সাময়িকী.কম
মোদির ঐন্দ্রজালিক ভাষণে মুগ্ধ শ্রোতা
মোদির ঐন্দ্রজালিক ভাষণে মুগ্ধ শ্রোতা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (৭ জুন) শেষ বিকালে ৩৬ ঘণ্টার সফর শেষে দেশে ফিরে যাওয়ার আগে বক্তৃতায় আবার বাংলাদেশে আসার আকুলতা ব্যক্ত করেন। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাষায় তিনি বলেন, 'আবার আসিব ফিরে/ধানসিঁড়িটির তীরে/এই বাংলায়'।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে উদ্দীপনামূলক এ বক্তৃতার শুরুতেই পরিষ্কার বাংলায় তিনি বলেন, 'কেমন আছ? আমরা তোমার সাথে আছি। আমরা তোমাদের সাথে নিয়ে চলব'। এ কথা বলার পর তিনি অতিথিদের কাছে জানতে চান আমার বাংলা কেমন? অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বাগত বক্তৃতা করেন আয়োজক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
শুরুটা বাংলায় হলেও পুরো বক্তব্য হিন্দিতে দেন মোদি। তার বক্তব্যে বাংলাদেশের সাফল্য, সম্ভাবনা এবং সংগ্রামের কথা উঠে আসে। উঠে আসে ক্রিকেটে সাকিব আল হাসান ও সালমা খাতুনের নাম। তিনি উল্লেখ করেন পোশাক খাতে বাংলাদেশের দ্বিতীয় অবস্থানের কথা। এ দেশে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে এভারেস্ট জয়ী দুই নারী নিশাত মজুমদার ও ওয়াসফিয়া নাজরিনের নাম উল্লেখ করেন তিনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, উপাচার্য পদে নারী আসীন থাকার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। এ ছাড়াও সীমান্তে হত্যা, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, পানি চুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন মোদি। ভারতের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের মাথায় শনিবার সকালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আসেন মোদি। নরেন্দ্র মোদি বলেন, আমার এই দুই দিনের সফরে বাংলাদেশের নাগরিকরা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা যেভাবে আমাকে স্বাগত ও সম্মান জানিয়েছেন; এটা নরেন্দ্র মোদি নামের এক ব্যক্তির নয়, সোয়া শ কোটি ভারতবাসীর সম্মান। তিনি বলেন, সূর্য এখানে আগে ওঠে, এরপর আলো আমাদের (ভারত) এখানে যায়। এখানে যত আলোই হোক আলো আমাদের ওখানেও যায়। আমাদের রাজ্যগুলোকে বাংলাদেশের কাছ থেকে শিখতে হবে। বাল্যবিবাহ, শিশুমৃত্যু এসব বিষয়ে শিখতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশের সেনারাও বাংলাদেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন। এর চেয়ে বেশি গৌরব আর থাকতে পারে না। মোদি বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই, তিনি একটিই লক্ষ্য বানিয়েছেন, সেটি হচ্ছে প্রবৃদ্ধি। আর ধারাবাহিকভাবে ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছোট ব্যাপার নয়।
মোদি বলেন, খুব কম মানুষ এটি চিন্তা করেছে যে, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্থলসীমান্ত চুক্তি হবে। এটি শুধু জমির সমাধান নয়, এটি সেই চুক্তি যা মনকে যুক্ত করেছে। বিশ্বে সব যুদ্ধই জমির জন্য হয়েছে। তিনি বলেন, বুদ্ধ (গৌতম বুদ্ধ) ছাড়া ভারতও অসম্ভব। যেখানে বুদ্ধ রয়েছেন সেখানে যুদ্ধ হতে পারে না। তারা জমির জন্য যুদ্ধ করতে পারে, আমরা নয়।
অন্য দেশ হলে নোবেল পুরস্কার দিত : নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার স্থলসীমান্ত চুক্তি সম্পর্কে বলেন, বাংলাদেশের খবরের কাগজে দেখলাম অনেকে বলেছেন, এটা বার্লিনের দেওয়াল ভেঙে পড়ার মতো। অন্য দেশের হলে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হতো। কিন্তু আমরা গরিব দেশ। তবে একসঙ্গে চললে সবাই দেখবে এরা একসঙ্গে এগিয়ে চলছে। তিনি আরও বলেন, স্থলসীমান্ত চুক্তি শুধু জমির সমাধান নয়। এ চুক্তি দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্কের সেতু তৈরি করেছে।
সমুদ্রপথেও যোগাযোগ বাড়বে : বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আবেগপূর্ণ যোগাযোগ রয়েছে বলে মন্তব্য করেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, সার্ক দেশগুলোর প্রত্যেক মানুষের মধ্যে জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে হবে। এ জ্ঞানই আগামী দিনেও একজোট হয়ে সার্ক দেশগুলোর এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দেবে। সার্কের পাঁচটি দেশ রয়েছে যাদের সমুদ্রবন্দর রয়েছে। এটা ব্যবহার করলে এগিয়ে যেতে পারি। এমন ব্যবস্থা থাকবে যেন আসা-যাওয়া সহজ হয়। ভবিষ্যতে একজোট হয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সমুদ্রপথেও যোগাযোগ গড়ে তোলা হবে বলে জানান নরেন্দ্র মোদি। সার্ক প্রসঙ্গে মোদি আরও বলেন, আমার গাড়ি লাইনে যায়নি। তাই বলে কি অপেক্ষা করে বসে থাকব? সার্কের নিয়ম অনুযায়ী হয়তো আমরা কিছু করতে পারিনি। কিন্তু বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, ভারত যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ-ভারতে আমরা রেল-সড়ক, উড়োজাহাজ এমনকি সমুদ্রপথেও যোগাযোগ গড়ে তুলব। আগে ভারতে কিছু পাঠাতে হলে সিঙ্গাপুর হয়ে পাঠাতে হতো। মোদি বলেন, কত বড় পরিবর্তন আসতে চলেছে, তা আমরা দেখতে পাই। অস্ত্রশক্তি, জনশক্তি যাই থাক একা কিছু করা যায় না। অন্যের সহযোগিতা ছাড়া বিশ্ব চলতে পারে না। ভারত এবং বাংলাদেশের লক্ষ্য এক।
হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেব : বাংলাদেশকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেওয়া হবে বলে জানান নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সহায়তা না পেলে ত্রিপুরায় বিদ্যু?ৎ কেন্দ্র স্থাপন সম্ভব হতো না। তাই গতকাল (শনিবার) সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাংলাদেশকে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যু?ৎ দেব। সৌর বিদ্যুতে আস্থা রেখে তিনি বলেন, এক সময় সূর্য সমস্যার কারণ ছিল। কিন্তু এখন সূর্য শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
ক্রিকেটকে আর ছোট করে দেখার সুযোগ নেই : দেরিতে খেলা শুরু করলেও বাংলাদেশ ক্রিকেটকে এখন আর ছোট করে দেখার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতীয় ক্রিকেট দল বাংলাদেশে আসার ঠিক আগের দিন গতকাল নরেন্দ্র মোদি এ মন্তব্য করেন। এ সময় ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পারফরমেন্সের ভূয়সী প্রশংসা করে আগামীতে আরও ভালো খেলবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আড্ডা ছাড়া সফর অসম্পূর্ণ : আড্ডা ছাড়া সফর অসম্পূর্ণ থাকবে মন্তব্য করে আবারও বাংলাদেশে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন নরেন্দ্র মোদি। বিশেষ করে যুবাদের সঙ্গে সময় কাটানোর আর পদ্মায় ভেসে বেড়ানোর বাসনা পোষণ করেন তিনি।
বাংলাদেশ নতুন উচ্চতায় পেঁৗছুক : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, বাংলাদেশ নতুন উচ্চতায় পেঁৗছুক এটাই ছিল স্বপ্ন। আমরা চেয়েছি বাংলাদেশের বিকাশ। আমাদের চিন্তায় ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। যার কারণে আমরা সেদিন আমাদের সমস্যার দিকে তাকাইনি। তিনি আরও বলেন, আমাদের সেনাদের চরিত্র দেখুন যে, একটি দেশের ৯৫ হাজার সেনাকে আত্দসমর্পণে বাধ্য করেছিল। একটি বিমান হাইজ্যাক করে কত কিছু দাবি করা হয়।
সংকটেও মাথা তুলেছে বাংলাদেশ : বার বার রাজনৈতিক সংকট এলেও বাংলাদেশ সব সময়ই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, বিশ্বে সমৃদ্ধ দেশ নিয়ে অনেক কথা হয়, কিন্তু গরিব দেশ নিয়ে আলোচনা হয় না। বাংলাদেশে বারবার রাজনৈতিক সংকট এসেছে। মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও সংকট এসেছে, আর বাংলাদেশ মোকাবিলা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
রক্ত গরম হয়ে যেত : পাকিস্তানি হানাদারদের অত্যাচারের খবরে নিজের শরীরের রক্ত গরম হয়ে যেত বলে মন্তব্য করেন নরেন্দ্র মোদি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মৃতি স্মরণ করে মোদি বলেন, আমি যুবক ছিলাম, সে সময় খবরের কাগজে পড়তাম বাংলাদেশের লড়াই, অত্যাচার সম্পর্কে। আপনাদের যেমন রক্ত গরম হয়ে যায়, আমারও যেত। জীবনে প্রথমবার গ্রাম ছেড়ে তাই দিলি্লতে চলে আসার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সত্যাগ্রহে অংশ নিয়েছি। তারপর দীর্ঘদিন রাজনীতি করিনি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমিও ছিলাম : এর আগে দুপুরে বঙ্গভবনের অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার পক্ষে তিনিও ছিলেন। বাংলাদেশের জন্য ভারতীয়রা যে স্বপ্ন দেখেছিল, তা ছিল তারও স্বপ্ন। একাত্তরে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিজেপি নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ির সমর্থনের কথা স্মরণ করে গতকাল তাকে 'মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা' দেয় বাংলাদেশ। বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাতে বাজপেয়ির এ সম্মাননা তুলে দেন। এ সময় মোদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অটল বিহারী বাজপেয়ির সত্যাগ্রহ আন্দোলনে নিজের অংশগ্রহণের কথা তুলে ধরেন।
মোদি বলেন, একটি কথা, হয়তো আমি আগে কখনো বলিনি। আজ বলতে পেরে আমার গর্ব হচ্ছে। রাজনীতিতে আমি দেরিতে এসেছি, ১৯৯৮ সালের দিকে... কিন্তু অটলজির নেতৃত্বে ভারতীয় জনসংঘ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে যে সত্যাগ্রহ করেছিল, একজন যুবকর্মী হিসেবে ওই সত্যাগ্রহে একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিতে আমি গ্রাম থেকে দিলি্ল এসেছিলাম। তিনি বলেন, যে গৌরবময় লড়াই আপনারা লড়েছিলেন, যেই স্বপ্নের জন্য, যা প্রত্যেক ভারতীয় চেয়েছিল পূরণ হোক, ওই কোটি স্বপ্নের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারত সরকারের সমর্থন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার দাবিতে ভারতীয় জনসংঘ ১৯৭১ সালের ১ থেকে ১১ আগস্ট গণসত্যাগ্রহ পালন করে। ওই আয়োজনের নেতৃত্বে ছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ি। সম্মাননা শেষে বক্তৃতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, যিনি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা, তার হাত থেকে এ সম্মাননা নিচ্ছি। এটাই অনেক গৌরবের। বঙ্গবন্ধু, যার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এবং বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে, তার মেয়ের উপস্থিতিতে এ সম্মান দেওয়া হচ্ছে। মোদির হাতে বাজপেয়ির সম্মাননা তুলে দিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, বিরোধী রাজনীতিতে থেকেও অটল বিহারী বাজপেয়ি বাংলাদেশের সমর্থনের জন্য কাজ করেছেন। তাকে সম্মাননা দেওয়াটা আমাদের কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন।