অ
সাত সকালেই দরজায় কড়া নাড়ার
শব্দ। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি চোখ কচলাতে থাকলাম, কিন্তু উঠলাম না। শীতের দিন
হওয়ায় বিছানা থেকে যেন উঠতেই মন সায় দেয় না। মাঝে মাঝে অলসতার কারণে মনে হয় এভাবে
যদি শতাব্দীর পর শতাব্দী ঘুমিয়ে কাটাতে পারতাম! প্রতিটি দিনই যদি শীতের মত এমন
আলসে কুড়ে হত কী মজাই না হত! দরজায় আবারও টোকা পড়ল- চয়ন ভাইয়া... । কণ্ঠটি বেশ
পরিচিত। তাহেরা তাবাস্সুম সুইটি ডাকছে। ও আমাদের বাসার গৃহকর্মী। ওর নাম নিয়েও
প্রায়শই ওকে টিজের শিকার হতে হয়। বিভিন্ন খানে বটেই আমাদের বাসায়ও হয়। কাজ করার
সময় একটু পান থেকে চুন খসলে আমার খালামণি শায়লা তো জিরাফের মত গলা বাড়িয়ে বলেই
চলে- যেনা আমার চেহারা, আবার নাম লাগাইছে
তাহেরা...! দেখে শুনে কাজ করতে পারিস না? বলি এসব জিনিসপত্র কি তোর বাপ কিনে
দিয়েছে? খালামণির কথার সাথে আমার আম্মুও এসে জোট বাঁধে। আমার খালামণি আরও শক্তি ও
সাহস পায়। এ যেন দ্বি দলীয় ঐক্যজোট!
সুইটির বয়স বার ছুইছুই করছে।
ওদের পাঁচ সদস্যের এক বড় পরিবার। বছর চারেক আগে ওর বাবা শ্বাসকষ্টে ভোগে বিনা
চিকিৎসায় ইহলোক ত্যাগ করেছে। তার দুই বোনের বিয়ে হয়েছে বটে কিন্তু তারাও খুব
একটা সুখে নেই। বিভিন্ন জনের বাসায় তাদেরও কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। তার মা
জোহরা বেগমও অন্যের বাসায় কাজ করে। ছোটবেলাতে অর্থনৈতিক টানাপোড়নের কারণে স্কুলে
যাওয়ার সুযোগ পায় নি। বছর চারেক আগে সুইটি যখন আমাদের বাসায় কাজ করতে আসে তখন তার
বয়স ছিল আট। চেহারাও ছিল বেশ সুইট। কথাবার্তায় ছিল শিশুসুলভ প্রগলভতা।
ওর এই প্রগলভতা আমার ভাল লাগতো। এই কারণে আমি
তার পরিবর্তন কর রাখি তাহেরা তাবাস্সুম সুইটি।
আমি সেদিন খেয়াল করলাম, নতুন নামকরণের পর তার
চোখে মুখে সেকি আনন্দের ঝিলিক! ড. ইউনুস নোবেল পাওয়ার পরে যেমনটি হয়েছিল তেমনি
আর কি! অবশ্য এটা আমার পরিবারের কেউ জানে
না, কিংবা নতুন নামকরণের আকিকাও করানো হয়ে ওঠে নি।
ওর আচার আচরণে আমি মুগ্ধ হয়ে
একসময় তাকে স্কুলে ভর্তি করার প্রস্তাব দেই। সে অবাক হয়ে বলে- ভাইয়া, আমরা গরিব
মানুষ, পড়ালেখা ক্যামনে করমু? টেকা পামু কই? সারাদিনই তো কম বেশি কাম থাকে,
স্কুলে যাইমু কোন সময়? একসাথে সে অনেকগুলো প্রশ্ন করে । প্রশ্ন করারই কথা তার ছোট মাথাতে সে সময়ের হিসাব মিলাতে পারছে না। আমি অভয়
দেওয়ার স্বরে বললাম- তুমি বিকেলের দিকে স্কুলে যাবে। সুইটি বলে- বিকালে আবার কেউ
স্কুলে যায় নি? – হ্যাঁ, যায়। যারা বিকালে যায় তারা বেশির ভাগই তোমার মত কর্মী। আর ঐ স্কুলটার নাম ...কর্মমুখী শিক্ষা স্কুল। এখানে কোন টাকা পয়সা দেওয়া
লাগে না। উপরন্তু তারাই তোমাকে পড়ার পাশাপাশি কাজ শিখাবে, মাস শেষে কিছু টাকাও
দিবে।
টাকা দেওয়ার কথা শুনে সে একটু
বেশি খুশি হল। সে বলল – খালাম্মা রাজি অইবো তো?
- সে ব্যাপারটা আমি দেখব।
আমি দেখেছিলামও বটে, কিন্তু
এর জন্য যে আমাকে কী পরিমান যে বেগ পেতে হয়েছিল, কী পরিমান যে মায়ের চক্ষুশূল
হয়েছিলাম তা কেবল মাত্র শুধু আমিই জানি। এরপর সে স্কুলে ভর্তিও হয়েছিল এবং এখন
পর্যন্তও সে পড়ছে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সে আমার প্রতি একটু বেশি দেখভাল
করার চেষ্টা করে। আজ হয়ত সে আমাকে সকাল সকাল জাগিয়ে দেওয়ার জন্যই দরজায় এসে কড়া
নাড়ছে। আমি দরজা খুলতেই দেখি সুইটির বড় বোন সাহারা। আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। ওদের দুজনের কণ্ঠেই বেশ মিল। আমি কিছু বলার
আগেই সে ঈষৎ নত হয়ে অপরাধী স্বরে বলল- ভাইয়া
- বলেন
-সুইটি গতরাতে এক বখাটে
পোলার লগে পলাইয়া গেছে।
আমার চোখ যেন তখন কপালে উঠার
মত অবস্থা। আমি তখন রুম থেকে একটু বাহিরে আসি। বাহিরে তখন বেশ ঘন কুয়াসা। আমি দূর
আকাশের পানে তাকাই। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু দেখি ঘন কুয়াসা আর কুয়াসা। ঘন কুয়াসার
দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলি- যেখানেই থাকিস, ভাল থাকিস রে সুইটি!
মুনশি আলিম
টিলাগড়, সিলেট