পড়ন্ত বিকেল। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। সৈকত সিলেটের প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সিএনজির অপেক্ষা করছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক হয়ে যায় সে কোন সিএনজি কিংবা রিক্সারও সন্ধান করতে পারলো না। অথচ অন্যসব দিনগুলোতে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত এখানে মানুষের কর্মকোলাহল লেগেই থাকে। অবশ্য এদিন হরতাল হওয়ার কারণেই এত বিড়ম্বনা! আশে পাশে যে দু-একটা রিক্সা চোখে পড়ছিল তাও ছিল পেসে›জারে পূর্ণ। ওর নিজের ওপর নিজের খুব রাগ হতে লাগলো। ভাগ্যকে দোষারোপ করতে লাগলো। অভাবি পরিবারের লোকজন যেমন কেবল কলহে লিপ্ত থাকে অর্থাৎ একে অপরকে কেবল দোষারূপ করে তেমনি মানুষ প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হতে থাকলেও নিজের ভাগ্যকে দোষারূপ করতে থাকে।
বাসায় যাওয়াও খুব জরুরি। বড় ভাইয়ের বিয়ের সওদা করতে হবে। তাছাড়া নিজেকে নিয়েও আজকাল সে অনেকটা হতাশাতে দিন কাটাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা ছাত্র। দেখতেও বেশ সুদর্শন। কত জায়গাতে যে এরই মধ্যে সে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছে সে হিসাব লিখে রাখলে নিশ্চয়ই তা শখানেকের কম হবে না! যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন সে চোখে আলো-ছায়া দেখছে।
সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার একটু পাশেই এক সুন্দরী মেয়ে দাঁড়ানো ছিল। বেশ ছিমছাম। গায়ে বাসন্তীয় পোশাক। কানের পাশে গুজে রাখা হলুদ গোলাপ। কপালে হলুদ টিপ, হাতে হলুদ রেশমি চুড়ি। পায়ে পরিহিত জুতো জোড়াও হলুদ। সবকিছু মিলিয়ে এমন সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে যে, যে কোন যুবা পুরুষ অনায়াসেই তার প্রতি আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সৈকত দূরের বৃক্ষগুল্মের দিকে তাকিয়ে নতুন কচি পাতার সন্ধান করতে থাকে। প্রকৃতিতে বাসন্তীয় আমেজ রয়েছে কি না! নতুন যৌবন সঞ্চার হল কি না। কিন্তু কোথাও সে নতুন কচিপাতার সন্ধান পেল না। বসন্ত ঋতুর আবির্ভাব না থাকলে কী হবে সুন্দরীর বাসন্তীয় সাজ-সজ্জায় পুরো প্রকৃতিতেই যেন বসন্তের জোয়ার বইতে শুরু করেছে। মেয়েটিও রিক্সার সন্ধান করছিল। মাঝে মাঝে ওরা দুজনেই আড়চোখে লুকিয়ে লুকিয়ে একে অপরকে দেখতেছিল। কিন্তু উভয়ের মধ্যে কোন কথা হচ্ছিল না। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর সে একটি খালি রিক্সা পেল। রিক্সাওয়ালাকে ডাকতে হল না, সে নিজ থেকেই কাছে এল। সৈকত বলল- বাস টার্মিনাল যাবে?
-জি মামা।
সিলেটে প্রায় সব রিক্সাওয়ালারাই পেসে›জারদের ‘মামা’ বলে সম্বোধন করে। এটি রিক্সাওয়ালাদের এক অলিখিত সার্বজনীন সম্বোধন!
কত দিতে হবে?
-মামা হরতালের দিন। খুব রিস্ক নিয়া ঘর থাইক্যা বাইর অইছি। আফনে ইনসাফ কইরা
দিয়েন।
-আচ্ছা।
এরপর সে আর কথা বাড়াল না। রিক্সায় উঠে গেল। রিক্সা যখন চলতে শুরু করলো তখন সেই সুন্দরী মেয়েটি পিছন থেকে ডাক দিল- এই যে শুনুন...
সৈকত একটু পিছন ফিরে বলল- আমাকে বলছেন?
- জি, আপনাকেই।
- বলেন
- আমাকে একটু নেয়া যাবে?
- কোথায় যাবেন?
- গার্ডেন টাওয়ার
কি একটু চিন্তা-ভাবনা করে সৈকত বললো - আচ্ছা ওঠুন।
আ
আকাশ পরিষ্কার ছিল। সূর্যের তেজসক্রিয়তা তেমন একটা নাই বললেই চলে। পাখ-পাখালিরও কোন আনাগোনা নেই, নেই সেই চিরায়ত কিচির-মিচির। শাহজালাল মাজারের যে কবুতরগুলো যত্রতত্র চড়াট করতো আজ সেগুলোকেও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। শহরের কোলাহলকারী সে দাঁড়কাকগুলোরও কোন উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেল না। ঠিক বুঝা গেল না মানব হরতালের সাথে ওরাও ঐক্য ঘোষণা করলো কি না !
রিক্সা ধীর গতিতে চলছে। সৈকত ভাবে নি যে, মেয়েটি তার সাথে একই রিক্সায় যাবে। পৃথিবীতে এরকম অনেক ঘটনাই দৈবাৎ ঘটে যায়। যাইহোক, ঈষৎ লজ্জারাঙা কণ্ঠে, সৈকতই প্রথম মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো, কী নাম আপনার?
- চৈতি
- আপনার?
- সৈকত।
- কী করেন আপনি?
- পড়াশোনা।
- কোথায়?
- সাস্টে
- কোন ইয়ার ?
- টু ওয়ান
- সাবজেক্ট ?
- রাষ্ট্রবিজ্ঞান।
- আপনি কী করেন?
আপাদত পরিপূর্ণ বেকার। তবে সাস্টে আপনার ডিপার্টমেন্টে লেকচারার পোস্টে এপ্লাই করেছি। ভাগ্য সহায় হলে হয়ত আপনার শিক্ষকও হয়ে যেতে পারি!
কথাটি বলেই সে বেশ গর্বের সাথে লজ্জা রাঙা হাসি দিল। চৈতিও হাসছে। হঠাৎ উত্তরীয় বাতাসে চৈতির খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেল। কিছু চুল বাতাসের ঝাপটায় সৈকতের মুখমণ্ডলে এসে পড়ল। সৈকত অজ্ঞাত শিহরণে সুখবোধ করে চোখ বুজলো। চুলের ¯পর্শেই তার হৃদয়ে সমুদ্র জোয়ারের সুবিশাল ঢেইয়ের মত যৌবনের বাসন্তীয় শিহরণ ঢেউ খেলে গেল অবলীলায়। ক্রমশই তার শরীর উষ্ণ হয়ে ওঠছে। চৈতিও বেশ লাজুক লাজুক ভাবে চুলগুলো সরিয়ে নিল। চুল সরাতে গিয়ে চৈতির হাত পড়লো সৈকতের ঠোঁটে। কোমল হাতের মায়াবী ¯পর্শে ওর ঠোঁট কাঁপতে লাগলো। সৈকত চোখ খোলল। এখন দুজনেই লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠছে। এরপর আর কারো মুখে কোন কথা নেই।
রিক্সা চলছে। একটু পর আবারো দমকা হাওয়ায় চৈতির ওড়নায় সৈকতের মাথা মুখ জড়িয়ে গেল। সৈকত অজ্ঞাত সুখবোধ করে পুনরায় শিশুর মত চোখ বুজলো। সারাজীবন শুধু সে পড়াশোনাই করেছে। পড়াশোনার বাইরেও যে একটি রোমান্টিক জগৎ রয়েছে, ঐ জগতের ¯পর্শ যে জীবনে নতুন ¯পন্দন এনে দিতে পারে, জীবনকে নতুনরূপে জাগিয়ে তুলতে পারে এতদিন এমন ধারণার ছিল তার চেতনার বাহিরে। সে রোমান্টিকতা বিষয়ে পঠনপাঠন করেছে কিন্তু মেয়েলি ¯পর্শ যে কি জিনিস তা কখনো প্র্যাকটিক্যাল করা হয়ে ওঠে নি! অনেক ¯পর্শই হুদয় দিয়ে উপলব্ধি করা যায় কিন্তু তা সূক্ষাতিসূক্ষভাবে ব্যাখা করা যায় না। প্রকৃতি কেন যেন বারবার ওদের দুজনকে কাছে টানার চেষ্টা করছে। সত্যিই প্রকৃতির কারিগড়ি বুঝা বড়ই মুশকিল!
ই
দেখতে দেখতেই রিক্সা এসে থামল গার্ডেন টাওয়ারের সামনে। রিক্সা থেকে নেমে চৈতি ভাড়া দিতে চাইলো। সৈকত বললো- “থাক, লাগবে না। আমি দিয়ে দিব। আপনারটা জমা রইলো অন্য একদিন দিবেন। কথাটি বলেই সে মৃদু হাসলো।”
চৈতিও মুচকি হাসলো। ঐ রূপ হাসি যার আছে তার আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। গোটা বিশ্বই যেন হাসি দিয়ে জয় করা সম্ভব! হ্যান্ডসেক করার জন্য চৈতি হাত বাড়িয়ে দিল। সৈকত কিছুটা বিষ্ময়ের ঘোরেই হাত মিলাল। আজ তার সবকিছুতেই কেমন যেন বিষ্ময় লাগছে, এডভান্স লাগছে। তবে কি আজ বিশ্ব ‘বিষ্ময় দিবস’ কিংবা ‘এডভান্স দিবস’! নিজের চিন্তার সাথে নিজে হিসেব মিলাতে পারছে না। পৃথিবীতে অনেক ঘটনাই ঘটে অনুমানের বাইরে কিংবা হিসাব-নিকাশের বাইরে। হাত মিলাতে গিয়েই চৈতির কোমল হাতের ¯পর্শ সৈকতকে যেন নতুন ¯পন্দন দিল। ওর ভেতরটা যেন খুশিতে টইটুম্বুর করছে। ওর ভেতরের আমিত্ব নড়েচড়ে বসল। কেবল তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছে না। চৈতি একগাল হেসে বলল
- ভাল থাকবেন। অনেক ভালো।
- আপনিও ভাল থাকবেন। ... ভাগ্য ভাল থাকলে হয়ত আবারও দেখা হতে পারে। খুব শুঘ্রই...।
- সেই কামনাই করছি। বাই।
- বাই
রিক্সা করে বাসায় ফিরে সৈকতের কেবলি মেয়েটির কথা মনে হতে লাগলো। বারবার কথাও বলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কেন যে সাহস করে মোবাইল নাম্বারটা চাইলাম না! চাইলে কি আর না করতো! এমন হাজারো ভাবনা তার মাথায় ঢেউ খেলে যাচ্ছে। শুধু চৈতির জন্যই সে ভার্সিটিতে লেকচারার পোস্টের জন্য উঠে পড়ে লেগে গেল। যতপ্রকারের তদবির রয়েছে সর্ব প্রকারেরই প্রয়োগ করলো। পৃথিবীতে সকল দুর্লভ কর্মগুলো সফলতার নেপথ্যে বুঝি নারীদেরই অবদান বেশি! অগাধ আত্মবিশ্বাস, উপস্থিত বিচক্ষণতা, তুখোর মেধাবী ও সেই সাথে জোড়ালো তদবিরের কারণে একটা সময় তার চাকরিটি হয়েও গেল। তখন তার খুশি আর দেখে কে! সে যেন স্বর্গকেই হাতের মুঠোয় পেল।
ঈ
প্রায় মাস দেড়েক পর সে ভার্সিটিতে যোগদান করলো। ভার্সিটির পরিবেশ বেশ নান্দনিক। রাস্তার দুধারে সারি সারি বৃক্ষ ভার্সিটির সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণে। সেই সাথে ছোটখাট টিলা ও তার পাশের ঘন সবুজ অরণ্য বিশ্ববিদ্যালয়কে করে তুলেছে চিরযৌবনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনগুলোও বেশ নান্দনিকতার পরিচয় বহন করে। সাস্টে যোগদানের দ্বিতীয় দিন যখন সে টু ওয়ানে প্রথম ক্লাস করতে গেল তখন সে ছিল বেশ প্রফুল্ল। আজ তার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা সুখী মনে হচ্ছে। বিশেষ করে চৈতির সামনে আজ সে পৃথিবীর সেরা বীররূপেই বিবেচিত হবে! আলেকজান্ডর, নেপোলিয়ানের মত বীররাও যেন আজ তার কাছে নস্যি! প্রথম ক্লাসে দেখে চৈতি নিশ্চয়ই খুব অবাক হবে এবং খুশিও হবে। এজন্য পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক প্রথম ক্লাসের পরই সে চৈতিকে বাইরে নিয়ে নিজের মনের গাপন কথাটি বলবে। তিল তিল করে গড়ে তুলা স্বপ্ন-সাধের কথা বলবে। এমন হাজারো পরিকল্পনা করা ছিল তার মাথায়। ক্লাসে ঢুকে সবার দিকে হালকা চোখ বুলিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে হাজিরা খাতা বের করলো। হাজিরা চলছে। বিথি, সুপ্তা, মৃণ¥য় ...একের পর এক নাম। চৈতি নাম ডাকতেই সবাই বলল- স্যার, গত সপ্তাহে সে আত্মহত্যা করেছে।
কথাটি শোনার পরই সে শিউরে ওঠল। তার শরীরে মৃদু ক¤পন শুরু হল। মুহূর্তেই বিদ্যুৎ গতিতে তার ভেতরে সুনামি শুরু হয়ে গেল। একটি দুঃসংবাদে হঠাৎ করেই তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এক মুহূর্তকাল আগে পৃথিবীর সেরা সুখী এই মানুষটিই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা দুঃখি! মানুষের ভাগ্য কখন যে কাকে কোথায় এনে দাঁড় করায় বলা যায় না। সৈকত বিষ্মিত কণ্ঠে বললো- আত্মহত্যা?
জনৈক মেয়ে বলল- জি স্যার।
সৈকতের গলা ধরে আসে। তার হাত-পা আরও জোড়ে কাঁপতে থাকে। ক¤িপত কণ্ঠেই সে পুনরায় প্রশ্ন করে- আত্মহত্যা করলো কেন?
জনৈক মেয়ে- স্যার, ওর বাসা থেকে ওর বিয়ে ঠিক করেছিল, আর তাতে সে রাজি ছিল না; ফলে পরিবারের সদস্যরা তাকে বিয়ে করার জন্য খুব চাপ সৃষ্টি করে।
- তার কি কোন পছন্দ ছিল?
জনৈক মেয়ে- ওর ডায়রিতে লেখা ছিল সৈকত নামের জনৈক পথিককে সে পছন্দ করে। এটা সে তার পরিবারকে বলেছিলও। কিন্তু ছেলেটির কোন ঠিকানা দিতে না পারায় তার পরিবারের লোকজন এসব একেবারেই ছেলেমানুষী বলে উড়িয়ে দেয় এবং সেই সাথে জানিয়ে দেয় তাদের পছন্দ করা আমেরিকান সিটিজেন ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে। শুনেছি বিয়েতে রাজি না হওয়ার কারণে নাকি পরিবারের সদস্যরা তাকে গায়ে হাত দিয়েও প্রহার করেছিল। পরিশেষে দুঃখে, ক্ষোভে সে ...
সৈকত এরপর কী বলবে সে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। তার দুচোখে পানি টলোটলো করতে লাগলো। সে নিজেকে নিজে ধিক্কার দিতে শুরু করলো। এই মেয়ের খুনি যে সে নিজে! কোনভাবেই সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না। সে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। চোখে হঠাৎ ময়লা ঢুকেছে এবং তা পরিষ্কার করার ছলে চোখ মুছতে মুছতে সে বলল- আজ এই পর্যন্তই। সবাই ভাল থেকো।
কথাটি বলেই সে শ্রেণি কক্ষ থেকে বেরিয়ে টিসু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তার ব্যক্তিগত কক্ষের দিকে গেল। চারদিকে শুনশান নীরবতা। কেবল দূর আকাশের গায়ে একটি চিলের বিকট শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে পুনরায় মিলিয়ে গেল আকাশের গহীন থেকে গহীনে।
মুনশি আলিম
টিলাগড়. সিলেট
বি.দ্র.: গল্পটির চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কাকতালীয়ভাবে কারো জীবনের সাথে মিলে গেলে তা অনভিপ্রেত।