সাময়িকী.কম
রবিউল ইসলাম রবি
রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত শাহজাদপুর কাচারিবাড়ির সঙ্গে আমার সাংবাদিকতা জীবনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। এই স্মৃতি আজও আমার হৃদয় আলোড়িত করে, আমি আনন্দিত হই। কাচারিবাড়িতে রক্ষিত অর্ডার বুক থেকে জানা যায়, জমিদারি দেখাশোনার কাজে কবিগুরু ১৮৯০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম শাহজাদপুর আসেন। ১৮৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তিনি এখানে এসেছেন। শাহজাদপুর কাচারিবাড়ি অষ্টাদশ শতাব্দীতে ছিল নীলকরদের কুঠি। যে কারণে এখনো এটা ‘কুঠিবাড়ি’ বলে পরিচিত। পরে কবিগুরুর ঠাকুরদাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৪০ সালে শাহজাদপুরের জমিদারি নিলামে উঠলে মাত্র ১৩ টাকা ১০ আনায় কিনে নেন। এই এলাকা নাটোরের জমিদারির অংশ ছিল। জমিদারি কিনে নিলে প্রায় ১০ বিঘা জমিসহ এই কুঠিবাড়িটিও কবি পরিবারের হাতে আসে।
কবিগুরু পিতার নির্দেশে জমিদারির কাজে শাহজাদপুরে বিভিন্ন সময় এসেছেন। এখানে অবস্থানকালে তিনি শুধু জমিদারি দেখাশোনার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, প্রয়োজনকে ছাপিয়ে তার মনের মধ্যে জায়গা করে নেয় সাহিত্য সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। কুঠিবাড়িতে বসেই তিনি কালজয়ী সাহিত্য রচনা করেছেন। যেগুলো ‘সোনার তরী’ কাব্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ সময় তিনি কিছু ছোটগল্পও রচনা করেন। সেগুলোর মধ্যে ‘দুই পাখি’, ‘ব্যর্থ যৌবন’, ‘কুমার সম্ভবের গান’, ‘ইছামতি নদী’, ‘পোস্ট মাস্টার’, ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘ছুটি’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘অতিথি’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর বাইরেও কবি এ সময় ছিন্নপত্র এবং ছিন্নপত্রাবলির আটত্রিশটি পত্র রচনা করেন। পাশাপাশি গানও তিনি রচনা করেছেন শাহজাদপুর কাচারিবাড়িতে বসে।
ঠাকুর পরিবারের জমিদারি ভাগাভাগি হলে শাহজাদপুরের জমিদারি চলে যায় কবির অন্য শরিকদের হাতে। ফলে ১৮৯৭ সালের পর তিনি আর শাহজাদপুর আসেননি। শাহজাদপুর ছিল কবিগুরুর অত্যন্ত প্রিয় এবং ভালোলাগার স্থান। বিভিন্ন লেখায় বিশেষ করে ছিন্নপত্রাবলিতে তিনি সে কথা গভীর আবেগে স্মরণ করেছেন। ১৮৯৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর শাহজাদপুর থেকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেছেন : এখানে (শাহজাদপুর) যেমন আমার মনে লেখার ভাব ও ইচ্ছা আসে, এমন কোথাও না। (ছিন্নপত্র-পত্র সংখ্যা ১২৯)।
১৯৪০ সালে কবিগুরুর মৃত্যুর পর শাহজাদপুর কাচারিবাড়ি অযত্ন অবহেলায় নষ্ট হতে থাকে। তদুপরি ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর বাড়িটি পাকিস্তান সরকার প্রথমে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে এবং পরে খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করে। পরে বাড়িটি শাহজাদপুর ভূমি অফিসকে বরাদ্দ দেয়া হয়। ফলে ভবনের নিচ তলা শাহজাদপুর তহশিল অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। উপর তলায় কবিগুরু যেখানে থাকতেন সেটি নায়েব তহশিলদারদের থাকা-খাওয়া ও রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, কবিগুরুর ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলোও তারা ব্যবহার করতে থাকে। এভাবেই ভবনটি সকলের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।
১৯৬৮ সাল। আমি তখন সবেমাত্র ‘দৈনিক সংবাদ’-এর পাবনা জেলা (পাবনা-সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি। হঠাৎ চিঠি পেলাম অফিস থেকে। সেখানে লেখা : ‘আপনি শাহজাদপুর গিয়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করে ঠাকুরবাড়ির উপর ছবিসহ একটি প্রতিবেদন তৈরি করে যত দ্রুত সম্ভব পাঠাবেন।’ অফিসের নির্দেশ পেয়ে পরদিন গেলাম কাচারিবাড়িতে। পাবনা-ঢাকা মহাসড়ক দিয়ে শাহজাদপুর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালে ডান দিকে গেলেই সামনে বাজার। এখানে সাপ্তাহিক হাটও বসে। হাটের নাম দ্বারিয়াপুর হাট। এই হাটসংলগ্ন একটি গ্রাম- দ্বারিয়াপুর। জনশ্রুতি রয়েছে, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের নামানুসারে এই এলাকাটির নামকরণ করা হয়। হাটে পৌঁছেই দেখতে পেলাম একটি মাঠ। মাঠের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বহু স্মৃতির নীরব সাক্ষী শাহজাদপুর ঠাকুরবাড়ি। হলুদ রঙের দ্বিতল পাকা ভবন। পাশে ভগ্নপ্রায় আরও কয়েকটি একতলা ভবন। কুঠিবাড়ির পাশে ফাঁকা জায়গা। হাটবার ছাড়া অন্যান্য দিন সকালে সেখানে বাঁশ, খড়ি ইত্যাদি বিক্রি হয় বলে স্থানীয়রা জানালেন। আমি যথারীতি উত্তর পাশ দিয়ে ঠাকুরবাড়ির বারান্দায় গিয়ে পৌঁছলাম।
বাড়িটির পূর্বপাশ দিয়ে বয়ে গেছে করতোয়া নদীর একটি শাখা। কুঠিবাড়ি চত্বরের পশ্চিম দিকে ছিল ঠাকুর জমিদারির মালখানা আর কর্মচারীদের বাসস্থান। সে বাড়িগুলোর অবস্থাও দেখলাম অনেকটাই জীর্ণ- ইট, চুন, সুরকি খসে পড়েছে। এবার নিচতলার চারদিকে ঘুরে দেখলাম। নিচতলার উত্তর দিকে ছিল একটি পাঠাগার। পাঠাগারে প্রবেশ করেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানলাম কবিগুরুর অনেক বই পাঠকরা নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। যে বইগুলো অবশিষ্ট রয়েছে সেগুলোর অবস্থাও ওই ভবনের মতো। দেখাশোনার কেউ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে তদারকি করা হয় না। পাঠাগারের একটি পরিচালনা কমিটি আছে কিন্তু তাদেরও পাঠাগার উন্নয়নে কোনো পরিকল্পনা নেই বলেই মনে হলো।
নিচতলায় একটি পোস্ট অফিসও দেখতে পেলাম। সামনের উত্তর দিকে প্রধান প্রবেশপথ। লোহার শিক আর মাঝে মাঝে ইটের পিলার দিয়ে কুঠিবাড়ির সম্মুখভাগ ঘেরা। তাও আবার অনেক জায়গায় ভাঙা। স্থানীয় জনৈক ব্যক্তির কাছ থেকে জানা গেল কুঠিবাড়ির উত্তর ও দক্ষিণ দিকে বাগান ছিল কিন্তু তার অস্তিত্ব লুপ্তপ্রায়। কুঠিবাড়ির চতুর্দিকে আম, লিচু, ঝাউগাছ ও ফুলের বাগান ছিল। যত্নের অভাবে সেগুলোও নেই। উত্তরের বারান্দায় অবস্থিত সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলাম। দোতলায় বারান্দার চতুর্দিকে রেলিং ছিল কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না। এক সময় দক্ষিণের বারান্দা থেকে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠবার ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু তার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না। একজন দাঁড়িয়ে আছেন দেখে পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘আমি হাসান আলী, ঠাকুরবাড়ি পাহারা দেই। বাবুরা চলে গেলেন, আমরা সেই থেকে এখানেই আছি। আমার বাবা কোরবান আলী ছিলেন কবিগুরুর খাস কামরার লোক।’ হাসান আলীকে নিয়ে কবি যেখানে থাকতেন সেই ঘরগুলো দেখলাম। তিনি বর্ণনা দিতে লাগলেন, কোন ঘরে কবি থাকতেন, কোন ঘরে লেখালেখি করতেন, কোন ঘরে অতিথিদের নিয়ে বসতেন ইত্যাদি।
আমি সব দেখে মর্মাহত হলাম, কষ্ট পেলাম। কারণ তখন সেখানে নায়েব তহশিলদাররা থাকছেন। এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহারে ক্ষুব্ধ না হয়ে উপায় ছিল না। সেদিন আমি সেখানে গিয়ে দেখলাম, কবির কত স্মৃতি উপেক্ষিত হয়েছে। দেখলাম পূর্ব পাশের যে ঘরে কবি রচনা করেছেন অমূল্য সব রচনা সেই ঘর তহশিলদারেরা প্রস্রাবখানা হিসেবে ব্যবহার করছেন। ভাবা যায়! কবির ব্যবহার করা পালকি ব্যবহৃত হচ্ছে নায়েব সাহেবদের জুতা, স্যান্ডেল রাখার কাজে। শ্বেত পাথরের যে বিরাট টেবিল ছিল, কবি ব্যবহার করতেন, সেই টেবিলে তরকারি এবং হাঁড়ি-পাতিল রাখা! কবির বসবার ঘরে সোফা দেখা গেলো বটে কিন্তু কাপড় দিয়ে ঢাকা। কবির হারমোনিয়ামটির ওপর কয়েক পরতের ধূলা জমে আছে। এ ছাড়া সেকালের বাতি, একটি টানা পাখা, দরজায় ঝোলানো পর্দা, কবি পরিবারের বেশ কিছু ছবিও দেখেছিলাম। কবির শোবার ঘরে দুটি পালঙ্ক, এক কোণে দুটি টেবিল, আয়না, কাপড় রাখার আলনা, গুটিকয় চেয়ার, ইজি চেয়ার ইত্যাদি রাখা দেখলাম। এগুলো সবই কবির ব্যবহৃত স্মৃতিচিহ্ন। অথচ সেগুলো ভূমি অফিসের কর্মচারীরা ব্যবহার করছেন। এরপর ঘুরে ঘুরে দেখলাম কবির ব্যবহৃত একজোড়া খড়ম, নলসমেত হুঁকো, ফুলদানী, রান্না ঘরে ব্যবহৃত তৈজসপত্র, কাপ পিরিচ, হট ওয়াটার পট, হট ওয়াটার ট্রে, লণ্ঠন, শতছিন্ন বালিশের ওয়াড়, মশারি আর লেপের ছিন্নবিচ্ছিন্ন ওয়াড়। হাসান আলীই সব দেখালেন এবং বললেনও অনেক কিছু।
মনে কষ্ট নিয়ে ঠাকুরবাড়ি থেকে পাবনা চলে এলাম। পরদিন একটি প্রতিবেদন তৈরি করে ৮-১০ টি ছবিসহ পাঠিয়ে দিলাম। দিন দুয়েক পর ৮ টি ছবিসহ প্রতিবেদনটি ছাপা হলো। প্রতিবেদনটি প্রশংসিতও হলো। আকাশবাণী (কলকাতা) থেকে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সংবাদ পর্যালোচনা করলেন তিনদিন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার বিষয়টি ভালোভাবে নিল না। তাদের কুদৃষ্টি পড়ল ‘দৈনিক সংবাদ’-এর ওপর। হাইকোর্টে পত্রিকাটির ডিক্লারেশন বাতিলের মামলা হলো। তৎকালীন সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী ও সহকারী সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার চিঠি লিখে জানালেন, প্রয়োজনীয় প্রমাণপত্র নিয়ে ঢাকা হাইকোর্টে হাজির হতে। মামলায় পত্রিকার সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক ও প্রতিবেদককে আসামি করা হয়েছিল। আমি হাইকোর্টে হাজির হলাম। মামলার শুনানি শুরু হলে প্রমাণপত্র দেখালাম। বিচারক মহোদয় কাগজপত্র দেখে মামলা খারিজ করে দিলেন। একইসঙ্গে ঠাকুরবাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে হস্তান্তরসহ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রদান করার নির্দেশ দেয়া হলো।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দায়িত্ব গ্রহণ করে শাহজাদপুর ঠাকুরবাড়িতে এলো। তাদের সঙ্গে এ বিষয়ক আলোচনা হলো। তারা উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রবীন্দ্র কুঠিবাড়িকে ‘রবীন্দ্রস্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে ঘোষণা দিলেন। বলাবাহুল্য এ ঘোষণায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম। কারণ এর পেছনে কিছুটা হলেও আমি সেদিন অবদান রাখতে পেরেছিলাম- এটা ভেবে আজও আমার গর্ব হয়। এরপর থেকেই বাড়িটি নতুন করে সাজানো হয়। ইউরোপীয় ও রোমান স্থাপত্য ধারায় নির্মিত দ্বিতল বাড়িটিতে রবীন্দ্রস্মৃতির অনেক নিদর্শন রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে রবি ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত অনেক ছবি নিচতলায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রবীন্দ্র সান্নিধ্যে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শেরে বাংলা ফজলুল হকসহ প্রথিতযশা ব্যক্তিদের ছবি আছে জাদুঘরে। কবির পারিবারিক অনেক ছবিও সেখানে আছে। আরও আছে কবির নোবেল সনদপ্রাপ্তি এবং শান্তি নিকেতনে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর সংবর্ধনার ছবি। এ ছাড়াও জাদুঘরে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি, পাণ্ডুলিপির ওপর তাঁর চিত্রাঙ্কন অনুশীলন এবং অনেক চিত্রকর্মের ছবি। তাঁর ব্যবহৃত খাট, সোফা, আলনা, আরাম কেদারা, ব্রোঞ্জ নির্মিত দ্রব্যসামগ্রী সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দর্শনার্থীরা যা দেখে আজ অবধি মুগ্ধ হচ্ছেন।
লেখক : সভাপতি, পাবনা প্রেসক্লাব
রবিউল ইসলাম রবি
রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত শাহজাদপুর কাচারিবাড়ির সঙ্গে আমার সাংবাদিকতা জীবনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। এই স্মৃতি আজও আমার হৃদয় আলোড়িত করে, আমি আনন্দিত হই। কাচারিবাড়িতে রক্ষিত অর্ডার বুক থেকে জানা যায়, জমিদারি দেখাশোনার কাজে কবিগুরু ১৮৯০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম শাহজাদপুর আসেন। ১৮৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তিনি এখানে এসেছেন। শাহজাদপুর কাচারিবাড়ি অষ্টাদশ শতাব্দীতে ছিল নীলকরদের কুঠি। যে কারণে এখনো এটা ‘কুঠিবাড়ি’ বলে পরিচিত। পরে কবিগুরুর ঠাকুরদাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৪০ সালে শাহজাদপুরের জমিদারি নিলামে উঠলে মাত্র ১৩ টাকা ১০ আনায় কিনে নেন। এই এলাকা নাটোরের জমিদারির অংশ ছিল। জমিদারি কিনে নিলে প্রায় ১০ বিঘা জমিসহ এই কুঠিবাড়িটিও কবি পরিবারের হাতে আসে।
কবিগুরু পিতার নির্দেশে জমিদারির কাজে শাহজাদপুরে বিভিন্ন সময় এসেছেন। এখানে অবস্থানকালে তিনি শুধু জমিদারি দেখাশোনার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, প্রয়োজনকে ছাপিয়ে তার মনের মধ্যে জায়গা করে নেয় সাহিত্য সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। কুঠিবাড়িতে বসেই তিনি কালজয়ী সাহিত্য রচনা করেছেন। যেগুলো ‘সোনার তরী’ কাব্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ সময় তিনি কিছু ছোটগল্পও রচনা করেন। সেগুলোর মধ্যে ‘দুই পাখি’, ‘ব্যর্থ যৌবন’, ‘কুমার সম্ভবের গান’, ‘ইছামতি নদী’, ‘পোস্ট মাস্টার’, ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘ছুটি’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘অতিথি’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর বাইরেও কবি এ সময় ছিন্নপত্র এবং ছিন্নপত্রাবলির আটত্রিশটি পত্র রচনা করেন। পাশাপাশি গানও তিনি রচনা করেছেন শাহজাদপুর কাচারিবাড়িতে বসে।
ঠাকুর পরিবারের জমিদারি ভাগাভাগি হলে শাহজাদপুরের জমিদারি চলে যায় কবির অন্য শরিকদের হাতে। ফলে ১৮৯৭ সালের পর তিনি আর শাহজাদপুর আসেননি। শাহজাদপুর ছিল কবিগুরুর অত্যন্ত প্রিয় এবং ভালোলাগার স্থান। বিভিন্ন লেখায় বিশেষ করে ছিন্নপত্রাবলিতে তিনি সে কথা গভীর আবেগে স্মরণ করেছেন। ১৮৯৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর শাহজাদপুর থেকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেছেন : এখানে (শাহজাদপুর) যেমন আমার মনে লেখার ভাব ও ইচ্ছা আসে, এমন কোথাও না। (ছিন্নপত্র-পত্র সংখ্যা ১২৯)।
১৯৪০ সালে কবিগুরুর মৃত্যুর পর শাহজাদপুর কাচারিবাড়ি অযত্ন অবহেলায় নষ্ট হতে থাকে। তদুপরি ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর বাড়িটি পাকিস্তান সরকার প্রথমে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে এবং পরে খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করে। পরে বাড়িটি শাহজাদপুর ভূমি অফিসকে বরাদ্দ দেয়া হয়। ফলে ভবনের নিচ তলা শাহজাদপুর তহশিল অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। উপর তলায় কবিগুরু যেখানে থাকতেন সেটি নায়েব তহশিলদারদের থাকা-খাওয়া ও রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, কবিগুরুর ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলোও তারা ব্যবহার করতে থাকে। এভাবেই ভবনটি সকলের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।
১৯৬৮ সাল। আমি তখন সবেমাত্র ‘দৈনিক সংবাদ’-এর পাবনা জেলা (পাবনা-সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি। হঠাৎ চিঠি পেলাম অফিস থেকে। সেখানে লেখা : ‘আপনি শাহজাদপুর গিয়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করে ঠাকুরবাড়ির উপর ছবিসহ একটি প্রতিবেদন তৈরি করে যত দ্রুত সম্ভব পাঠাবেন।’ অফিসের নির্দেশ পেয়ে পরদিন গেলাম কাচারিবাড়িতে। পাবনা-ঢাকা মহাসড়ক দিয়ে শাহজাদপুর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালে ডান দিকে গেলেই সামনে বাজার। এখানে সাপ্তাহিক হাটও বসে। হাটের নাম দ্বারিয়াপুর হাট। এই হাটসংলগ্ন একটি গ্রাম- দ্বারিয়াপুর। জনশ্রুতি রয়েছে, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের নামানুসারে এই এলাকাটির নামকরণ করা হয়। হাটে পৌঁছেই দেখতে পেলাম একটি মাঠ। মাঠের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বহু স্মৃতির নীরব সাক্ষী শাহজাদপুর ঠাকুরবাড়ি। হলুদ রঙের দ্বিতল পাকা ভবন। পাশে ভগ্নপ্রায় আরও কয়েকটি একতলা ভবন। কুঠিবাড়ির পাশে ফাঁকা জায়গা। হাটবার ছাড়া অন্যান্য দিন সকালে সেখানে বাঁশ, খড়ি ইত্যাদি বিক্রি হয় বলে স্থানীয়রা জানালেন। আমি যথারীতি উত্তর পাশ দিয়ে ঠাকুরবাড়ির বারান্দায় গিয়ে পৌঁছলাম।
বাড়িটির পূর্বপাশ দিয়ে বয়ে গেছে করতোয়া নদীর একটি শাখা। কুঠিবাড়ি চত্বরের পশ্চিম দিকে ছিল ঠাকুর জমিদারির মালখানা আর কর্মচারীদের বাসস্থান। সে বাড়িগুলোর অবস্থাও দেখলাম অনেকটাই জীর্ণ- ইট, চুন, সুরকি খসে পড়েছে। এবার নিচতলার চারদিকে ঘুরে দেখলাম। নিচতলার উত্তর দিকে ছিল একটি পাঠাগার। পাঠাগারে প্রবেশ করেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানলাম কবিগুরুর অনেক বই পাঠকরা নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। যে বইগুলো অবশিষ্ট রয়েছে সেগুলোর অবস্থাও ওই ভবনের মতো। দেখাশোনার কেউ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে তদারকি করা হয় না। পাঠাগারের একটি পরিচালনা কমিটি আছে কিন্তু তাদেরও পাঠাগার উন্নয়নে কোনো পরিকল্পনা নেই বলেই মনে হলো।
নিচতলায় একটি পোস্ট অফিসও দেখতে পেলাম। সামনের উত্তর দিকে প্রধান প্রবেশপথ। লোহার শিক আর মাঝে মাঝে ইটের পিলার দিয়ে কুঠিবাড়ির সম্মুখভাগ ঘেরা। তাও আবার অনেক জায়গায় ভাঙা। স্থানীয় জনৈক ব্যক্তির কাছ থেকে জানা গেল কুঠিবাড়ির উত্তর ও দক্ষিণ দিকে বাগান ছিল কিন্তু তার অস্তিত্ব লুপ্তপ্রায়। কুঠিবাড়ির চতুর্দিকে আম, লিচু, ঝাউগাছ ও ফুলের বাগান ছিল। যত্নের অভাবে সেগুলোও নেই। উত্তরের বারান্দায় অবস্থিত সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলাম। দোতলায় বারান্দার চতুর্দিকে রেলিং ছিল কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না। এক সময় দক্ষিণের বারান্দা থেকে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠবার ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু তার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না। একজন দাঁড়িয়ে আছেন দেখে পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘আমি হাসান আলী, ঠাকুরবাড়ি পাহারা দেই। বাবুরা চলে গেলেন, আমরা সেই থেকে এখানেই আছি। আমার বাবা কোরবান আলী ছিলেন কবিগুরুর খাস কামরার লোক।’ হাসান আলীকে নিয়ে কবি যেখানে থাকতেন সেই ঘরগুলো দেখলাম। তিনি বর্ণনা দিতে লাগলেন, কোন ঘরে কবি থাকতেন, কোন ঘরে লেখালেখি করতেন, কোন ঘরে অতিথিদের নিয়ে বসতেন ইত্যাদি।
আমি সব দেখে মর্মাহত হলাম, কষ্ট পেলাম। কারণ তখন সেখানে নায়েব তহশিলদাররা থাকছেন। এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহারে ক্ষুব্ধ না হয়ে উপায় ছিল না। সেদিন আমি সেখানে গিয়ে দেখলাম, কবির কত স্মৃতি উপেক্ষিত হয়েছে। দেখলাম পূর্ব পাশের যে ঘরে কবি রচনা করেছেন অমূল্য সব রচনা সেই ঘর তহশিলদারেরা প্রস্রাবখানা হিসেবে ব্যবহার করছেন। ভাবা যায়! কবির ব্যবহার করা পালকি ব্যবহৃত হচ্ছে নায়েব সাহেবদের জুতা, স্যান্ডেল রাখার কাজে। শ্বেত পাথরের যে বিরাট টেবিল ছিল, কবি ব্যবহার করতেন, সেই টেবিলে তরকারি এবং হাঁড়ি-পাতিল রাখা! কবির বসবার ঘরে সোফা দেখা গেলো বটে কিন্তু কাপড় দিয়ে ঢাকা। কবির হারমোনিয়ামটির ওপর কয়েক পরতের ধূলা জমে আছে। এ ছাড়া সেকালের বাতি, একটি টানা পাখা, দরজায় ঝোলানো পর্দা, কবি পরিবারের বেশ কিছু ছবিও দেখেছিলাম। কবির শোবার ঘরে দুটি পালঙ্ক, এক কোণে দুটি টেবিল, আয়না, কাপড় রাখার আলনা, গুটিকয় চেয়ার, ইজি চেয়ার ইত্যাদি রাখা দেখলাম। এগুলো সবই কবির ব্যবহৃত স্মৃতিচিহ্ন। অথচ সেগুলো ভূমি অফিসের কর্মচারীরা ব্যবহার করছেন। এরপর ঘুরে ঘুরে দেখলাম কবির ব্যবহৃত একজোড়া খড়ম, নলসমেত হুঁকো, ফুলদানী, রান্না ঘরে ব্যবহৃত তৈজসপত্র, কাপ পিরিচ, হট ওয়াটার পট, হট ওয়াটার ট্রে, লণ্ঠন, শতছিন্ন বালিশের ওয়াড়, মশারি আর লেপের ছিন্নবিচ্ছিন্ন ওয়াড়। হাসান আলীই সব দেখালেন এবং বললেনও অনেক কিছু।
মনে কষ্ট নিয়ে ঠাকুরবাড়ি থেকে পাবনা চলে এলাম। পরদিন একটি প্রতিবেদন তৈরি করে ৮-১০ টি ছবিসহ পাঠিয়ে দিলাম। দিন দুয়েক পর ৮ টি ছবিসহ প্রতিবেদনটি ছাপা হলো। প্রতিবেদনটি প্রশংসিতও হলো। আকাশবাণী (কলকাতা) থেকে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সংবাদ পর্যালোচনা করলেন তিনদিন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার বিষয়টি ভালোভাবে নিল না। তাদের কুদৃষ্টি পড়ল ‘দৈনিক সংবাদ’-এর ওপর। হাইকোর্টে পত্রিকাটির ডিক্লারেশন বাতিলের মামলা হলো। তৎকালীন সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী ও সহকারী সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার চিঠি লিখে জানালেন, প্রয়োজনীয় প্রমাণপত্র নিয়ে ঢাকা হাইকোর্টে হাজির হতে। মামলায় পত্রিকার সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক ও প্রতিবেদককে আসামি করা হয়েছিল। আমি হাইকোর্টে হাজির হলাম। মামলার শুনানি শুরু হলে প্রমাণপত্র দেখালাম। বিচারক মহোদয় কাগজপত্র দেখে মামলা খারিজ করে দিলেন। একইসঙ্গে ঠাকুরবাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে হস্তান্তরসহ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রদান করার নির্দেশ দেয়া হলো।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দায়িত্ব গ্রহণ করে শাহজাদপুর ঠাকুরবাড়িতে এলো। তাদের সঙ্গে এ বিষয়ক আলোচনা হলো। তারা উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রবীন্দ্র কুঠিবাড়িকে ‘রবীন্দ্রস্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে ঘোষণা দিলেন। বলাবাহুল্য এ ঘোষণায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম। কারণ এর পেছনে কিছুটা হলেও আমি সেদিন অবদান রাখতে পেরেছিলাম- এটা ভেবে আজও আমার গর্ব হয়। এরপর থেকেই বাড়িটি নতুন করে সাজানো হয়। ইউরোপীয় ও রোমান স্থাপত্য ধারায় নির্মিত দ্বিতল বাড়িটিতে রবীন্দ্রস্মৃতির অনেক নিদর্শন রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে রবি ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত অনেক ছবি নিচতলায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রবীন্দ্র সান্নিধ্যে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শেরে বাংলা ফজলুল হকসহ প্রথিতযশা ব্যক্তিদের ছবি আছে জাদুঘরে। কবির পারিবারিক অনেক ছবিও সেখানে আছে। আরও আছে কবির নোবেল সনদপ্রাপ্তি এবং শান্তি নিকেতনে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর সংবর্ধনার ছবি। এ ছাড়াও জাদুঘরে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি, পাণ্ডুলিপির ওপর তাঁর চিত্রাঙ্কন অনুশীলন এবং অনেক চিত্রকর্মের ছবি। তাঁর ব্যবহৃত খাট, সোফা, আলনা, আরাম কেদারা, ব্রোঞ্জ নির্মিত দ্রব্যসামগ্রী সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দর্শনার্থীরা যা দেখে আজ অবধি মুগ্ধ হচ্ছেন।
লেখক : সভাপতি, পাবনা প্রেসক্লাব