ফরহাদ ফজলুল বারী, সাময়িকী.কম
বলা হয়ে থাকে, 'শহরে ইসফাহান/নেসফে জাহান'। সত্যিই তাই, পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্য নিয়ে এক ঘোরলাগা প্রাকৃতিক মহুয়া বন, জনশূন্য বিরান মরুভূমি আর এবড়ো-থেবড়ো সুউচ্চ পাহাড়ের কোল ঘেষে অবস্থান করছে ইসফাহান প্রদেশ। এখানকার উঁচু পাহাড়গুলোর মধ্যে রয়েছে বিদকান এবং সিমানসাফে। সাফাভি শাসনামলের ইরানের রাজধানী ইস্ফাহানের সৌন্দর্যের নয়ানাভিরাম দৃশ্যাবলী আর ইমাম স্কয়ারে ইমাম মসজিদের কারুকার্যময় দেয়ালচিত্র ও চোখ ধাঁধানো রং-বেরঙের হাজারো বাতির আলোর নাচন, কিংবা 'নকশে জাহান' নামের বিখ্যাত বাজারের বাঙ্গময় কোলাহল আজও কানে বাজে, স্ফটিক আলোগুলো চোখে খেলা করে। তাই ইরান ঘুরে আসার চার মাস পরেও "ইরান ভ্রমনের" অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে এসে সবার আগে ইসফাহান শহরের কথাই মনে পড়ে।
৩১'শে জুলাই ২০১৩ থেকে ৫'ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৩৬ দিনের সফরে ইরানের বিভিন্ন শহরে- প্রান্তে-মরুতে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা এই ছোট কলেবরে বর্ণনা করা অনেকটা অনুরোধে ঢেকি গেলার মতই। কী আর করা যাবে কর্তা জহির ভাইয়ের ইচ্ছায় ফরমায়েশি কর্ম ! অনেক মুহূর্ত, অনেক কথা আর প্রবাসী ভাইদের জমানো স্বপ্ন ও ভালোবাসাগুলো বুকে চাপিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু অনুভূতি আর অর্জিত উপলব্ধিগুলোই এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
ইরানের বিজ্ঞান, গবেষণা ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের তত্ত্বাবধানে এবং 'সাদী ফাউন্ডেশান' এর উদ্যোগে ২৫ দিনব্যাপী ভাষাভিত্তিক ৮০তম ফারসি মানোন্নয়ন কোর্সে অংশগ্রহনের উদ্দেশ্যেই মূলত আমার ইরান যাত্রা। ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাস ও ইরান কালচার সেন্টারের সহযোগিতায় যাওয়া-আসার বিমান টিকেট পাওয়ার পর আমাকে বলা হলো তেহরান বিমানবন্দর থেকেই আমাকে উষ্ণ আতিথেয়তা দেয়া হবে। তথাস্তু বলেই রওয়ানা হলাম আবহমান স্রোতের বিপরীতে স্বকীয় ইসলামী তাহজিব-তমুদ্দুনের ধারক ও বাহক হিসাবে প্রতিনিয়ত বহির্বিশ্বের সাথে সংগ্রাম করে চলা ফেরদৌসী, সাদী, জামী, খৈয়াম আর জাবের ইবনে হাইয়ানদের প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর ইরানের পথে।
প্রোগ্রামের কয়েকদিন আগেই ইরানে চলে আসার দরুন আমার জন্য এইদিনগুলো শাপেবর হলো। চমত্কার বেশ কটা দিন কাটালাম 'রেডিও তেহরানে' কর্মরত ভাই তওহিদ এর অসাধারণ বন্ধুত্বসুলভ আন্তরিক সহযোগিতায়। টোও টো করে ওনাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ালাম তেহরান শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। প্রাসাদোপম অট্টালিকা থেকে শুরু করে ঘিঞ্জি গলি-ঘুপচি ঘুরে অবাক না হয়ে পারলাম না। মেট্রো ট্রেনে তাজরিশ থেকে রওয়াহান পর্যন্ত ঘুরে কোথাও কোনধরনের বিশৃঙ্খলা, কোনধরনের মারা-মারি, ঝগড়া-ঝাটি, কিংবা বাসে-ট্রেনে সিট নিয়ে বাদানুবাদ কোনো কিছুই চোখে পড়েনি। 'হিউম্যান বিং' বলে যে একটা শব্দ ডিকশনারিতে মরি মরি করে বেঁচে আছে, তার আক্ষরিক প্রয়োগ পেলাম ইরানে এসে, বিশেষ করে ইরানের আরেকটি প্রাচীন রাজধানী কাজভিনে আসার পরে।
টাকায় জলছাপের ছবির ন্যায় সুন্দর কাজভিনের ইমাম খোমিনি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস কিংবা পটে আঁকা শিল্পীর তুলিতে ফুটে ওঠা এর 'খাবগা' বা আবাসিক হলগুলোতে যে জীবনের জয়গান অনুরনিত হয় তা সত্যি অতুলনীয়। সকালের প্রাতরাশ কিংবা রাতের শাম বা ডিনারের জন্য আবাসিক ডারমেটোরি থেকে কেন্টিনের দু'কিলোমিটার পথ যেতে হয় বাসে। ক্ষুধা পেটে বাসে যেতে যেতে পেটের ক্ষুধা শুকিয়ে আমসত্ব হয়, আবার খেয়ে-দেয়ে বাসে আসতে আসতে সেই ক্ষুধা আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আতিথেয়তার যদিও কোনো কমতি নাই, তাই ফিরতি পথের কথা চিন্তা করে কেন্টিনে বসে পেট পূজার পাশাপাশি ব্যাগ পূজা করতেও কারো কোনো মানা নেই। দায়িত্বশীলগণ বরং মজা করে বলেন -'(অগায়ুন বেখোরিদ অ জিয়াদ বেগিরিদ, কাবেলি না দারেহ)! মানে- যা খাবার খাও এবং তার থেকে বেশি নিয়ে যাও, কোনো পয়সা দিতে হবে না।'
কোর্সের শিডিউলের ফাঁকে ফাঁকে অফিসিয়ালি ঘুরতে যাওয়ার সময় নানান দেশ হতে উড়ে আসা ভাইদের সাথে বিভিন্ন ধরনের আলোচনায় উঠে আসে এত বাধা-বিপত্তি, অর্থনৈতিক বিধি-নিষেধ আরোপ সত্তেও কিভাবে এতো দ্রুত উন্নয়ন করছে আর কিভাবেইবা পচনশীল পশ্চিমা রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দীন-ধর্ম- ইসলামকে আঁকড়ে ধরে শনৈ শনৈ সমৃদ্ধ হচ্ছে। একরের পর একর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সবুজের বুক চিড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে বিশাল বিশাল কল-কারখানা ও শিল্প প্রোডাকশন হাউসগুলো দেখে আমাদের দেশের ইপিজেডগুলোর হতাশাব্যঞ্জক দৈন্যতা বড্ড চোখে লাগে। আমরা এক-একদিন এক একটা শিল্প-কারখানায় দল বেঁধে ঘুরতে যেতাম আর আসার সময় সেই কারখানা থেকে উত্পাদিত পণ্য-সামগ্রী উপহার স্বরূপ নিয়ে আসতাম। বিভিন্ন কারখানায় ওনাদের মেহমানদারী ছিল বলার মতো। ওনাদের চোখে আমরা যেন এক-একজন ভি আই পি বিজনেস ম্যাগনেট।
প্রকৃতি যেন উদার হস্তে ইরানকে ঢেলে দিয়েছে। খনিজ সম্পদের উপর ভাসছে পুরো দেশ। কলেবরের সীমাবদ্ধতার দরুন নিজেকে খুবই অসহায় মনে হচ্ছে। খুব সাদামাটাভাবে বললে, আমরা গিয়েছিলাম আলামুত পর্বত মালার সর্বচ্চো চূড়ায়, সাঁতার কেটেছিলাম প্রকৃতির অনিন্দ জলজ-কন্যা 'দরিয়াচেহ ইভানে।' 'গারে আলী সদের' এর হিম শীতল পানিতে প্যাডেল বোট চালিয়ে ঘুরে বেরিয়েছি আর বালখিল্য আনন্দ চিত্কারে নিজের প্রতিধ্বনি শুনে আমরা নিজেরাই শিহরিত। সহস্র বছরের পুরানো 'গারে আলী সদের' এর 'অবে চাশ্ম' পানির নিচে রেড কোরাল বা রক্ত প্রবল আর মুক্তো খোঁজার অদম্য ইচ্ছা থেকে অনেককেই দেখলাম চুপিসারে গা ছমছম করা অন্ধকার সেই গুহার মাইনাস তাপমাত্রার পানিতে ঝাপ দিতে।
বোরকা বা হিজাব শুধু পর্দা বা ফরজ অনুশীলন ছাড়াও যে আলাদা একটা শিল্পে রূপ পেতে পারে তা ইরানের আল্ট্রা -মডার্ন তরুনীদের না দেখলে আমার অজানাই থেকে যেত। হতে পারে তারা ইহুদি, খ্রিস্টান কিংবা যরথুস্ত্রিও অথবা মুসলিম, কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন কিংবা শরিয়া অনুশাসন পালনের নামে অনেককেই দেখলাম স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটার কি নির্মোহ চেষ্টা। তারপরও সেখানে নারীদের কর্ম পরিবেশ সত্যি অসাধারণ। আমাদের লোকাল বাসের মত সেখানে লোকাল ট্যাক্সি আছে যেখানে রাতের দশটা বাজেও নারীরা সেই লোকাল ট্যাক্সিতে ড্রাইভারের পাশে কিংবা পিছনে দুই অপরিচিত যাত্রীর মাঝখানে বসে গন্তব্যে চলেন খুবই স্মার্টলি। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা সেখানে এতটা বিদ্যমান যে নারী নির্যাতন -ধর্ষণ শব্দগুলো সেখানে খুবই বেমানান।
আবার ফিরে যাই ইস্ফাহানের অলিতে-গলিতে। চোখের সামনে ভেসে উঠে শহরের এই মাথা থেকে ও-মাথায় অসংখ ব্রিজ। নির্মান- শৈলীর দিক থেকে খুবই কারুকার্যময় ও সুসংহত। ইস্ফাহান শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে যা'য়াইন্দে রুদ নদী। নদীটি শহরটিকে দুইভাগে ভাগ করে দিয়েছে। নদীটি পূর্ব-পশ্চিমে হওয়ায় শহরটি উত্তর-দক্ষিণে বিভক্ত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ইরানের মধ্যে সবচে জলটৈটুম্বুর নদী হলো এই যা'য়াইন্দে রুদ । খা'জু ব্রিজ বা সেতু, আল্লাভারদিখান সেতু বা সি ও সেহ সেতু, শাহরেস্তান সেতু, এবং এই সেতুগুলো সত্যি দেখার মতো। সি ও সেহ সেতুটি দৈর্ঘ্যে তিন শ' মিটার আর প্রস্থে চৌদ্দ মিটার। যাইয়ান্দে রুদের উপরে যতোগুলো সেতু আছে তাদের মধ্যে সবচে লম্বা সেতু এটা।
যাযাবর জীবনের কিছু খন্ড চিত্র আমরা দেখলাম মাজেন্দারান যাবার পথে ইমাম রেজা বাজারে ঢোকার মুখে। কি বিচিত্র মানুষের জীবন। বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত মানুষগুলোর মেহমানদারী এবং অমায়িক হাসির আড়ালে অভাবের দৈন্যতা চাইলে কি ঢেকে রাখা যায়, কোনো ফাঁক-ফোকর দিয়ে তা ঠিকই উঁকি দিয়ে থাকে। অথচ এই মানুষগুলোর কেউ সরকার বা ইসলামী অনুশাসনের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ নয়। দেশপ্রেমের প্রতি তাদের স্পৃহা খুবই ঈর্ষণীয়।
ইরানে যে ক'দিন ছিলাম প্রতিদিনই খাওয়ার সময় স্বদেশের মায়া অনুভব করেছি, বিশেষ করে দেশীয় খাবার আর ঝাল-যুক্ত খাবার এতো বেশি মিস করেছি যে বাধ্য হয়ে কিছু ইন্ডিয়ান কাঁচা মরিচ কিনে ফ্রিজে রেখেছিলাম এবং খাবার সময় পকেটে নিয়ে ঘুরতাম। ইরানিরা তাদের প্রত্যেকটা খাবার মনে হয় চিনি দিয়ে রাঁধে। যেকোনো পার্টিতেই খাবারে তাদের রুটি, মাখন ও পনির থাকা চাই'ই চাই।
কাজভিনের দিনগুলো ছিল খুবই ব্যস্তময়। কোর্স, ক্লাস, প্রোগ্রাম, আর রাতে ফ্লাডলাইটের আলোয় ফুটবল খেলা কিংবা ইনডোর মাঠে বাস্কেটবল খেলা ও ক্যাম্পাসের বাইরে সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে যাওয়া ছিল রোজকার রুটিন। স্বদেশী দু'তিনজন ছাত্র যারা আগে থেকেই কাজভিন ক্যাম্পাসে থেকে বিভিন্ন সাবজেক্ট নিয়ে পড়া-শুনা করছেন, একজন দেশী ভাই পেয়ে ওনাদের আন্তরিকতা ও অনভ্যস্ত হাতে দেশী খাবার তৈরী করে মেহমানদারী করা, সত্যি আমার পক্ষে ভুলে যাওয়া অসম্ভব।
ইরানের সর্বোচ্চ পাহাড় হচ্ছে দামাভান্দ পাহাড়। ঢাকা শহরের ইট-কংক্রিটের হাইরাইজ বস্তিতে সিঁড়ি ভাঙ্গতে অভ্যস্ত হলেও ইরানে গিয়ে আমার ‘আলবুর্জ’ কিংবা ‘দামাভান্দ’ পাহাড় বেয়ে চূড়া উঠা কষ্ট-সাধ্য ও ক্লান্তিকর একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা চেষ্টা ছিল। সবার আগে পায়ে হেঁটে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে পুরস্কার পাওয়ার লোভ থেকে দু'চারজন অতি চালাকের দেখাদেখি আমিও গাধার পিঠে চড়ে ভিন্ন ট্রেইল অনুসরণ করে পাহাড়ে উঠার চেষ্টা করেছিলাম, তবে মাঝপথেই আমাদের ছলা-কলা ধরা পরে যাওয়ায় সেখানেই যাত্রার বিরতি টানতে হলো। তবে ভ্রমনের সেইদিনগুলো অনেক আনন্দের ছিল।
একটা সুসংহত সমাজ, একটা কার্যকর রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে একটি অনুকরণীয়, অনুসরণীয় চরিত্র ও তার আদর্শ একান্ত প্রয়োজন; তা ইরানের খেঁটে খাওয়া মানুষ ও তাদের সর্ব-শ্রদ্ধেয় নেতা ইমাম খোমেয়েনি (র.) এর প্রতি নিষ্শর্ত আনুগত্য দেখে উপলব্ধি হলো। বিভিন্ন জাতির বসবাস ইরানে, বিশেষ করে জরথুস্ত্রিও ও ইহুদিদের সাথে অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠির যে বিশ্বাস ও আকীদাগত মতপার্থক্য তা একসূত্রে বেঁধে সবাইকে দেশপ্রেমের আদর্শে অনুপ্রানিত করার জন্য একজন ইমাম খোমেয়েনি (র.) যে খুবই প্রয়োজন তা বাংলাদেশের বর্তমান অসামঞ্জস্য পরিস্থিতিতে সহজেই অনুধাবনযোগ্য।
বিভাগ:

Author Name

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.