সুকুমার রায়

ছেলেবেলায় আমরা শুনিয়াছিলাম "মানুষের পূর্বপুরুষ বানর ছিল।" ইহাও শুনিয়াছিলাম যে, ডারুইন নামে কে এক পণ্ডিত নাকি একথা বলিয়াছেন। বাস্তবিক ডারুইন এমন কথা কোনদিন বলেন নাই। আসল কথা এই যে, অতি প্রাচীনকালে বানর ও মানুষের পূর্বপুরুষ একই ছিল। সেই এক পূর্বপুরুষ হইতেই বানর ও মানুষ, এ-দুই আসিয়াছে—কিন্তু সে যে কত দিনের কথা তাহা কেহ জানে না। তখন হইতেই আমার মনে একটা সন্দেহ ছিল, পণ্ডিতেরা এত খবর জানেন কি করিয়া? তাঁহারা ত সেই প্রাচীনকালের পৃথিবীটাকে চক্ষে দেখিয়া আসেন নাই, তবে তাহার সম্বন্ধে এত সব কথা তাঁহারা বলেন কিসের জোরে? যাহা হউক, আমরা ত আর পণ্ডিত নই, তাই অনেক কথাই আমাদের মানিয়া লইতে হয়। মানিতে হয় যে এই পৃথিবীটা ফুটবলের মতো গোল এবং সে লাট্টুর মতো ঘোরে, আর সূর্যের চারিদিকে পাক দিয়া বেড়ায়—যদিও এসবের কিছুই আমরা চোখে দেখি না। ছেলেবেলায় ভাবিতাম, পণ্ডিতদের খুব বুদ্ধি বেশি, তাই তাঁহারা অনেক কথা জানিতে পারেন। কিন্তু এখন দেখিতেছি কেবল তাহা নয়। বুদ্ধি ত বটেই, তাছাড়া আরও কয়েকটি জিনিস চাই, যাহা না থাকিলে কেহ কোনদিন যথার্থ পণ্ডিত হইতে পারে না। তাহার মধ্যে একটি জিনিস, ঠিকমতো দেখিবার শক্তি। সাধারণ লোকে যেমন দুই-একবার চোখ বুলাইয়া মনে করে ইহার নাম 'দেখা'—পণ্ডিতের দেখা সেরকম নয়। তাঁহারা একই বিষয় লইয়া দিনের পর দিন দেখিতেছেন, তবু দেখার আর শেষ হয় না। মাথার উপর এত যে তারা সারারাত মিটমিট করিয়া জ্বলে, আবার দিনের আলোয় মিলাইয়া যায়, পণ্ডিতেরা কত জাহার বৎসর ধরিয়া তাহা দেখিতেছেন তবু তাঁহাদের তৃপ্তি নাই। বছরের কোন্‌ সময়ে কোন্‌ তারা ঠিক কোন্‌খানে থাকে, কোন্‌ তারাটা কতখানি স্থির বা কিরকম অস্থির, তাদের রকমসকম কোন্‌টার কেমন—এইসবের সূক্ষ্ম হিসাব লইতে লইতে পণ্ডিতদের বড় বড় পুঁথি ভরিয়া উঠে। সেইসব হিসাব ঘাঁটিয়া তাহার ভিতর হইতে কত আশ্চর্য নূতন কথা তাঁহারা বাহির করেন, যাহা সাধারণ লোকের কাছে অদ্ভুত ও আজগুবি শুনায়।

আজ এক পণ্ডিতের কথা বলিব, তাঁহাকে কেহ বুদ্ধিমান বলিয়া জানিত না, মাস্টারেরা তাঁহার উপর কোনদিনই কোন আশা রাখেন নাই—বরং সকলে দুঃখ করিত 'এ ছেলেটার আর কিছু হইবে না।' অথচ এই ছেলেই কালে এক অসাধারণ পণ্ডিত হইয়া সমস্ত পৃথিবীতে আপনার নাম রাখিয়া গিয়াছেন। ইঁহার নাম চার্লস ডারুইন। পড়ার দিকে ডারুইনের বুদ্ধি খুলিত না, কিন্তু একটা বিষয়ে তাঁহার অসাধারণ আগ্রহ ছিল। সেটি কেবল নানা অদ্ভুত জিনিস সংগ্রহ করা! শামুক ঝিনুক হইতে আরম্ভ করিয়া, পুরাতন ভাঙা জিনিস বা পাথরের কুচি পর্যন্ত নানা জিনিসে তাঁহার বাক্স ও পড়ার টেবিল বোঝাই হইয়া থাকিত। বালকের এই আগ্রহটা অন্য লোকের কাছে অন্যায় বাতিক বা উপদ্রব বলিয়াই বোধ হইত, কিন্তু তবু কেহ তাহাতে বড় একটা বাধা দিত না। কারণ, ডারুইনের মনটা স্বভাবতই এমন কোমল এবং তাঁহার স্বভাব এমন মিষ্ট ছিল যে সকলেই তাঁহাকে ভালবাসিত।

ছেলেবেলায় পড়ার মধ্যে একটি বই ডারুইন খুব মন দিয়া পড়িয়াছিলেন—তাহাতে পৃথিবীর নানা অদ্ভুত জিনিসের কথা ছিল। সেই বই পড়িয়া অবধি তাঁহার মনে দেশ-বিদেশ ঘুরিবার শখটা জাগিয়া উঠে। কলেজে আসিয়া ডারুইন প্রথমে গেলেন ডাক্তারি শিখিতে। সে সময় ক্লোরোফর্ম ছিল না, তাই রোগীদের সজ্ঞানেই অস্ত্র-চিকিৎসার ভীষণ কষ্ট ভোগ করিতে হইত। সেই যন্ত্রণার দৃশ্য দেখিয়া করুণহৃদয় ডারুইনের মন এমন দমিয়া গেল যে, তাঁহার আর ডাক্তারি শেখা হইল না। তখন তিনি ধর্মযাজক হইবার ইচ্ছায় স্কটল্যান্ড ছাড়িয়া ইংলন্ডে ধর্মতত্ত্ব শিখিতে আসিলেন। শিক্ষার দশা এবারও প্রায় পূর্বের মতোই হইল—কারণ, বাল্যকালে তিনি গ্রীক প্রভৃতি যাহা কিছু শিখিয়াছিলেন, এ কয় বছরে তাহার সবই প্রায় ভুলিয়া বসিয়াছেন, ভুলেন না কেবল সেই নানা জিনিস সংগ্রহের অভ্যাসটা। কলেজে তাঁহার সহপাঠী বন্ধুরা দেখিত ডারুইন সুযোগ পাইলেই মাঠে ঘাটে জঙ্গলে পোকামাকড় সংগ্রহ করিয়া ফিরিতেছেন। হয়ত সারাদিন কোন পোকার বাসার কাছে পড়িয়া, তাহার চালচলন স্বভাব সমস্ত যারপরনাই মনোযোগ করিয়া দেখিতেছেন। এ বিষয়ে কেবল নিজের চোখে দেখিয়া তিনি এমন সব আশ্চর্য খবর সংগ্রহ করিতেন, যাহা কোন পুঁথিতে পাওয়া যায় না। বন্ধুরা এইসব ব্যাপার লইয়া ঠাট্টা তামাসা করিত, কেহ কেহ বলিত, "ডারুইন পণ্ডিত হইবে দেখিতেছি।" ডারুইন যে পণ্ডিত হইতে পারেন, এটা কাহারও কাছে বিশ্বাসযোগ্য কথা বলিয়া বোধ হইত না।

এইরূপে বাইশ বৎসর কাটিয়া গেল। ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দে "বীগল" নামে এক জাহাজ পৃথিবী ভ্রমণে বাহির হইল—ডারুইন বিনা বেতনে প্রাণিতত্ত্ব সংগ্রহের জন্য তাহার সঙ্গে যাইবার অনুমতি পাইলেন। পাঁচ বৎসর জাহাজে করিয়া তিনি পৃথিবীর নানা স্থান ঘুরিয়া বেড়াইলেন এবং প্রাণিতত্ত্ব বিষয়ে এমন আশ্চর্য নূতন জ্ঞান লাভ করিলেন যে, তাহা তাঁহার সমস্ত চিন্তা ও জীবনকে একেবারে নূতন পথে লইয়া চলিল। ডারুইন বলেন ইহাই তাঁহার জীবনের সব চাইতে স্মরণীয় ঘটনা।

তারপর কুড়ি বৎসর ধরিয়া ডারুইন এই সমস্ত বিষয় লাইয়া গভীরভাবে আলোচনা করিতে লাগিলেন। প্রাচীনকালে যে-সকল জীবজন্তু পৃথিবীতে ছিল, আজ তাহারা নাই, কেবল কতগুলি কঙ্কালচিহ্ন দেখিয়া আমরা তাহার পরিচয় পাই। আজ যে-সকল জীবজন্তু দেখিতেছি, তাহারাও ভুঁইফোঁড় হইয়া হঠাৎ দেখা দেয় নাই—ইহারাও সকলেই সেই আদিমকালের কোন না কোন জন্তুর বংশধর। কেমন করিয়া এ পরিবর্তন হইল? এরূপ পরিবর্তন হইবার কারণ কি? যে গাছের যে ফল তাহার বীচি পুঁতিলে সে ফলেরই গাছ হয়, তাহাতে সেইরূপই ফল ফলে, আমরা ত এইরূপই দেখি। যে জন্তুর আকার-প্রকার যেমন, তার ছানাগুলাও হয় সেরূপ। শেয়ালের বংশে শেয়ালই জন্মে। শেয়ালের ছানা, তার ছানা, তার ছানা, তার ছানা, এরূপ যতদূর দেখিতে পাই সকলেই ত শেয়াল। তবে এ আবার কোন্‌ সৃষ্টিছাড়া নিয়ম, যাহাতে এক জন্তুর বংশে ক্রমে এমন জন্তুর জন্ম হয়, যাহাকে আর সেই বংশের সন্তান বলিয়া চিনিবার যো থাকে না? ডারুইন দেখিলেন তিনি যে সমস্ত নূতন তত্ত্ব জানিয়াছেন, তাহার মধ্য হইতেই নানা দৃষ্টান্ত দেখাইয়া এই সকল প্রশ্ন ও সন্দেহের অতি চমৎকার মীমাংসা করা যায়।

যাহারা ওস্তাদ মালী তাহারা ভাল ভাল গাছের 'কলম' করিবার সময়, বা বীজ পুঁতিবার সময় যে-সে গাছের বীজ বা কলম লইয়া কজ করে না। ভাল গাছ, ভাল ফুল, ভাল ফল বাছিয়া বাছিয়া, তাহাদের মধ্যে নানারকম মিশাল করাইয়া, খুব সাবধানে পছন্দমত গাছ ফুটাইয়া তোলে। যেগুলা তাহার পছন্দমত নয়, সেগুলাকে সে একেবারেই বাদ দেয়। তাহার ফলে অনেক সময় গাছের চেহারার আশ্চর্যরকম উন্নতি ও পরিবর্তন দেখা যায়। একটা সামান্য জংলি ফুল মানুষের চেষ্টা ও যত্নে আজ সুন্দর গোলাপ হইয়া উঠিয়াছে—নানা লোকে গোলাপের চর্চা করিয়া আপন পছন্দমত নানারূপ বাছাই করিয়া, নানারকম মিশাল দিয়া কত যে নূতনরকমের গোলাপ গড়িয়া তুলিয়াছে, তাহার আর অন্ত নাই। যাহারা ব্যবসার জন্য বা সখের জন্য নানারূপ জন্তু পালে তাহারা জানে যে, কোন জন্তুর বংশের উন্নতি করিতে হইলে, রুগ্ন কুৎসিত বা অকর্মণ্য জন্তুগুলাকে বাদ দিতে হয়, তাহার পর যেরূপ গুণ ও লক্ষণ দেখিয়া বাছিয়া বাছিয়া জোড় মিলাইবে, বংশের মধ্যে সেইসব লক্ষণ ও গুণ পাকা হইয়া উঠিবে। লম্বা শিংওয়ালা ভেড়া চাও ত বাছিবার সময় লম্বা শিং দেখিয়া বাছিবে। তাহাদের যেসব ছানা হইবে, তাহাদের মধ্যে যেগুলার শিং ছোট, তাহাদের বাদ দিবে। এইরূপে ক্রমে লম্বা শিঙের দল গড়িয়া উঠিবে।

ডারুইন দেখিলেন, মানুষের বুদ্ধিতে যেমন নানারকম বাছাবাছি চলে, প্রাণিজগতেও সর্বত্রই স্বাভাবিকভাবে সেইরূপ বাছাবাছি চলে। যারা রুগ্ন যারা দুর্বল মরিবার সময় তাহারাই আগে মরে, যাহারা বাহিরে নাআন অবস্থার মধ্যে আপনাকে বাঁচাইয়া রাখিতে পারে, তাহারাই টিকিয়া যায়। কাহারও গায়ে জোর বেশি, সে লড়াই করিয়া বাঁচে; কেহ খুব ছুটিতে পারে, সে শত্রুর কাছ হইতে পলাইয়া বাঁচে; কাহারও চামড়া মোটা, সে শীতে কষ্ট সহিয়া বাঁচে; কাহারও হজম বড় মজবুত, সে নানা জিনিস খাইয়া বাঁচে; কাহারও গায়ের রং এমন যে হঠাৎ চোখে মালুম হয় না, সে লুকাইয়া বাঁচে। বাঁচিবার মতো গুণ যাহার নাই সে বেচারা মারা যায়, আর সেই সব গুণ আর লক্ষণ যাহাদের আছে তাহারাই বাঁচিয়া থাকে, তাহাদেরই বংশ বিস্তার হয়, আর বংশের মধ্যে সেইসব বাছা বাছা গুণগুলিও পাকা হইয়া স্পষ্ট হইয়া উঠে। এইরূপ আপনাকে বাঁচাইবার জন্য সংগ্রাম করিতে করিতে, বাহিরের নানা অবস্থার মধ্যে প্রত্যেক জন্তুর চেহারা নানারকম গড়িয়া ওঠে।

ডারুইন দেখাইলেন, এইরূপে এবং আরও নানা কারণে, আপনা হইতেই এক একটা জন্তুর চেহারা নানারকমে বদলাইয়া যায়। সেই হুঁকার গল্প তোমরা শুনিয়াছ, যার সবই ঠিক ছিল কেবল নল্‌চে আর মালাটি বদল হইয়াছিল? এক একটা জানোয়ারও ঠিক সেইরূপ নল্‌চে মালা সবই বদল করিয়া নূতন মূর্তি ধারণ করে—তখন তাহাকে সম্পূর্ণ নূতন জন্তু বলিয়া ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক। ডারুইনের কথা বলিতে গেলে দুটি কথা বিশেষ করিয়া বলিতে হয়—একটি তাঁহার অক্লান্ত অধ্যবসায় আর একটি তাঁহার মিষ্ট স্বভাব। তাঁহার শরীর কোনকালেই খুব সুস্থ ছিল না—জীবনের শেষ চল্লিশ বৎসর সে শরীর একেবারে ভাঙিয়া পড়িয়াছিল। কিন্তু তাঁহার মনের শক্তি আশ্চর্যরকম সতেজ ছিল। প্রতিদিন ভোরের আগে ঘুম হইতে উঠিয়া তিনি বাগানে যাইতেন—সেখানে ফুল ফল আর মৌমাছি আর প্রজাপতির সঙ্গে পরিচয় করিতে করিতে কোন্‌দিক দিয়া যে তাঁহার সময় কাটিয়া যাইত কত সময়, তাঁহার সে খেয়ালই থাকিত না।

ডারুইনকে যাঁহারা জানিতেন, তাঁহারা বলেন যে, সকলকে প্রাণ দিয়া এমন ভালবাসিতে আর কেহ পারে না। শুধু মানুষ নয়, পশুপক্ষী নয়, গাছের ফুলটিকে পর্যন্ত তিনি এমনভাবে স্নেহের চক্ষে দেখিতেন যে, লোকে অবাক হইয়া যাইত। ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে ৭৩ বৎসর বয়সে তাঁহার মৃত্যু হইলে ইংরাজ জাতি সেই 'অল্পবুদ্ধি' ছাত্রকে পরম আদরে বিজ্ঞানবীর নিউটনের পাশে সমাধি দেন।

Author Name

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.