অ
ইমরান সাহেব বললেন-এই যে, শুনুন
- জি বলেন
- নদীর ঐ পাড়ের এলাকাকে কী বলে?
- সংগ্রামপুঞ্জি
- ঐটাকে
- জিরো পয়েন্ট
- আর ঐটাকে খাসিয়া জুম
জাফলং পিকনিক স্পটে ঢাকা থেকে আগত এক দম্পত্তিকে দর্শনীয় বিভিন্ন লোকেশন দেখানোকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মিঠুনের বেশ একটা হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। ঢাকা থেকে আগন্তুক ভদ্রলোকের নাম ইমরান চৌধুরী। ইমরান সাহেব কথায় কথায় মিঠুন ও তার পরিবার সম্পর্কে জেনে নেয়। মিঠুনের পড়াশোনা তেমন একটা হয়ে ওঠে নি। প্রায় বছর দশেক আগে এই এলাকারই এক কালো মেয়েকে সে যৌতুক নিয়ে বিয়ে করে। যৌতুকের টাকায় শুরু করে পাথর ব্যবসা। প্রথম প্রথম ব্যবসাতে লাভের মুখ দেখলেও কয়েক বছর থেকে তার ক্ষতির পরিমাণটাও চোখে পড়ার মত। এবার লস হলে তাকে যেন পথে বসতে হবে। নিজের ব্যবসার লোকসান নিয়েও অবলীলায় ভদ্রলোকের সাথে খানিকটা দুঃখ প্রকাশ করল মিঠুন।
ভদ্রলোক মিঠুনের প্রত্যেকটা কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে। মিঠুনের মানসিক অবস্থা বুঝার চেষ্টা করে। ভদ্রলোকের উৎসাহে মিঠুন একের পর এক বলেই চলে তার জীবনের বিভিন্ন সংকট ও ভাবি স্বপ্নের কথা। শেষটায় ভদ্রলোক মিঠুনকে সান্ত¡না দেয় এবং তার সকল সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেয়। ইমরান সাহেব মিঠুনকে ধর্মের ছেলে হিশেবে মুহূর্তইে নতুন সম্পর্ক তৈরি করে ফেলে। মিঠুন পুলকিত হয়। তার চোখে মুখে সারাদিনের সমস্ত গ্লানি মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যায়। হঠাৎ ৪০ লক্ষ টাকার লটারি পাওয়ার খবর শুনলে যেমন মানুষ খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় তেমনি অবস্থা মিঠুনের! আজ এ মুহূর্তে সে নিজেকে পৃথিবীর সেরা সুখী মনে করছে। আজকের পৃথিবীটা তার কাছে মনে হচ্ছে সত্যিই অন্য রকম। তার সমস্ত হৃদয় জুড়েই যেন উৎফুল্লতার জোয়ার বইতে লাগলো। ভদ্রলোকের স্ত্রী জমিলা চৌধুরীও তাকে ছেলে হিশেবে গ্রহণ করে। মিঠুন আনন্দে গদগদ হয়ে দুজনকেই পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে। এরপর তাদের কথা চলতেই থাকে।
মিঠুন বিদেশ যাবে। পাঁচ লাখ টাকা তার সংগ্রহে আছে। বাকী তিন লাখ টাকার জন্য তার ইতালি যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ইমরান সাহেব চোখে মুখে বেশ একটা নির্ভরতার হাসি এনে বলে-“আমিই তোমার সব ব্যবস্থা করে দেব।” কথাটি শুনামাত্রই মিঠুনের মনে হল এই রকম খাঁটি দরদী মানুষ পৃথিবীতে মেলা ভার। ভদ্রলোককে এই মুহূর্তে কয়েক লক্ষবার পা ছুঁয়ে সালাম করতে ইচ্ছে করছে তার কিন্তু চক্ষু লজ্জার করাণে তা আর করা হয়ে ওঠলো না। কেবল সকৃতজ্ঞ বিষ্ময়ী দৃষ্টিতে অবনত নেত্রে তাকিয়ে রইল।
আ
বিকেল বেলা। মিঠুন ইমরান দ¤পত্তিকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। সূর্য তখন অনেকটাই পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। আজ আকাশের সাদামেঘগুলোকে তার কাছে মনে হল সবচেয়ে পবিত্র। পিকনিক ¯পট থেকে তার বাড়ির দূরত্ব প্রায় ৩ কিলোমিটার। নদী পাড়ি দিয়ে সড়ক পথে তাদের যেতে হয়। নিচু আর বন্যা প্লাবিত এলাকা বলে রাস্তা-ঘাটেরও বিশেষ কোন উন্নতি হয় নি। নদী পথও শুকনো। যাওয়ার একমাত্র যান হল মোটর সাইকেল। বিকল্প কোন যান না থাকায় অগ্যতা মোটরসাইকেলে করেই তাদের বাড়ি যেতে হল। মিঠুনের ঘরে সুটকোট ও দামি শাড়ি পরিহিত দ¤পতি প্রবেশকালে অনেকেরই নজর কাড়ল।
অনেকেই কানাকানি শুরু করে দিল। কেউ কেউ কৌতূহল সংবরণ না করতে পেরে বলেই ফেলল- “লগে কেডা গো ময়নার বাফ? তানারা তোমার কী অয়?”
-বাবা-মা
সম্পর্কটি অপ্রত্যাশিত বিধায়ই প্রতিবেশী রানু বুড়ি একটু ব্যঙ্গ করে বলে- “আমরা তো জানি তোমার বাপ-মা হেই কবেই মইররা গ্যাছে; আবারও কব্বর থাইক্ক্যা বাইচ্চা...?
বুড়ির কথায় করিমের খুব রাগ হচ্ছিল কিন্তু নিজেকে দূঢ়তায় সংযত করে মুখে একটু কৃত্রিম হাসি এনে বলল- নানি, তুমি ভুল বুইঝ না; ওনারা আমারে ধর্ম ছেলে বানাইছে। ওনাদের বড় পোলা নাকি দেখতে ঠিক আমার মতন... তাই...!
-ও অহন বুঝছি।
মিঠুন রানু বুড়িকে সংযত চিত্তে উত্তর করলো বটে কিন্তু তার স্ত্রী রোকেয়া বুড়িকে নিছক অপমান করার স্বরে ঈষৎ চেঁচিয়ে বলল- “তুমার এত বুঝা বুঝির কি আছে... অ্যা? খাইয়্যা তুমার আর কোন কাম নাই? যাও নিজের ঘরে কাম কর গিয়া। কুটনী বুড়ি কোহানকার!”
অপমানের কাদা ছুড়তে গিয়ে রানু বুড়ি নিজেই যেন অনেকটা লেপ্টে গেল। অনেকটা অসতর্কভাবে উপরের দিকে থু থু নিক্ষেপ করলে যেমন নিজের শরীরে এসে পড়ে তেমনি আর কি! রোকেয়ার ঝাঝালো কথায় বুড়ির চোখ-মুখ লাল হয়ে ওঠলো। তারপর কী যেন গড়গড় করে বলতে বলতে চলে গেল। রোকেয়ার এরূপ আচরণ প্রতিবেশী অনেকেরই দৃষ্টিগোচর হল। অবশ্য তার এরূপ আচরণ নতুন কিছু নয়। যাইহোক, এরপর আর কেউ কোনরূপ প্রশ্ন করার সাহস করে নি।
সন্ধ্যা হতেই করিম তার সন্তানের পালিত মোরগটি জবাই করে। পোলাও নুডুস থেকে শুরু করে বিভিন্ন উন্নতমানের আপ্যায়নের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে থাকে। রাত একটু গভীর হলে ইমরান সাহেব মিঠুন ও তার স্ত্রী রোকেয়াকে দরজা ভালভাবে লাগিয়ে তাদের কাছে যেতে বলে। মনে হচ্ছে পীরদের মত গোপন তালিম দিবে। অজ্ঞাত কিছু পাওয়ার আশায় মিঠুন ও রোকেয়া পিতৃভক্ত শিশুর মত তাই-ই করে। ভদ্রলোক গম্ভীর স্বরে বলে-“আমি তোমাদের টাকা বানানোর কৌশল শিখিয়ে দেব তবে-”
-“তবে কী?” উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বলে মিঠুন।
-“এই কৌশল ও সরঞ্জামাদি অন্য কাউকে বলাও যাবে না, দেয়াও যাবে না। পবিত্র কোরআন শরীফে হাত রেখে তোমাদের দুজনকে শপথ করতে হবে।”
পাছে কোন গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যায় এই ভয়েই ইমরান সাহেব কোরআনের দোহাই দিয়ে এই
কৌশল আঁটলেন।
বলো- “এই শর্তে রাজি?”
মিঠুন ও রোকেয়া দুজন দুজনার দিকে তাকায়। রোকেয়া মিঠুনকে হাত টিপে ইশারা করে রাজি হওয়ার। তাপর দুজনেই সমস্বরে বলে- “হ্ রাজি।”
যেই কথা সেই কাজ। কোরআন আনা হল। মিঠুন ও রোকেয়া অজু করে আসে। ওরাও খুব উৎফুল্ল হয়ে কোরআনে হাত রেখে শপথ করে। তারা দুজন যেমন ধর্মান্ধ তেমনি লোভী। মানুষকে ঘায়েল করতে হলে ধর্মীয় অস্ত্রের যেন বিকল্প নেই! এই তত্ত্বটি ভাল করেই জানা ছিল ইমরান সাহেবের। প্রথমটায় তাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু তিনি কিছু টাকা যখন তাদের সামনেই তৈরি করে দেখালেন তখন ওদের বিশ্বাস খুব গাঢ় হয়। খুশিতে তাদের চোখ-মুখ আনন্দে চকচক করে ওঠে। এ যেন হাতের মুঠোয় চাঁদ পাওয়ার মত অবস্থা আর কি! ইমরান সাহেব বলতে থাকেন-“এই প্রক্রিয়ায় তোমরা যত টাকা বানাতে চাও তত টাকাই বানাতে পারবে; তবে সম পরিমাণ আসল টাকা ও সমভাবে সাদা কাগজ লাগবে। যদি তোমরা আজ পাঁচ লাখ টাকা সংগ্রহ করতে পারো তবে আমি পাঁচ লাখ টাকাই তৈরি করে দেব, ... এরপর নিশ্চয়ই আর বিদেশ যেতে টাকার সমস্যা হওয়ার কথা নয়।”
রোকেয়া কিছুটা উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বলে- আইজক্যা রাইতেই?
-হ্যা, কেননা আগামিকালই আমাদের চলে যেতে হবে।
মিঠুন এ ব্যাপারে একটু উদাসীন। তবে জনৈক মুসল্লির মত সিরনি দেখলে সামনে যায় আবার ইমাম দেখলে পিছায়-এই মুহূর্তে এমনই অবস্থা তার। লোভের দৌরাত্ম এবং সেই সাথে অপার বিষ্ময় উভয়ই তার ভেতর সমভাবে কাজ করতে লাগলো। কিন্তু এতদ্বদৃষ্টে তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে তার যেন পাওয়ার আনন্দও নেই আবার তা হারানোর বেদনাও নেই। রোকেয়া কিন্তু ঠিকই উৎফুল্ল বোধ করলো। দূরদর্শী নারীদের মত রোকেয়া মিঠুনকে আড়ালে ডেকে নিয়ে যায়। সোহাগভরে জড়িয়ে ধরে ওষ্ঠে একটি লম্বা চুমু খেয়ে শান্ত স্বরে বলল-“কি অত চিন্তা করতাছ?”
-“না কিছু না।”
মিঠুন এ ব্যাপারে একটু ভীত ও উদাসীন হলেও রোকেয়া কিন্তু খুবই সিরিয়াস। কোনভাবেই সে এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। কেননা পাঁচ লাখ টাকা সংগ্রহ করতে পারলে আজ রাতেই তারা হয়ে যাবে আরও পাঁচ লাখ টাকার মালিক! মানে রাতারাতি বড়লোক! তখন আর তাদের নাগাল পায় কে! কথাটি ভাবতেই তার মনে আবারও সুখের পরশা ঢেউ খেল যায়। রোকেয়া পুনঃ বলে- “তয় যাও- হাতেম ভাই, ফারুকের মা, হাসিম গো সুমতি থাইক্যা টেকা পাইবা। আর তাছাড়া আমাগো কাছে তো তিন লাখের মত টেকা আছেই। তুমি আর না কইরো না।”
বলেই সে মিঠুনের দুই হাত চেপে ধরে। স্বার্থ উদ্ধারের সকল কৌশলই মোটামুটি তার ভাল জানা আছে। মিঠুন রোকেয়াকে এতই ভালবাসে যে, শত কষ্ট হলেও সে কখনো না করতে পারে না। মিঠুন ফ্যাল ফ্যাল করে রোকেয়ার দিকে তাকায়। খানিক পর কি ভেবে যেন স্ত্রী ভক্ত স্বামীর মত নিরীহ কণ্ঠে বলে- যাব?
রোকেয়া করিমের ঠোঁটে পুনঃ চুম্বন খেয়ে বলে- “যাও।”
ই
রাত তখন সাড়ে দশটা। কিন্তু এরই মধ্যে যেন সমস্ত গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে। গ্রামের লোকেরা সন্ধ্যার সাথে সাথেই খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত নয়টা থেকে দশটার মধ্যেই মনে হবে সমস্ত গ্রাম যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মিঠুন টাকা সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে যায়। রোকেয়া প্রহরের পর প্রহর গুণতে থাকে। অবশেষে রাত প্রায় বারটার সময় মিঠুন বাড়ি ফিরে আসে। পুরো দু লাখ সে সংগ্রহ করতে পারে নি। তবে শোধের উপর এবং শহিদ মুক্তিযোদ্ধা বাবার শেষ সম্বল তেত্রিশ শতক জায়গা বন্ধক রেখে একলাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা সে সংগ্রহ করেছে। সর্বমোট সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়ে মধ্যরাতে শুরু হল তাদের টাকা তৈরির খেলা। টাকা তৈরির জন্য টাকার মাপে সাদা কাগজ কাটতে হয়। ইমরান সাহেব টাকা তৈরির মেশিন এবং কি সব বিদেশি মেডিসিনও নিয়ে এসেছেন তার ব্রিফকেসের ভেতর। ঐ মেডিসিন মেশিনের ভিতরে প্রবেশ করালে মুহূর্তেই সাদা কাগজকে রঙিন টাকায় পরিণত করে ফেলে। এভাবে কাগজ কেটে সারারাত চলল তাদের টাকা তৈরির কাজ।
পরদিন। ভোর বেলা। পাড়াগাঁয়ে কোন বাড়িতে ভদ্রলোকের আগমন ঘটলে এমনি এমনিতেই সারা গ্রামে সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল বিকেলের মধ্যেই মিঠুনের বাড়িতে এক কোটিপতি দ¤পত্তির আগমন ঘটেছে এমন খবর কে বা কার মাধ্যমে যেন সমস্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। রাতে সম্ভব না হলেও খবর পেয়ে মিঠুনের নিকট আত্মীয় ও দুস¤পর্কের অনেক আত্মীয়ও আত্মীয়তার স¤পর্ক সুদৃঢ় করার জন্য ও ভদ্রলোক দ¤পত্তির সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য কাকডাকা ভোরে এসে হাজির হয়। গ্রামের অনেক শুভাকাঙ্খি, প্রতিবেশীরাও কোটিপতি দ¤পতির সাথে পরিচিত হতে চায়। মানুষের ভীর যেন ক্রমেই বাড়ছে। গ্রামদেশে নতুন বিয়ের পর যেমন নতুন বউকে দেখার জন্য এলাকার মানুষজন ভীর করে তেমনি কোটিপতি
দ¤পত্তিকে দেখার জন্যও মানুষের ভীর যেন ক্রমেই বাড়ছে। বিষয়টি সুনজরে নেন নি মিঠুনের স্ত্রী রোকেয়া। কেননা, আত্মীয়-স্বজন কিংবা প্রতিবেশী কেউ রুমে প্রবেশ করলে তাদের বড়লোক হওয়ার সব স্বপ্নেরই মাটি হতে পারে এমনটি ভেবে রোকেয়া একটুও ছাড় দিতে রাজি নয়। সে কাউকেই রুমে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। “মানুষের বাড়িতে কি মানুষ আহে না, আমরা কি কোন মাগির ঘরে ডুসকি মারবার যাই, পাড়ার মাগিরা আমার বাড়িতে আহে ক্যা! মাগিগো ফাল দেইক্ক্যা গা জ¦লতাছে।” এমনি শ্রাব্য-অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগলো। প্রতিবেশীরা লজ্জা পেয়ে, মনক্ষুণœ হয়ে নীরবে গজরাতে গজরাতে একে একে যে যার বাড়িতে চলে যায়। রোকেয়ার স্বভাব আগে থেকেই অনেকটা এরকমই। কেমন যেন তার ভেতর অহমিকা ভাব সেই সাথে বদমেজাজিও। যাকে তার পছন্দ হয় তার সাথে খুব মধুর ব্যবহার করবে আর যাকে পছন্দ নয়, তার সাথে এরকমই দুর্ব্যবহার করে। বড়ই বিচিত্র প্রকৃতির মানুষ সে।
সকাল নয়টায় রান্না করতে যায় রোকেয়া। টাকা তৈরি করা শেষ। এখন শুধু তাপ দিয়ে সেগুলো শুকাতে হবে। কিন্তু বাহিরে তো তা বের করে রোদে দেয়া সম্ভব নয়। কাজেই বিকল্প উপায় হিসেবে রুমে তুষের আগুন জ্বালিয়ে মিঠুন তাপ দিয়ে চলছে নিরলস গতিতে। ডিম ফুটানোর জন্য মুরগি যেমন তাপ দেয় তেমনি আর কি!
সকালে ছোট মোরগটি জবাই করা হল। বিভিন্ন জাতের খাবার, পিঠা, পায়েস তৈরি হল। মিঠুনের এ ভাঙ্গা কুটিরে কোটিপতি দ¤পতির আগমন যেন- গরিবের বাড়িতে হাতির পা দেয়ার মতই ঘটনা। খাওয়ার সময় রান চিবুতে চিবুতে ইমরান সাহেব বললেন- “আহ! কী মজাদার রান্না। তোমার হাত বেশ পাকা। ঠিক আমার বড় মেয়ে শায়লার মত।” ইমরান সাহেব খেতে খেতে এরকম বিভিন্ন প্রশংসা করতে থাকে। রোকেয়াও তখন আনন্দে গদগদ হয়ে বলে- আপনারে আরেকটু দেই... একটু... আরেকটু.... একবার দেওন লাগে না। বেশ আন্তরিকতার মধ্য দিয়েই খাওয়ার পর্ব শেষ হল। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ইমরান দ¤পত্তি বিছানায় গেলেন। তারা দুজনে নিভৃতে কি যেন কথা বললেন।
বিকেল তিনটা। কিন্তু এখনো কাজই যেন শেষ হচ্ছে না। টাকাগুলো কয়েকবার মেডিসিনে ভিজানো হচ্ছে এবং পরে তাপ দিয়ে শুকানো হচ্ছে। বার ঘণ্টা এভাবে তাপ দিলে আর শুকালে টাকাগুলো একেবারেই প্রকৃত টাকা হয়ে যাবে। সাড়ে তিনটা বাজতেই জমিলা চৌধুরী বিদায় নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।
এবার যাওয়ার পালা। অবশেষে মিঠুন রোকেয়াকে টাকা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে নিজে ভদ্রলোক দ¤পত্তিকে বিদায় দেওয়ার জন্য জাফলং এসে একটি প্রাইভেটকার ভাড়া করে গাড়িতে তুলে দেয়। গাড়ি ছাড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ইমরান সাহেব একটুকরো কাগজে তার বাসার ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার দেয়। কাগজটি মিঠুনের হাতে দিয়ে বেশ কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে বলে- “বাবা মিঠুন, তুমি কিন্তু বিদেশ যাওয়ার আগে অবশ্যই আমার সাথে দেখা করবা।”
-“জি আইচ্ছা।”
ভদ্রলোক মিঠুনের মাথায় হাত রেখে আর্শীবাদ করে বিদায় নেয়।
ঈ
গাড়ি চলতে থাকে। মিনিট দুয়েক পরই গাড়িটি চোখের আড়াল হয়ে যায়। গাড়ি আড়াল হওয়ার পর মিঠুন উাদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশে তখন সাদা মেঘের ভেলাগুলো যেন ছায়ামূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। স্রষ্টার কী মহিমা, তিনি মুহূর্তেই যে কাউকে গরিব থেকে বড়লোক করতে পারে আবার মুহূর্তেই... বাকীটা সে আর মনে করতে চায় না। অমঙ্গল ডেকে আনতে চায় না বলে! স্রষ্টাকে শতবার কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ দিতে থাকে। উৎফুল্ল মনে সে সন্তানদের জন্য, স্ত্রীর জন্য কাপড়-চোপড় কিনে। মাংস কিনে, সেমাই কিনে আরও কত কী! আজ তার শুধু কিনতেই ইচ্ছে করছে। নিন্দুক রানু বুড়রি জন্য কাপড় কিনতেও তার এতটুকু ভুল হয় নি। এভাবে বাজার করতে করতে প্রায় ঘণ্টা দুই কেটে যায়। বহু বাজার সওদা করে সন্ধ্যার সাথে সাথেই সে তার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। বাড়ির আঙিনায় পা রাখতেই সে রোকেয়ার চিৎকার শুনতে পেল। সওদা রেখে দৌঁড়ে ঘরে ঢুকার চেষ্টা করে। কিন্তু এতই ভীর যে ঘরে ঢুকতে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পুরো গ্রামের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি মানুষ তার বাড়িতে জড়ো হয়ে গেছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যেন কোন খ্যাতিমান লোকের মৃত্যু হয়েছে।
প্রতিবেশীদের কয়েকজন রোকেয়ার মাথায় পানি ঢালছে। একটু পরপরই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। করিম ভীর ঠেলে ঘরে ঢুকেই দেখে সাদা কাগজের বাণ্ডিলের ছড়াছড়ি! রোকেয়া মাটিতে
বসা ছিল। দৌঁড়ে উঠে এসে করিমের পায়ে পড়ে চিৎকার করে বলতে থাকে-“ওগো, আমাগো সব সর্বনাশ অইয়্যা গ্যাছে। আমাগো আসল টেকাডিও খুঁইজ্জা পাই না, আর যেইগুলা টেকা অইবার কথা হেইগুলা সবডিই কাগজ অইয়্যা গ্যাছে।”
করিম চোখ কপালে তুলার মত অবস্থা করে বলে- কও কী? ঘরের সব জায়গায় খুইজ্জা দেখছ?
-হ
করিম উন্মাদের মত দ্রুত গতিতে ঘরের সবকিছু তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকে। শেষ পর্যন্ত কোথাও না পেয়ে টাকার শোকে আর পাওনাদারদের ভাবি চাপের কথা ভেবে ধপাস করে মাটির মাঝে বসে
পড়ে। হতাশার তীব্রতায় তার মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে গেল-“ক্যান এই লোভ করবার গেলাম?”
কোন কোন ক্ষুব্ধ প্রতিবেশী পুরনো অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার রেশ ধরে ঈষৎ জোরেই বলছে- “যা অইবার বালই অইছে। অহন মাগির কিছু দেমাক কমবো!”
রানু বুড়িও আজকের এই সুযোগে রোকেয়ার আগের দিনের উক্তি তাকেই পুনঃ শুনিয়ে ব্যঙ্গ করে বলল- “আমাগো তো খাইয়্যা কোন কাম নাই মাইনশের কান্দন হুনার- আয় লো ফুলমালা!”
বলেই সে তার নাতনি ফুলমালাকে একরমক টেনে নিয়ে যায়। ফুলমালা কী একটা বলতে গিয়েও যেন আর বলতে পারলো না। মিঠুন গালে হাত দিয়ে নির্বিকারভাবে বুড়ির চলে যাওয়া দেখল। খানিকপর তাদের দুএকজন নিকটাত্মীয় ব্যতিত অন্য সকলেই একে একে চলে যায়।
মিঠুনের বাড়িটা এতক্ষণ মাছ বাজারের মতই গমগম করছিল। এখন যেন মনে হচ্ছে মৃত বাড়ির মতই শোকাবহ, গভীর রাতের মতই শব্দহীন। রোকেয়ার উচ্চ স্বরের কান্নাও এতক্ষণে শ্লথ হতে হতে এক সময় থেমে যায়। এখন সে শুধু একটু পর পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অবশ্য কেউ কেউ তখনও তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। মিঠুনের হঠাৎ মনে হল ইমরান সাহেবের ঠিকানার কথা। মনে হতেই সে পুনঃ পুলকিত বোধ করে। দুঃখের এই ক্লান্তিলগ্নে হঠাৎ যেন সুখের পরশা! আশার আলোতে মুহূর্তেই তার চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে ওঠে। কিন্তু পকেটে হাত দিতেই তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন হু হু করে কেঁদে ওঠে। দুঃখে, ক্রোধে সে তার নিজের চুলগুলো নিজেই টানতে শুরু করে। হতাশার তীব্রতায় তার চোখ বেয়ে অন্ধকার নামে রাতের মত।
সারাদিন প্রচণ্ড গরম ছিল। বিকেল বেলাতে সেই গরমের লেশ পুরোপুরিই কেটে গেল গেল উন্মত্ত বাতাসে। চারদিকে গোধূলীর লালিমা কেটে ক্রমেই আঁধার ঘনিয়ে এল। সুনীল আকাশ কয়েক
মুহূর্তেই কালোমেঘেরা ছেয়ে ফেলল। একটু পরেই ঈষাণ কোণ থেকে নেমে এল বৃষ্টি। তৃষ্ণার্ত প্রকৃতির তৃষ্ণা মিটাতেই যেন তার আগমন! অঝর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। বিরতিহীন গতিতে বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই।
মুনশি আলিম
বোরহানবাগ, শিবগঞ্জ, সিলেট