সাময়িকী.কম
১৮ জুন প্রথম আলোয় ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়। ওই দিনই অফিসে এসে একটি টেলিফোন পেলাম। নিজের পরিচয় দিয়ে টেলিফোনদাতা বললেন, আমি নারায়ণগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মোহাম্মদ বশিরউদ্দীন। আপনারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি নামে যে সম্পাদকীয়টি লিখেছেন, সে জন্য ধন্যবাদ জানাই।
সাত খুনের পর বেশ কয়েকবার নারায়ণগঞ্জ গেলেও তাঁর সঙ্গে আর কথা হয়নি। কথা হয়েছে সাবেক এসপি, ডিসিসহ আরও অনেকের সঙ্গে, যাঁরা নিজেদের নিষ্কলুষ ও নিষ্পাপ দাবি করতেন। কিন্তু এখন খবর বের হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জের প্রশাসন, পুলিশ ও র‌্যাবের অনেক বড় কর্তাই নূর হোসেনের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেতেন।
১৮ জুন এএসপি বশিরউদ্দীনের কথা শুনে পুলিশ সম্পর্কে আগের ধারণাটিই পাল্টে গেল। তাহলে সব পুলিশ খারাপ নন। সবাই হাতে কাগজ পেয়ে ব্ল্যাকমেলও করেন না।
র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সম্পর্কে অনেক বদনাম। ইদানীং সেই বদনামের মাত্রাটি আরও বেড়েছে। কয়েক দিন আগে সাভারে এক পুলিশ কর্মকর্তা একজন রিকশাচালকের কাছে এক হাজার টাকা ঘুষ চেয়েছিলেন। গরিব রিকশাচালক সেই টাকা দিতে না পারায় তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করে রাস্তার ওপরই ফেলে রেখে যায় পুলিশ। পুলিশের গ্রেপ্তার-বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। পুলিশের চাঁদাবাজি, ঘুষ যেমন স্বাভাবিক ব্যাপার, তেমনি তাদের হাতে নিরীহ ও সাধারণ মানুষের লাঞ্ছিত হওয়াও গা-সওয়া হয়ে গেছে।
এই অবস্থায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি নেওয়ার মাধ্যমে যে দুর্নীতি হয়েছে, সেই খবর একজন পুলিশ কর্মকর্তার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গণমাধ্যমে জানানো বিরল ও ব্যতিক্রম ঘটনাই বটে। চাইলে তিনি ওই কাগজপত্র দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ আদায় করতে পারতেন। এএসপি বশির তা করেননি। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে পুলিশ বিভাগেও অনেক সৎ মানুষ আছেন।
কিন্তু গত বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে যা ঘটল, তাতে ওই পুলিশ কর্মকর্তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এল। আমাদের সমাজের মাথা বলে পরিচিত ব্যক্তিরা যখন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে আপস ও পলায়নকে জাতীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তখন এই পুলিশ কর্মকর্তা সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে সমাজটি এখনো পচে যায়নি। এখনো সত্য কথা বলার মানুষ আছেন।
ভোটের অঙ্কে বিজয়ী সেলিম ওসমান বা পরাজিত এস এম আকরাম নন, সেই সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ বশিরউদ্দীনই হলেন নারায়ণগঞ্জের উপনির্বাচনের নায়ক। কীভাবে? তিনি নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করছিলেন বন্দর উপজেলার মদনপুর কেওঢালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে। শামীম ও সেলিম ওসমানের অনুসারী (আওয়ামী লীগ করেন না জাতীয় পার্টি করেন, না তিনি দুটোই একসঙ্গে করেন, জানা গেল না) স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুস সালাম দলবল নিয়ে কেন্দ্রটি দখল করতে গেলে তিনি বাধা দেন। তাঁকে ভোটকেন্দ্রের এলাকা ছেড়ে যেতে বলেন। কিন্তু চেয়ারম্যান পুলিশ কর্মকর্তার কথা গ্রাহ্য না করে তাঁকে এই বলে হুমকি দেন যে তাঁকে ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়া না হলে সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ মাথা নিয়ে যেতে পারবে না। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের পরও মাথা নেওয়ার প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়ার মানুষ নারায়ণগঞ্জে আছে! এ ধরনের লোককে তো রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত করা উচিত৷
এ পর্যায়ে এএসপি বশিরউদ্দীন বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানালে তাঁরা ওই ইউপি চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেন। এর পরই গায়েবি আওয়াজ আসে—তাঁকে ভোটকেন্দ্রটি ছেড়ে যেতে হবে, চেয়ারম্যান সালামকে সদলবলে ভোটকেন্দ্র দখল
করতে দিতে হবে। কেননা, সময় বেশি হাতে নেই। ৭০-৮০ ভাগ ভোট কাস্ট করাতে হবে। ওপার থেকে গায়েবি টেলিফোনটি করেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী সেলিম ওসমানের ভাই আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান।
কিন্তু এএসপি বশির তাঁর কথায় রাজি না হলে শামীম ওসমান কুত্তার বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চা বলে গাল দেন। তাঁকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। তাঁর টেলিফোন সক্রিয় রেখেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে টেলিফোন করার কথাও তাঁকে জানিয়ে দেন। এর পরও দমে যাননি সেই পুলিশ কর্মকর্তা। বলেছেন, ‘আমাকে আমার দায়িত্ব পালন করতে দিন। আমি এখন নির্বাচন কমিশনের অধীনে। অন্য কারও হুকুম তামিল করার এখতিয়ার নেই।’

যে শামীম ওসমানের কথা ছাড়া নারায়ণগঞ্জে নাকি একটি গাছের পাতাও নড়ে না, সেই শামীম ওসমানকে মুখের ওপর যখন একজন পুলিশ কর্মকর্তা এভাবে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অবিচল থাকতে পারেন, তাঁকে সশ্রদ্ধ সালাম জানাই। শাবাশ জানাই। এখনো পুলিশ বিভাগে, সরকারি প্রশাসনে এ ধরনের দু-চারজন কর্মকর্তা আছেন বলেই দেশটি টিকে আছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রশাসন বা পুলিশ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ রকম নিষ্ঠাবান কর্মকর্তার প্রতি কী আচরণ করছেন? তাঁরা কি তাঁকে সুরক্ষা দেবেন? আমরা হতবাক হলাম জেলা পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন এই ঘটনাকে ‘টুকটাক কথাবার্তা’ বলে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি কোন কথাকে টুকটাক কথা কললেন? শুয়োরের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা গালি, নাকি দেখে নেওয়ার হুমকি? একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দায়িত্ব তাঁর অধীন ব্যক্তিকে সুরক্ষা ও অভয় দেওয়া। তিনি যাতে নিজের কর্তব্য পালন করতে পারেন। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের এসপি মহোদয় বিপরীত কাজটিই করলেন। এতে হুমকিদাতা আশকারা পাবেন, আর হুমকিপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন। হয়তো এরপর ওই দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাকে বিএনপি-জামায়াতের লোক বানিয়ে সাসপেন্ড বা খাগড়াছড়ির দুর্গম জঙ্গলে শাস্তিমূলক বদলি করা হবে।
এ ব্যাপারে আমরা নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য শুনতে চাই। নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এএসপি বশির হুমকির শিকার হয়েছেন। নির্বাচন কমিশনেরই দায়িত্ব সেই হুমকিদাতার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। সেই কাজটি নির্বাচন কমিশন করতে পারলে তাদের অতীত গ্লানি কিছুটা হলেও মুছে যেত। মানুষ বলত, অন্তত কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নির্বাচন কমিশন দেশবাসীকে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে না পারলেও অন্তত একটি অন্যায়ের প্রতিকার করেছে।
আর এ ঘটনায় যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে ব্যবহার করা হয়েছে, সেহেতু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েরও স্পষ্ট বক্তব্য চাই। যে কেউ যখন-তখন তাঁদের সমস্ত অপকর্মের ঢাল হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে ব্যবহার করতে পারেন? শামীম ওসমান রাজনীতি করবেন কি করবেন না, সেই বার্তা কেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেবেন?
শাবাশ এএসপি বশিরউদ্দীন। এ রকম দৃঢ়চেতা ও সৎ পুলিশ কর্মকর্তারাই পারেন সমাজের দুষ্ট ক্ষত ও ক্যানসারগুলো ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net

Author Name

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.