রফিকুল ইসলাম সাগর 
সাময়িকী.কম
ছবি : রফিকুল ইসলাম সাগর

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর মালয়েশিয়াকে পাহাড়ের দেশই বলা চলে। এই দেশটির প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই চোখে পরবে পাহাড়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই মূলত বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের সেখানে বেড়াতে যেতে আকর্ষণ করে। দু'পাহাড়ের মাঝে নিরিবিলি আকাবাঁকা পিচঢালা পথ-, ছবিতে দেখা এমন দৃশ্যের ছবির মতো একটি দেশ মালয়েশিয়া। আমি ভ্রমন প্রিয় একজন মানুষ। বেড়ানো আমার চরম নেশা। প্রবাস জীবনের কর্ম ব্যস্ততার পাশাপাশি মালয়েশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে আমার বেড়ানোর অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক ভারী। তাই মুখে বলে অথবা লিখে প্রকাশ করতে গেলে অনেক দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। এই লেখায় জানাচ্ছি মালয়েশিয়ার পাহাড়ে বেড়ানোর কিছু অভিজ্ঞতার কথা। 

মালয়েশিয়ার যেখানেই আমি গিয়েছি পাহাড় দেখেছি। চলা ফেরায় সময় অধিকাংশ পথ গুলোই যেন ইতিহাসের সাক্ষী দেয় যে, এখানেও পাহাড় ছিল। মালয়েশিয়ান ক'জন বন্ধু-বান্ধব সূত্রে জেনেছি, দেশটির যতসব আধুনিকায়ন তার বেশি অংশই পাহাড় ধ্বংশ করে করা হয়েছে। বিশেষ করে সড়ক পথ ও রেলপথ।
রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে এক ঘন্টার পথ 'গ্যানতিং হাইল্যান্ড'। এটি একটি জায়গার নাম। জায়গাটি ছয় হাজার ফুট উচু পাহাড়ের উপর। সেখানে যাওয়া যায় দুইটি উপায়ে। গাড়িতে অথবা ক্যাবল কারে। পাহাড় কেটে ঘুরানো পিচঢালা পথে একটু একটু করে গাড়ি চুড়ায় উঠে। গাড়ি থেকে নামলে সেখানে মেঘ ছুয়া যায়। এবং প্রয়োজন হয় শীতের কাপড়ের। এছাড়া ক্যাবল কারে চড়েও চূড়ায় যাওয়া যায়। ক্যাবল কারে চড়ে যাওয়ার স্বাদ পুরোই অন্যরকম। চূড়ায় যেতে ক্যাবল কার ব্যবহার না করলে রোমাঞ্চকর, এডভেঞ্চার অনুভূতি মিস করতে হবে। এ এলাকায় ক্যাবল কার ও বাস চলাচল সন্ধা সাতটার পর বন্ধ হয়ে যায়। তারপর সকাল আটটা পর্যন্ত নিজস্ব গাড়ি না থাকলে যাওয়া-আসার মাধ্যম ট্যাক্সিক্যাব। 
গ্যানতিং হাইল্যান্ডে 'হোটেল গ্যানতিং'- এর ভেতর ক্যাসিনো (জুয়ার আসর)। হোটেল গ্যানতিং একটি ফাইভ ষ্টার হোটেল। এখানকার ক্যাসিনো বিশ্বের নামকরা ক্যাসিনোর একটি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কেউ কেউ মালয়েশিয়া আসেন শুধু এই ক্যাসিনোতে জুয়া খেলতে। লোক মুখে শুনেছি, মুসলিম দেশে এমন একটি ক্যাসিনো বসানোর জন্য মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাতির মোহাম্মদকে অনেক তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল। বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানরা তাকে হুশিয়ার করেছিলেন। তাকে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু মাহাতির মোহাম্মদ কোন কিছুর পরক্কা না করে তার কাজ তিনি করে গেছেন। ক্যাসিনোতে সর্বসাধারণের প্রবেশের অনুমতি থাকলেও মুসলিমদের প্রবেশ নিষেধ। এক্ষেত্রে মুসলিম বিদেশী পর্যটকদের জন্য ছাড় থাকলেও মালয়েশিয়ান মুসলিমদের জন্য নেই। ক্যাসিনোতে প্রবেশ করার সময় গেইটে পুলিশকে পাসপোর্ট অথবা জাতীয় পরিচয় পত্র দেখাতে হয়।  'হোটেল গ্যানতিং'- এর ছাদের উপর বড় অক্ষরে লাইটিং করে লেখা ৬০০০। মানে বুঝানো হয়েছে ছয় হাজার ফুট উচ্চতা। গ্যানতিং হাইল্যান্ডে এছাড়াও আছে থিম পার্ক ও শপিংমল। পাশাপাশি বিশাল অংশজুড়ে অন্যান্য এলাকার মতো বসবাসকারীদের ঘর বাড়ী। এখানে জীবন-যাপন খরচ অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি। 

বিশ্ব বিখ্যাত মালয়েশিয়ার 'কে এল সি সি'-তে অবস্থিত টুইন টাওয়ার। এটি যেখানে দাড়িয়ে আছে সেখানেও নাকি টুইন টাওয়ার নির্মানের পূর্বে পাহাড়-জঙ্গল ছিল। পাহাড়-জঙ্গল ধ্বংশ করে দাড় করানো হয়েছে টুইন টাওয়ার। এ টুইন টাওয়ারের আরেক নাম পেট্রোনাস টাওয়ার। মালয়েশিয়ায় সর্ববৃহৎ তেল ও গ্যাসের কোম্পানির নাম পেট্রোনাস। মালয়েশিয়ায় সর্ববৃহৎ মোবাইল অপারেটর কোম্পানি ম্যাক্সিস ও পেট্রোনাস যৌথভাবে নির্মান করেছে টুইন টাওয়ার। টুইন টাওয়ারের পাশেই ম্যাক্সিস টাওয়ার। 

পাহাড় গুলো জড়িয়ে মালয়েশিয়ায় অসংখ্য পার্ক রয়েছে। এগুলোর ভেতরে গেলে নানান জাতের গাছ-গাছালি এবং বানর দেখা যায়। এর মধ্যে কিছু পার্কে প্রবেশ করতে টিকেট লাগে, কিছু পার্কে লাগেনা। তবে অধিকাংশ পাহাড় এমনিতেই পরে আছে। সেখানে লোক সমাগম নেই। পাহাড়ের বুকে আকাশ ছুই ছুই গাছ। 
পার্ক গুলোর ভেতর সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে ডমিরণ ফলের গাছ। এ ফলটি দেখতে কাঠালের মতো। তবে কাটা গুলো কাঠালের চেয়ে আরো লম্বা লম্বা। ভেতরে কোষ গুলোও কাঠালের মতো। তবে কোষ গুলোর সাইজ অনেক বড় বড়। পাহাড়ে বসবাসকারী বানর গুলো মানুষের সাথে খুব মিশুক প্রকৃতির। জনসম্মুখে বেরিয়ে এলেও তারা কোনো ক্ষতি করেনা। এদেশের মানুষও তাদের কোনো ক্ষতি করেনা। আমি লক্ষ্য করেছি, বন্যপ্রাণী শিকার এবং বনের গাছ-গাছালি কাটা থেকে এদেশের মানুষ পুরোপুরি বিরত। তারা দুটোর প্রতি যত্নবান এবং সচেতন। 

মালয়েশিয়ায় এতো এতো পাহাড়, বন-জঙ্গল। এসব দেখে প্রায়ই প্রশ্ন আমার মাথায় ঘোরপাক করত! এর ভেতরে কোন কোন প্রাণী আছে? নিরিবিলি পাহাড়ি জঙ্গলের পাশ কেটে হেটে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে মনে হতো, সিনেমার মতো এই বুঝি জঙ্গলের ভেতর থেকে জংলি বেরিয়ে আসবে। তবে বাস্তবে কোনদিন জংলি বেরিয়ে আসেনি। দেখে শুনে যতটুকু জেনেছি, মালয়েশিয়ার অধিকাংশ পাহাড়ি জঙ্গল গুলোর ভেতর প্রাণীর মধ্যে আছে বানর ও সাপ। এছাড়া বন্য গরু, মায়া হরিণ, বন্য মুরগী। তবে বানর ও সাপই বেশি। মালয়েশিয়াতে চাইলেই খাওয়ার জন্য মায়া হরিণ কিনতে পাওয়া। প্রবাসী বাঙালি বসতির সংখ্যা যেখানে বেশি সেখানে প্রায়ই দেয়ালে দেয়ালে লাগানো বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ে। যাতে লেখা থাকে, 'নির্দিষ্ট দিন নির্দিষ্ট জায়গায় হরিণ জবাই করা হবে।' সেখানে ক্রেতাদের উপস্থিত থাকার আহ্বান জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে। 

মালয়েশিয়ার কুয়ানতাং নামক একটি অঞ্চলের মানুষ অত্যন্ত ধার্মিক। নারীরা অত্যন্ত পর্দাশীল। এ অঞ্চলের প্রতিটি গ্রামে মসজিদের ইমামের নেতৃত্বে একটি করে বাহিনী আছে। কিছুটা সৌদির মতই সেখানের আইন-কানুন ও বিচার ব্যবস্থা। কর্মের সন্ধানে কুয়ানতাং থেকে কুয়ালালামপুরে আসা আমার এক মালয়েশিয়ান বন্ধুর নিকট এসব তথ্য জেনেছিলাম। 
কুয়ানতাং অঞ্চলের কিছু কিছু পাহাড়ি জঙ্গলের ভেতর নাকি এমন জাতের মানুষ থাকে যাদের জীবন-যাপন অনেকটাই জংলীদের মতো। তারা জঙ্গলের ভেতর থেকে বের হয়না। দৈনন্দিক জীবনের সকল চাহিদা তারা জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে পূরণ করেন। 
সনটা ঠিক মনে নেই সেবার নাকি এ জাতিদের খুঁজে বের করে ধরে কুয়ালালামপুর এনে ভোটার করা হয়েছিল। জাতীয় পরিচয় পত্রও দেয়া হয়। তাদের জীবন-যাপন পরিবর্তনের জন্য কর্মসংস্থান-বাসস্থানের ব্যবস্থা করে সরকার। তার মধ্যে অনেকেই তাদের জীবন-যাপন পরিবর্তন করে নতুন জীবন গ্রহণ করেন। অনেকে পূনরায় ফিরে গিয়েছেন আগের জীবনে। তাদের নাকি ওভাবেই জীবন-যাপন ভালো লাগে। 

আগেই বলেছি মালয়েশিয়া নিয়ে বলে অথবা লিখে যদি প্রকাশ করতে চাই সেটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। তাই আজ এ পর্যন্তই থাক। আরো অভিজ্ঞতা শেয়ার করব অন্য আরেক লেখায়। সবার মতামত পেলে লেখায় উত্সাহিত হব।  

ভিসা পেতে
মালয়েশিয়ার ভ্রমণ-ভিসা পেতে সময় লাগে তিন কার্যদিবস। ভ্রমণ-ভিসা পেতে মালয়েশিয়া হাইকমিশনে যেতে হয় না। নির্ধারিত ট্রাভেল এজেন্সিতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যেমন পাসপোর্ট, বিমান টিকিট, ছয় মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট, কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকার লেনদেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, চাকরিরত হলে প্রতিষ্ঠানের অনুমতিপত্র, ব্যবসা করলে ট্রেড লাইসেন্সের ফটোকপি, ছাত্র হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতিপত্র ইত্যাদি জমা দিতে হবে। এর জন্য ট্রাভেল এজেন্সিকে ভিসা ফিসহ দিতে হবে এক থেকে দুই হাজার টাকা।

কিভাবে যাবেন
ঢাকা-কুয়ালালামপুর ফ্লাইট আছে প্রতিদিন। যাওয়া-আসা বিমান ভাড়া মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস: ৩৮ হাজার টাকা, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস: ২৮ হাজার টাকা।



বিভাগ:

Author Name

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.