অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
অ
শীতের রাত। চারদিকে খুব ঘন কুয়াসা। এমনিতেই রাত তদুপরি ঘন কুয়াসা নিকটের অনেক কিছুই যেন আড়াল করার নিরন্তর পাঁয়তারায় নেমেছে। এমন হার কাঁপানো শীতে হালকা একটি পোশাক পরিধান করে টিউশনি করতে যায় শিশির। বয়স তেইশের কোঠা ছুঁই ছুঁই করছে। ছাত্র হিসেবেও বেশ মেধাবী। পারিবারিক শত অভাব-অনটন থাকার পরও কেবল প্রবল আত্ম-প্রচেষ্টার কারণে লেখাপড়াতে এখনো টিকে আছে। রাতে টিউশনি শেষ করে শিশির খুব দ্রুত বাসায় ফেরার চেষ্টা করে। আজ রাতের মধ্যেই এ্যাসাইনমেন্ট সম্পূর্ণ করতে হবে। অর্পিতাও আগামীকাল সকাল সকাল আসবে। ঘনিষ্ঠ বান্দবী। পুরনো দেনা-পাওনায় খাতা ভরে আছে। একটা পরিশোধ হয় তো অপরটা এসে হাজির। এসব প্রাত্যহিক সমস্যা সমাধান করতে প্রায়ই তাকে হিমশিম খেতে হয়। নানা প্রতিকূলতায় নিদ্রাদেবী প্রায় রাতেই তার কাছ থেকে বিদায় নেয়।
তড়িঘড়ি করে ফেরার চেষ্টা করে কিন্তু পেরে ওঠে না। হঠাৎ পথিমধ্যে পুরনো বন্ধু হিমেলের সাথে দেখা হয়। হিমেলকে দেখামাত্রই সে ঘামতে শুরু করে। বোধকরি পুরনো ঋণ সঠিক সময়ে পরিশোধ করতে না পারাতেই তার ভেতর লজ্জা আর অনুতাপের ছায়া উথলে ওঠেছে। হিমেল হাত মুসাফা করে বলে-কি রে শিশির ! ভাল আছিস ? যোগাযোগ যে একবারেই রাখিস না,কোন অসুখ- টসুকে পড়িছিলি নাকি?
-না মানে এই একটু স্বর্দি জ্বর-টর আর কি !
-তুই অসুস্থ ; আর একটাবার পর্যন্ত খবরও দিলি না। হায় রে বন্ধু! সত্যিই তুই অনেকটা বদলে গেছিস রে !
-হয়ত! তোর ... ... ... (টাকার) ব্যাপারটা আমি খুব দ্রুত চেষ্টা করব।
-তুই তো ঘেমে উঠছিস,যা দ্রুত বাসায় যা ; আগে সুস্থ হয়ে ওঠ,পরে তা দেখা যাবে ।
শিশির বিদায় নিয়ে খুব দ্রুত হেঁটে চলল। চারিদিকে প্রগাঢ় অন্ধকার। ঝিঁ ঝিঁ পোকার লেশও নেই। শহরের ভূত-প্রেতও কম। বড় বড় বটগাছ , ডাব গাছ, ঘন অরণ্য নেই তো - তাই হয়ত ভূত-প্রেতের উৎপাতও কম! শিশির তথ্যানুসন্ধানী, বাস্তববাদী, আধুনিক মানুষ। ওসব অপবিশ্বাস কখনোই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। বহর আবাসিক এলাকার ভিতরের নিস্তব্দ গলি থেকে বেরিয়ে বিশ্বরোডে এসে পৌঁছায়। ফিরতি পথের গাড়ির জন্য অপেক্ষা করে। মাঝে মধ্যেই ট্রাকের কর্কশ শব্দ শোনা যায়। অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করার পরও কোন গাড়ি মিলল না। যাও বা দু একটা সিএনজি এসে থামায় তাও তাদের গন্তব্য ততদূর নয়।
আ
জীবনের সাথে হিসাব মিলাতে চেষ্টা করে সে। যেদিনই তার এমন তাড়া থাকে সেদিনই সে এমন যান্ত্রিক বিড়ম্বনায় পড়ে। প্রকৃতি কি তার উপর কোন কারণে অসন্তুষ্ট? জীবনে অনেক কিছুই সে পায় নি,আবার অনেক কিছু সে পেয়েও গ্রহণ করে নি। হয়ত তা নৈতিকতা বিরোধী ছিল ! কিন্তু কোন দিন ক্ষণিক মূহূর্তের জন্যও অপূর্ণতার রোদনে সে হাই- হুতাশ করে নি। তার কোন কিছু পাওয়ার আনন্দও নেই, আবার তা হারানোর বেদনাও নেই। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ একটি সিএনজি এসে থামে। তড়িঘড়ি করে সে তার ভেতরে উঠে পড়ে।
সিএনজিতে একজন মধ্যবয়সী মহিলা রোগী এবং একজন দশ- বার বছর বয়সী ছেলেও ছিল। ছেলের সাথে কথায় কথায় জানা গেল রোগী তার মা এবং সিএনজি চালক তার বাবা। সিএনজি খুব দ্রুত চলছে। প্রায় মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গাড়ি টিলাগড় এসে পৌছল। পৌছামাত্রই বিদ্যুৎ চলে যায়। প্যান্টের ডান পকেট থেকে মোড়ানো একটি নোট বের করে চালককে দিল। সাম্প্রতিক মানিব্যাগটি হারিয়ে যাওয়ার পর আর মানিব্যাগ কেনা হয়ে উঠে নি। চালকের হাতে সময় কম ছিল বলে কত দিয়েছে তা দেখার প্রয়োজনও বোধ করে নি।
টিলাগড়ে প্রচন্ড কুয়াশা পড়েছে। হাড় কাপানো শীত! চারদিকে ভূতুরে অন্ধকার। কেমন একটা থমথমে ভাব। শিশির হেঁটে হেঁটে স্টেশনারি দোকানে গেল এ্যাসাইনমেন্ট লেখার খাতা কেনার জন্য। খাতার দাম দিতে গিয়েই এক হোঁচট খেল সে। প্যান্টের বাম পকেটে হাত দিয়ে দেখে সেখানে মাত্র পাঁচ টাকা ! দোকানদারকে কিছু না বলেই সে বেরিয়ে যায়। ডান পকেটে এক হাজার টাকার তিনটি নোট মোড়ানো ছিল। পরীক্ষার ফ্রম ফিলাপের জন্য সঞ্চিত টাকা। চালককে দেওয়ার কথা ছিল বাম পকেটের টাকা ; কিন্তু ভুলবশত ডান পকেটের টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। ডান পকেটে হাত দিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের রূপরেখা তার মাথায় ঢেউ খেলে যায়। ধীর পায়ে সে বাসার দিকে হেঁটে চলে। ক্রমেই গভীর হয়ে ওঠে রাত। নীরব নিস্তব্দ রাত।
মুনশি আলিম
জাফলং, গোয়াইনঘাট, সিলেট