বলা হয়ে থাকে সাংবাদিক রাষ্ট্রের বিবেক। আর চিকিৎসক জনগণের রক্ষাকর্তা। কিন্তু এই দুই শ্রেণীর মানব যখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ন হয়, তখন সত্যিই বলতে হয়- রাষ্ট্র এবং তার জনগণ চরম দূর্যোগের সম্মূখীন।
আমি নিজে একজন সাংবাদিক হয়েও কিছু মানুষের কারণে এই পেশার বিরুদ্ধে লিখতে হচ্ছে। বুকের ভেতর কোথায় যেন খঁচখঁচ করছে। মনে হচ্ছে, আমি আত্মঘাতী কাজ করছি। কিন্তু যখন স্বজাতি পথভ্রষ্ট হয়, তখন আমরা বাধ্য- তাদেরকে পথে ফেরাতে। সমালোচনা করেই হোক অথবা কঠোর হয়ে- যেকোনো উপায়ে বৃহত্তর স্বার্থে আত্মসমালোচনায় মূখর হতেই হয় সবাইকেই।
কিছু ঘটনা চিত্র তুলে ধরছি এখানে। আমার কাছে এসবের কোনো প্রমাণ নেই। কতক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভূক্তভোগীর কাছে শোনা, কতক নিজে চাক্ষুষ করা। তবে আমার বিশ্বাস- এই চিত্রগুলো পুরো বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরতে যথেষ্ট। বর্তমান পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে আরো ভয়াবহ।
ঘটনা এক: এটা আসলে কোনো একক ঘটনা নয়। একটা চিত্র বলতে পারেন। আমার জন্মস্থানের উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স-এর একটা অনুচিত্র। অনেক ভুক্তভোগীর কাছেই শুনেছি, সেখানের দায়িত্বরত বেশিরভাগ ডাক্তারই নাকি প্যাথলজিক্যাল ল্যাবগুলোকে রিপোর্ট দেরিতে দিতে উৎসাহিত করে। কারণ, এতে তার ডিউটি আওয়ার শেষ হয়ে যাবে। আউটডোর রোগীদের ক্ষেত্রে দেরিতে রিপোর্ট আসায় বাধ্য হয়েই যেতে হয় ডাক্তারের চেম্বারে। তখনকার ফিসহ অন্যান্য বাজনা কেমন বাজে- তা এদেশের অসচেতন জনতাও জানে।
এটা কি চাঁদাবাজি নয়?
ঘটনা দুই: আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছুটিতে বাড়ি গেছি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক ডাক্তারের অবহেলার কারণে এক শিশুর মৃত্যু ঘটে। এতে জনমেনে প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়। এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, ডাক্তার গ্রেপ্তার হবেন হবেন। এই পরিস্থিতিও এড়িয়ে সেই খুনী ডাক্তার বেঁচে গিয়েছিলেন। কীভাবে? শুধুমাত্র পুলিশ এবং সাংবাদিকদের টাকা খাইয়ে। এটা আমার মনগড়া কল্পনা নয়। ঘটনার মাঝে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আমার এক বাল্যবন্ধুও ছিল। তার মুখ থেকেই শুনেছি সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা। শিশুর পরিবার আজ পর্যন্ত কোনো বিচার পায়নি!
ঘটনা তিন: এঘটনাও আমার এলাকার। স্থানীয় সাংবাদিক, আমার এক পরিচিত বড়ভাই আমারই সামনে একদিন ফোনে কাকে যেন হুমকি দিচ্ছেন- মাল সময়মত না পৌঁছালে রিপোর্ট করে দেবো।
সেসময়ও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়িয়ে কর্মজীবনে এসে দাঁড়াইনি। বড়ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম- কী এবং কেন?
বিজ্ঞের মতো স্মিত হেসে তিনি উত্তর করলেন- দেশের বেশিরভাগ মানুষের মাঝেই ভেজাল আছে। কাজেই সেই দূর্বলতা কাজে লাগিয়ে যদি দুই-চার পয়সা না উপার্জন করা গেল, তাহলে সাংবাদিক হয়ে কী লাভ হল?
আমি নির্বাক!
ঘটনা চার: আমার কলেজ জীবনের এক বন্ধু মেডিকেলে ইন্টার্নি করার সময় একদিন রসিকতা করতেই বলছিল- আর তো মাত্র ক’টা দিন। এরপরই টাকা আর টাকা!
আমি প্রশ্ন করলাম- কীভাবে?
সে উত্তর করল- বাংলাদেশে টাকা কামানোর সবচেয়ে নিশ্চিত পথের নাম ডাক্তারি।
আমি প্রশ্ন করলাম- তাহলে মানবসেবা কোথায় যাবে?
তার সরাসরি জবাব- এতো এতো টাকা খরচ করে ডাক্তার হলাম মানবসেবা করতে? আগে টাকা কামাবো, তারপর শেষ বয়সে সে টাকা হালাল করতে কিছুটা মানবসেবা করবো। শেষ। দেনাপাওনা মিটে যাবে।
এবারো আমি নির্বাক!
চারটা ঘটনাই বিচ্ছিন্ন এবং বিভিন্ন সময়ের হলেও আমি মনেপ্রানে বিশ্বাস করি- এই চিত্র দেশের সকল স্থানেরই। যদি দেশের প্রধান দু’টো অঙ্গ এমন দুষিত হয়ে পড়ে, তাহলে দেশ কীভাবে বিশুদ্ধ থাকতে পারে?
আমার কেন যেন মনে হয়- চিকিৎসক এবং সাংবাদিকদের চাঁদাবাজ বানিয়েছে প্রশাসন এবং মিডিয়া। কীভাবে? আমি বিশ্বাস করি না- চিকিৎসায় দেশে এমন অরাজকতা চলছে আর প্রশাসন তা জানে না। জেনেশুনে তারা চোখ বন্ধ করে রেখেছে। আর এই পরোক্ষ প্রশ্রয়েই চিকিৎসকরা হয়ে উঠছেন কষাই!
একইভাবে একজন সাংবাদিক যখন কাউকে হুমকি দেয়, রিপোর্ট করে দেবো। তখন স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, এমন কথা বলার ক্ষমতা তাকে কে দিয়েছে? উত্তর একটাই- কর্মস্থল। আমি সাংবাদিক। কাজেই আমি জানি- চাইলেই যেকোনো রিপোর্ট ছাপানো যায় না। সম্পাদক এবং কর্মস্থল সৎ হলে এবং জনগণের প্রতি নিজ তাগিদে দায়বদ্ধ থাকলে কখনোই একজন সাংবাদিক চাঁদাবাজি করতে হুমকি-ধামকি দেওয়ার সাহস পাবে না।
অতএব আমার বিচারে- প্রশাসন এবং মিডিয়াই চিকিৎসক এবং সাংবাদিকদের লাইসেন্সধারী চাঁদাবাজে পরিণত করেছে। এছাড়া আর কিছু নয়। আজ প্রশাসন সোচ্চার হোক, মিডিয়া হাউজগুলো দায়বদ্ধতার প্রশ্নে সততা বজায় রাখুক- কাল থেকে দেশে আর কোনো রোগী যেমন অবহেলার কারণে মারা পড়বে না, কোনো রোগীকে ভোগান্তর শিকার হতে হবে না; একইভাবে কোনো মানুষকে হুমকি দেওয়ার সুযোগ পাবে না কোনো সাংবাদিক।
রাজিউল হাসান