পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
সাময়িকী.কমফিরে পাওয়া সন্তানকে আদর। মঙ্গলবার বিমানবন্দরে। ছবি: দেবাশিস রায়
গিয়েছিলেন রুটিরুজির খোঁজে। জুটেও গিয়েছিল কাজ। কিন্তু সইল না। অবিরাম গুলিগোলায় অশান্ত ইরাক থেকে কোনও মতে নিজভূমিতে ফিরে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন বাংলার বিভিন্ন জেলার ২৫ জন। মঙ্গলবার মাঝরাতে।
কারও বাড়ি নদিয়ায়। কারও বর্ধমানে। কেউ আদতে উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা। ওঁদের কেউ রাজমিস্ত্রি। কেউ কেউ ছুতোর। সম্বল বলতে হাতের কারুদক্ষতা আর পরিশ্রম করার শারীরিক সামর্থ্য। তার জোরেই বরাত ফেরানোর আশায় পাড়ি দিয়েছিলেন বিদেশ-বিভুঁইয়ে। ফিরলেন চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে। দুঃস্বপ্নতাড়িতের মতো।
কীসের ভয়? কাজ ফেলে কেনই বা অসময়ে ঘরে ফেরা?
“প্রাণের ভয়ে। আল্লা মেহেরবান। বাঁচিয়ে ফিরিয়ে এনেছেন নিজের দেশে। প্রিয়জনদের কাছে। আর ফিরে যাব না ওই সর্বনেশে জায়গায়,” ছেলেকে কোলে নিয়ে কেঁদে ফেললেন জামাত মণ্ডল। হাঁসখালির কাঠমিস্ত্রি।
এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান কলকাতায় নেমেছে রাত ১০টা ৫০ মিনিট নাগাদ। ইরাকের বসরা থেকে তাতেই ফিরেছেন জামাত-সহ ২৫ জন শ্রমিক। আট মাস আগে বসরা গিয়েছিলেন জামাত। কাজ পাওয়ার জন্য ওঁঁদের প্রত্যেকেই এক-দেড় লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন এজেন্টদের। অভিযোগ, কাজ মিললেও মাসমাইনে জুটছিল না। সংস্থাগুলি তাঁদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে রেখেছিল। তার উপরে শুরু হল সংঘর্ষ। প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবেন ভাবেননি। ভারত সরকারের কূটনৈতিক দৌত্যে অবশেষে ঘরে ফেরা। প্রায় প্রত্যেকেই জানালেন, যে-শোচনীয় অবস্থা দেখে এসেছেন, খেতে না-পেলেও আর কোনও দিন ইরাকমুখী হবেন না।
ইরাকে জঙ্গিদের হাতে আটক ৪৬ জন নার্স রবিবার দেশে ফিরেছেন। তাঁরা কেরলের বাসিন্দা। তার পরে এ দিন ফিরলেন বাংলার ২৫ জন শ্রমিক। জঙ্গিরা ওঁদের আটক করেনি। কিন্তু সংঘর্ষের জেরে নিজেদের অফিস ভবনে বা শিবিরে প্রায় বন্দিজীবন কাটিয়েছেন কেউ এক মাস, কেউ বা দেড় মাস। তাঁরা জানান, যে-সংস্থার হয়ে কাজ করছিলেন, তারা পাসপোর্ট আটকে রাখায় দেশে ফেরা যাচ্ছিল না। দিনের পর দিন জল নেই। খাবার নেই। বিদ্যুৎ নেই। সহকর্মীদের অনেকে গুলি বা বোমায় প্রাণ হারিয়েছেন। মরতে হবে, ভেবে নিয়েছিলেন ওঁরাও। আশার আলো দেখা যায় দিন পাঁচেক আগে। ইরাকের ভারতীয় দূতাবাসের কর্মী ও পুলিশ তাঁদের কাছে আসেন, কথাবার্তা বলেন। তাঁরাই চাপ দিয়ে সংস্থাগুলির কাছ থেকে পাসপোর্ট আদায় করেন। সোমবার দুপুরে একটি বাসে তাঁদের বসরা বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়া হয়। সেখান থেকে দিল্লি হয়ে কলকাতা।
বিমানবন্দরে তাঁদের স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। যাঁরা ফিরেছেন, তাঁদের মধ্যে ১৬ জনই নদিয়ার, এক জনের বাড়ি বর্ধমানে, আট জন উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা। অনেকেরই স্ত্রী-পুত্র-কন্যা বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। আতঙ্ক, উদ্বেগ পেরিয়ে প্রিয়জনকে কাছে পেয়ে কেউ জড়িয়ে ধরেছেন, চুমু খেয়েছেন, কেউ শুধু কেঁদেছেন। নদিয়ার বগুলার মহম্মদ জমির মণ্ডল বসরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণকাজে যুক্ত ছিলেন। বিমানবন্দর থেকে বেরোনোর পরেও তাঁর চোখেমুখে আতঙ্ক। খোঁজাখুঁজির পরে দেখতে পেলেন ছেলে, দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র নাহারুনকে। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। হাউ হাউ করে কেঁদে জমির বলেন, “জল নেই। খাবার নেই। এক বেলা এরচা রুটি আর কিছু ডাল ফেলে দিয়ে যেত সংস্থার লোক। গত ১৫ দিন রুটিও দেয়নি। বাইরে শুধু গুলি-বোমার শব্দ। ভাবিনি, বাড়ির লোকজনকে আবার দেখতে পাব।”
একই কথা বনগাঁর লিটন হালদার, হাসখালির রমেন বিশ্বাস, প্রশান্ত মণ্ডলদের। “মাইনে পাচ্ছিলাম না মাসের পর মাস। এক মাস বসরার আসার মার্কেটের শিবির থেকে বেরোতে পারিনি। সাত দিন অন্তর নুনগোলা জল আর এক বেলা দু’টো রুটি। চোখের সামনে সহকর্মীরা মারা গিয়েছে। মাথার উপর দিয়ে গুলি চলত। কী ভাবে ছিলাম, আমরাই জানি” সমস্বরে বললেন তাঁরা।
ভিড় আর ধাক্কাধাক্কির মধ্যে চকচক করছিল উল্লাসি হাই-মাদ্রাসার নবম শ্রেণির টফি মণ্ডলের মুখ। সকলেই আশঙ্কা করছিল, জঙ্গিরা তার বাবাকে মেরে দেবে। কিন্তু তার বাবা জামাত ফিরে এসেছেন। “এ বারের ঈদের মতো আনন্দ আর কখনও হবে না,” বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল টফি।