারিত জানালেন। কিন্তু সব ভুলে বসে আছে রাজা দুষ্মন্ত। কন্বের কথা বিশ্বাস করলেন না। বরং বিষয়টা নিয়ে তামাশা করে কন্ব আর শকুন্তলাকে প্রাসাদ থেকে বের করে দিলেন। অপমানিত হয়ে শকুন্তলাকে নিয়ে কন্ব আবার বনে ফিরে এলেন। শকুন্তলা এক পুত্রের জন্ম দিলেন। শৈশবেই এই শক্তিশালী পুত্র সকল প্রাণীকেই দমন করতে পারতো বলে— এর নাম রাখা হয় সর্বদমন। তার প্রিয় খেলা ছিলো সিংহের দাঁত গুনা। পরে অবশ্য দৈববাণী শুনে পুত্রের নাম রাখা হয় ভরত।
ঐদিকে এক জেলে নদী থেকে মাছ ধরলেন। আর মাছের পেটে পেলেন দুষ্মন্তের অঙ্গুরীয়। তাতে রাজার নাম লেখা দেখে জেলে তা নিয়ে ছুটে গেলেন রাজার কাছে। অঙ্গুরীয় দেখেই রাজার মনে পড়লো শকুন্তলার কথা। ছুটলেন তপোবনের দিকে। কন্বের আশ্রমে গিয়ে দেখলেন কেউ নেই। কারণ কন্ব আর এই আশ্রমে ফিরে নি। বনের অন্য ধারে আশ্রম করেছেন নতুন। দুষ্মন্ত সারা বন তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন পাগলের মতো। খুঁজতে খুঁজতে এক স্থানে দেখলেন এক সাহসী বালক সিংহের দাঁত গুনছে। তিনি বালককে জিজ্ঞেস করলেন, বালক, কে তুমি? এতো সাহস আর শক্তি যে বনের সিংহও তোমাকে সমীহ করে! বালক জবাব দিলো, আমি গান্ধার রাজ দুষ্মন্তের ছেলে ভরত। ছেলের সন্ধান পেয়ে আপ্লুত রাজা ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘পুত্র ভরত, আমিই তোমার সেই অভাগা পিতা। তোমাদের সারা বনে খুঁজে ফিরছি।’ ভরত পিতাকে শকুন্তলার কাছে নিয়ে গেলো। মিলন হলো দুষ্মন্তের সাথে শকুন্তলার। রাজা স্ত্রী-পুত্রকে সাথে নিয়ে ফিরে এলেন রাজপ্রাসাদে।
পরবর্তীতে ভরতই হলো সম্রাট। যার নামে গড়ে উঠলো বিশাল একটি সাম্রাজ্য, ভারত।