আমি তখন এম ওয়ানের ছাত্র। পড়াশোনার পাশাপাশি
কলেজে শিক্ষকতাও করছি। কলেজ বন্ধ হওয়ায়
শীতকালীন ছুটিতে বাড়ি যাই। বেশ লম্বা ছুটি। বাড়িতে সেদিন লাবণ্যর জন্মদিনের বেশ
বড়সড় আয়োজন চলছে। লাবণ্য আমার চাচাত বোন। পারিবারিকভাবে তারা অঢেল সম্পত্তির মালিক।
একই গ্রামের আলো-বাতাসে আমরা বেড়ে ওঠেছি। বিত্ত-বৈভবের পাশাপাশি সে আমার থেকে আরেক
দিক দিয়ে এগিয়ে ছিল। সেটা হল তার প্রকৃতি প্রদত্ত রূপ। শরতের সাদা মেঘের ভেলার মতই
শ্বেত-শুভ্র। বর্ষার প্রকৃতির মতই সতেজ, রাত্রির মত নির্লিপ্ত, কিন্তু পড়াশোনাতে
ছিল খুবই কাঁচা। বহুবার বহুভাবেই সে আমার সাথে বন্ধুত্ব গড়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু
কেন যেন তার প্রতি আমার মন সায় দেয় নি। তার জন্মদিনের উৎসব শেষে সে আমার হাতে
ছোট্ট একটি কাগজ ধরিয়ে দেয়। লটারির কাগজের মত। কাগজটি নিয়ে বেশ আগ্রহের সাথে বাড়ি
ফিরি।
বাড়ি এসে ছোট্ট টোকাটি বের করতেই বড় আপু উঁকি
মেরে বলল- কিতা রে, লুকাইয়া লুকাইয়া খিতা খররে?
- কোনতা নায় রে গো।
আপু মুচকি হেসে বলে- জানছ নি রে বাই, তুইন যখন ছোট আছলে তখন আববায় কিন্তুক এখখান খাম
খরিয়া রাখছইন।
-খিতা?
-তর বিয়া লাগাইয়া রাখছইন।
আমি যারপর নাই আশ্চর্য হলাম। রবীন্দ্র, নজরম্নল
থেকে শুরম্ন করে কত বড় বড় মনীষীদের জীবনের স্মরণীয় ঘটনাই তো জানলাম কিমুত্ম নিজের
জীবনেরও যে স্মরণীয় গল্প রয়েছে তা এতদিন ছিল আমার অজ্ঞাতে। কৌতূহলে আমার দুচোখের
মণি নড়েচড়ে ওঠে। আমার শরীরে অদ্ভুত শিহরণ ঢেউ খেলে যায়। বিষ্ময়ী দৃষ্টি নিয়ে আমি
তার দিকে তাকাই। লজ্জাস্কর কণ্ঠে বলি- পুড়ির নাম খিতা? বাফর নাম খিতা? কোনান
থাকইন?
-নাম অইল রিয়া। বাফর নাম রাকেশ তালুকদার। পূবর
গাঁওত থাখইন।
- পড়াশোনা করছে নি?
-অয়। হুনছি এবারকু বিয়ে ফাস খরছইন।
- আফা, ফুড়ি সুন্দর নি গো?
-অয়, খুব সুন্দর। থুতনিত এখটা তিলও আছে।
আমি আরও কিছু বলতে চাচ্ছিলাম এমন সময় শহর থেকে
আমার জরম্নরি কল আসল। আমাকে আজ না গেলেই নয়। আমি বিদায় নিয়ে চলে গেলাম।
তিনমাস
পর। আমার এক বাল্য সহপাঠী মেঘলার বিয়েতে গেলাম। যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না, কেবলমাত্র
মায়ের চাপাচাপিতেই রাজি হলাম। আম্মুর সাথে মেঘলার বেশ ভাল সম্পর্ক ছিল। বড় আপুর মত
মেঘলাকেও নিজের অরেক মেয়ে মনে করত। তাই মেঘলার সাথে আমাদের সম্পর্কটা রক্তের ছিল
না, ছিল আত্মিক। শহর থেকে বিয়ে বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল। বাড়ির
চারদিকে সাজবাতির ঝিলিক বাড়িটিকে সত্যিই নান্দনিক করে তুলেছে। আম্মুর কথামত আমি
কয়েকটা শাড়ি কিনে নিয়ে যাই। এবং সুযোগ বুঝে ওনার হাতে ধরিয়ে দেই। আমি মেঘলাকে
দেখার জন্য উঁকি মারি। বিয়ের সাজে তাকে সত্যিই সুন্দর লাগছিল। আপু পিছন থেকে বলল-
শিশির, ঐ যে তর রিয়া! কন্যাবেটির খান্দাত।
আমি ভাল
করে তাকাই। বীজগণিতের সূত্রের মত আমি সূত্র মিলাতে থাকি- চিবুকে কোন তিল আছে
কিনা।ওমা! সত্যিই তো! আলোকবাতিতে তাকে কী যে সুন্দর লাগছে তা বলে বুঝাতে পারবো না।
মনে হল কল্পনার হুর পরী বুঝি আজ মাটিতে নেমে এসেছে। এলোচুল। স্বর্গের আবির মাখা
ঠোঁট। কপোল জুড়ে শৈল্পিক কারম্নকাজ। ডাগর চোখের বাকা চাহনিতে কেবলি সম্মোহনের
জোয়ার উপচে পড়ছে। আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। অনুচ্চ স্বরে ডাকলাম- রিয়া,
এখটুতা আইবায় নি?
রিয়া
কিছুটা বিষ্ময়ী দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকায়। তারপর উঠার চেষ্টা করে কিন্তু পারে
না। তার পাশের বান্দবী তাকে উঠতে সহযোগিতা করে। ক্রাচে ভর দিয়ে খুড়াতে খুড়াতে সে
আমার কাছে আসে। আমি তার পায়ের দিকে তাকাই। রিয়া এক পায়ের উপর দাঁড়িয়ে। আমার চোখ
ছলছল করে ওঠল। শরীর কাঁপতে লাগলো। প্রথম দেখা শৃঙ্খলিত স্বপ্নের ভরাডুবিতে আমার
কণ্ঠ সত্মব্দ হয়ে আসে। আমি চোখ বন্ধ করি। এই অন্ধকারে আরও অন্ধকার হয়ে ওঠে আমার
সুন্দর আগামি।
মুনশি আলিম
জাফলং, সিলেট