আখতারুজ্জামান আজাদ
ফেসবুকে আছি সাড়ে চার বছর ধরে। এই সাড়ে চার বছরে ফেসবুকে অজস্র প্রেম হতে দেখেছি, অজস্র প্রেম ভাঙতে দেখেছি, ভাঙাভাঙির পর প্রাক্তন প্রেমিক-প্রেমিকাদের পারস্পরিক কাদা-ছোড়াছুড়িও দেখেছি। অফলাইনে নরনারীদের মেশার সুযোগ কমে যাওয়ায় এবং অনলাইনে প্রেম হওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ বিধায় এখনকার অধিকাংশ প্রেমই হয়ে থাকে অনলাইনে পরিচয়ের মাধ্যমে। আর অনলাইনে প্রেম হয়ে যাবার পর সেই যুগলেরা প্রেমের প্রচার-প্রচারণাও করে থাকেন সাড়ম্বরে।
সামনাসামনি পরস্পরের দেখা পর্যন্ত হয়নি, এমন অনেকের প্রেম হতে দেখেছি ফেসবুকে। দেখেছি তাদের পরস্পরের ওয়ালে অতি-প্রেমের উদ্বাহু-উন্মাতাল প্রকাশ, বিরক্তিকর-বিব্রতকর প্রেমতাণ্ডব! সামনাসামনি দেখা হবার আগেই প্রকাশ্য ফেসবুকে পরস্পরকে 'বউ' বা 'স্বামী' বলে সম্বোধন, বিপরীত-জনের বাবা-মাকে শ্বশুর-শাশুড়ি বলে আখ্যায়িত করে সেই কথিত শ্বশুর-শাশুড়িদেরকে নিয়ে ফেসবুকে লেখালেখি, ফেসবুক আইডির নাম এডিট করে প্রেমিকের পারিবারিক পদবি নিজের নামের সাথে যুক্ত করা ইত্যাকার বর্ণাঢ্য-বিচিত্র নখরামো-ন্যাকামোর পসরা বহু দেখেছি মার্ক জুকারবার্গের এই নীল-শাদা নাট্যমঞ্চে! বিয়ের পরে কয়টা বাচ্চা হবে, বাচ্চাদের নাম কী হবে তা নিয়েও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ঝগড়া-ফ্যাশাদ হতে দেখেছি! আবার দেখেছি ঐ জুটিদের পরস্পরের দেখা হবার আগেই এহেন জাঁদরেল-জমকালো প্রেম ভেঙে যেতে! ভাঙাভাঙির পর দেখেছি ফেসবুকেই আবার নতুন প্রেমের গড়াগড়ি, নতুন কাউকে 'বউ' বা 'স্বামী' বানাবানি, নতুন কারো বাবা-মাকে শ্বশুর-শাশুড়ি আর ভাই-বোনকে শালা-শালি-দেবর-ভাসুর বানানো কিংবা নতুন এক সেট বাচ্চার নাম-নির্ধারণ নিয়ে নতুন কেস-মামলার আমদানি!
প্রাইভেট আলাপের জন্য জনাব জুকারবার্গ ফেসবুকে 'ইনবক্স' নামক একটি প্রাইভেট জায়গা রেখেছেন। কিন্তু অনেক ভার্চুয়াল জুটির ঐ ইনবক্সে পোষায় না। তাদের জগৎজোড়া ভালোবাসা ইনবক্স থেকে ফুলে-ফেঁপে চুইয়ে-চুইয়ে ঠিকরে-ঠিকরে বাইরে এসে ওয়ালে-স্ট্যাটাসে দৌড়োদৌড়ি করে। তাদের যে ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডগুলো ইনবক্সেই সুচারুরূপে সম্পাদিত হতে পারত,তা কেঁচোর মতো মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের হোমপেজে;দেখা যায় হোমপেজে-হোমপেজে ময়নাটা-সোনাটা-বাবুটা-পাগলটা-জানপাখিটা-কুট্টুশটা-প্রিয়মানুষটা নামক কিম্ভূত প্রাণিকুলের অদ্ভুত আনাগোনা!
এই নাগরিক কোষ্ঠকাঠিন্যের যুগে ফেসবুকে প্রেম হওয়া, কিছু দিন বাদে প্রেম ভেঙে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়; কিন্তু অস্বাভাবিক হচ্ছে এসব প্রেমের অসুস্থ প্রদর্শনী বা শো-অফ। বাস্তব জীবনে নিগৃহীত-লাঞ্ছিত-বঞ্চিত অনেকেরই প্রেম হয় ফেসবুকে। তাই প্রেমটা হয়ে যাবার পর এটিকে তারা বিবেচনা করেন 'বিশ্বজয়' হিশেবে এবং এই বিশ্বজয়ের ঘটনাটিকে তারা ফেসবুকে প্রচার করেন বিশেষ বীরত্ব হিশেবে! এ সব প্রেমে আন্তরিকতার চেয়ে শো-অফ বেশি, পরস্পরের সাথে একান্তে সময় কাটাবার চেয়ে ছবি তুলে যথাদ্রুত ফেসবুকে আপলোড করে অন্যদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার তাড়না বেশি, যথাসম্ভব রগরগে ছবি আপলোড করে নিজেদেরকে 'সাহসী' ও 'প্রগতিশীল' প্রমাণ করার প্রবণতা বেশি! যে দালানের ভিত্তি দুর্বল, সে দালান যেমন ভেঙে পড়ে সামান্য দমকা বাতাসেই; তেমনি এসব শো-অফসর্বস্ব ভার্চুয়াল প্রেমের পরিণতিও হয় অত্যন্ত করুণ। এক সময়ে যে ছিল সোনাটা-ময়নাটা, প্রেমটা ভেঙে যাবার পর সে-ই হয়ে যায় খানকিটা-বেশ্যাটা!
বাস্তব জীবনে নিগৃহীতরাই ফেসবুকে প্রেমের শো-অফ বেশি করে থাকে। এই শো-অফ এক দিকে যেমন মানসিক অসুস্থতার বহিঃপ্রকাশ, অন্য দিকে তেমনি এই শো-অফ প্রেমবঞ্চিতদেরকেও মানসিকভাবে অসুস্থ করে তোলে। ফেসবুকে উপর্যুপরি অন্যদের প্রেমতাণ্ডব দেখে প্রেমবঞ্চিতরাও যেনতেন প্রকারে প্রেম পাবার জন্য ফেসবুকে নানাবিধ অসুস্থ-অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দেয়। অর্থাত্‍ ফেসবুকে প্রেমের শো-অফের কুফল বহুমুখী।
প্রেম উতলে উঠলে অনেকে পরস্পরকে নিজের আইডির পাসওয়ার্ডও দিয়ে দেয়, যার ফল হয় অত্যন্ত ভয়াবহ। অতি সম্প্রতি ফেসবুকের এক বাটপার ধরা পড়েছে, যে প্রেমিকার আইডির পাসওয়ার্ড নিয়ে সেই আইডি থেকে মানুষের সাথে চ্যাট করত এবং প্রেমিকার আইডি থেকে মানুষের কাছ থেকে টাকা চাইত। চ্যাট-শেষে সে সমস্ত চ্যাট হিস্ট্রি ডিলিট করে ফেলত, প্রেমিকাটি জানতেও পারত না তার আইডি ব্যবহার করে প্রেমিকপ্রবরটি কত মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে! শেষতক মানুষের হাতে ধরা পড়ে ঐ বাটপার প্রেমিকটি গণধোলাই খেয়ে ক্ষতবিক্ষত-বিধ্বস্ত হয়ে শাহবাগ থানায় ঠাঁই নিয়েছিল। অমন হাজারও বাটপার ঘাপটি মেরে আছে এই ফেসবুকে, অতএব কারো কাছেই পাসওয়ার্ড হস্তান্তর উচিত নয়।
ফেসবুকে আরেক কিসিমের আদিখ্যেতা দেখা যায়, সেটি 'ফেসতুতো ভাই-বোন' পাতানো। রক্তের ভাই-বোনদের খবর না রেখে এই ভাই-বোনেরা ফেসতুতো ভাই-বোনদের জন্য ভার্চুয়াল জান কোরবান করে দেয়, পরস্পরকে পাসওয়ার্ড দিয়ে দেয় এবং পাসওয়ার্ড দেয়ার পর অনিবার্য পরিণতি ফেসতুতো বোনটিকে ফেসতুতো ভাইটির ব্ল্যাকমেইলিং!
প্রেম ব্যাপারটি ব্যক্তিগত। এর অতি-প্রকাশ প্রেমকে খেলো করে দেয়। জুটিদের মাত্রাতিরিক্ত ছবি আপলোড প্রেম ভেঙে যাবার পর তাদেরকে বেকায়দায় ফেলে। ফেসবুকে ছবি প্রচার করলে তা জনে-জনে ছড়িয়ে পড়ে এবং এসব ছবি পরবর্তী জীবনে আপদ হয়ে দাঁড়ায়। ভার্চুয়াল প্রেমিককে অতি বিশ্বাস করে পাসওয়ার্ড দেয়াকে কেন্দ্র করে প্রেমিকার আত্মহত্যার নজিরও এ বিশ্বে আছে। প্রেমে-ভালোবাসায় প্রকাশ-প্রচারণা জরুরি নয়, জরুরি পরস্পরকে অনুভব। হাজারটা চুমুর ইমোর চেয়ে বাস্তবে একটি চুমু, হাজার ঘণ্টা চ্যাট করার চেয়ে মুখোমুখি কয়েকটি মিনিট চোখাচোখি অধিক জরুরি। পরস্পরকে দেখার আগেই যে প্রেম, সে প্রেম প্রেম নয়। প্রেম আলিঙ্গন চায়,চুম্বন চায়;চুম্বনের ইমোয় পরস্পরের ওয়ালকে গোয়াল বানিয়ে রাখা কিংবা আলিঙ্গনের ভূরি-ভূরি ছবি প্রকাশ নিষ্প্রয়োজন। কবে কীভাবে পরিচয় ঘটেছিল, কে কই কী খেতে গিয়েছিল, কে কাকে কই জড়িয়ে ধরেছিল;এর নৈমিত্তিক ধারাভাষ্য ফেসবুকে প্রচার অবান্তর। প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রেমিক-প্রেমিকা, ভাষ্যকার না।
অসুস্থ প্রেমের অসুস্থ প্রকাশ সুস্থদেরকেও অসুস্থ করে তোলে, প্রেমহীনদেরকে করে তোলে আগ্রাসী। প্রেমে সুস্থতা আসুক, সবাই উপলব্ধি করুক -- অতি-প্রকাশিত প্রেম প্রেম নয়, অপ্রকাশিত প্রেমই প্রেম।

Author Name

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.