এক
সৈকত বাসে উঠে সিটের বসতে বসতে কন্ট্রাকটারকে বলল- আমাকে একটু শান্তিপুরে
নামিয়ে দিবেন। কন্ট্রাকটার মাথা নেড়ে সায়। সিটে বসে জানালা খুলে দিতেই ফুরফুরে
হাওয়া ঢুকতে লাগলো। মন মাতানো হাওয়ায় তার শরীর মন কাব্যিক হয়ে ওঠে। জানালা দিয়ে
বাইরের প্রকৃতির পানে তাকায়। তার ভাবনা জুড়ে অবলীলায় খেলা করতে থাকে অনামিকার সাথে
কাটানো শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলো। মনের ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে আল্পনা আঁকতে থাকে। ভাবনার
গভীরে সে ডুবে যায়। তার তার পাশের সিট খালি। এক ভদ্রলোক তাকে ক্ষীণস্বরে বলছে- ভাইজান
এইহানে বওন যাইবো নি?
কোন উত্তর নেই। ভদ্রলোক আবার একইভাবে পুনরোক্তি করল- ভাইজান কিছু কইবার
লাগচেন না কেলা?
এরপরও কোন উত্তর না পাওয়ায় তার চোখমুখে বিরক্তিভাব ফুটে ওঠে। শেষে অনুমতির তোয়াক্কা না করেই তিনি বসে পড়লেন। সৈকতের
কানে ভদ্রলোকের কথাগুলো পৌঁছেছে বলে মনে হল না। তার অন্যমনস্ক ভাব দেখে মনে হল ভদ্রলোক
যে তার আসনে বসেছে তাও সে জানে না! প্রকৃতির পানে তাকিয়ে কেবলি সে যেন কী বিড়বিড়
করে বলছে। ঐ ভাষা যে সান্ধ্যভাষা! ও ভাষা কি আর বুঝার উপায় আছে? তবে ভদ্রলোক
বোধকরি সৈকতকে শ্রবণপ্রতিবন্দী-ই মনে করল।
সে বাসের ডানদিকের ২য় সিটে। পাশের মহিলা সিটে তিনজন কলেজ ছাত্রী সৈকতের দিকে
তাকিয়ে কী যেন কানাকানি করছে আর মৃদু মৃদু হাসছে। ভদ্রলোকও যেন তাদের সাথে ঐক্য
ঘোষণা করে মৃদু হাসছে।
দুই
বাস বিরতিহীন গতিতে চলছে। বিল্ডিংয়ের পর বিল্ডিং, বৃক্ষের পর বৃক্ষ,
গ্রামের পর গ্রাম এক এক করে সবকিছুই পিছনে পড়ে যাচ্ছে। হঠাৎই যেন তার ভাবনায় ভাটা
পড়ল। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই
সে হচকিত হয় ওঠে। পাশে ফিরে তাকাতেই ভদ্রলোককে চোখে পড়ল। সম্মুখে বসা মেয়েদের
কানাকানি তখন আরও বেড়ে গেল। ভদ্রলোকও মৃদু মৃদু হাসছে। এমন সময় কনট্রাকটর এসে
বলছে-ভাইজান ভাড়াটা লন
-এই যে –
বলে সে ১০ টাকার একটি নোট বের করে দেয়।
কোন জায়গায় নামবেন?
-শান্তিপুর
কন্ট্রাকটার ব্যাঙ্গ করে বলে- ভাইজান ছান্তিপুর কোন ছময় ফালাইয়া আইছি এহন
আমরা অছান্তিপুরে আছি। আরও পাঁচ টাকা দেওন লাগবো।
- কী বলেন? আমি তো আপনাকে বলেই ওঠলাম।
-আরে বাইজান, নিজের খেয়াল নিজের রাহন লাগে; আমরা কী আর একজন নিয়া বইয়া
থাকি? মাগার কতজন আছে না! আর তাছাড়া আমি তো কয়বার ছান্তিপুর ছান্তিপুর কইয়্যা
চিল্লাইলাম, আপনি কই আছিলেন?
সৈকত তখন খুব বিব্রতবোধ করতে থাকে। নিজের উপর তার নিজেরই রাগ হতে লাগলো। তবু
কৌশলে নিজেক একটু সামলে নিয়ে বলল- ভাই আমাকে নামিয়ে দেন ।
বাস থামলে সে নেমে যায়। নামার সময় কনট্রাকটার রসিকতা করে বলে- বাইজান,
আবার কোনদিন বাছে উটলে মনখান ছাথে কইরা নিয়া উইঠেইন। কন্ট্রাকটারের কথা শেষ হতেই
তরুণীরা খিলখিল করে হেসে ওঠলো। তাদের সে হাসির ঝর্ণাধারা প্রতিধ্বনিত হতে থাকে
বাসের চারদিকের দেয়ালে। তরুণীদের হাসিতে যোগ দেওয়ার জন্য পাশে বসা ভদ্রলোকও নিঃশব্দে
ঈষৎ হাসার চেষ্টা করে। এ যেন ফিঙ্গে মাছের হাসি দেখে হাসে পাতিহাস!
সৈকত সে হাসির শব্দ শুনলেও আর পিছু ফিরে তাকাল না। নিভৃতে নেমে যায়।
শান্তিপুরের পাশেই চন্দনপুর। আর এই চন্দনপুরেই অনামিকার বাড়ি। বছর চারেক ধরে তাদের
হৃদ্যতা গড়ে ওঠেছে। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষে এসে তাদের সম্পর্কটি সবচেয়ে
বেশি গভীর হয়ে ওঠে। অনামিকা দেখতে বেশ বেশ সুন্দরী। তবে তার একটি বিশেষ গুণ হল সে
খুব মিষ্টি করে হাসতে পারে। তার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে সৈকত প্রায়ই বলত-
এ যে মিলিয়ন ডলারের হাসি! অনামিকাও তখন আনন্দে গদগদ সৈকতের চুল ছুঁয়ে বলত- তুমি
না, তুমি একটা যা ইচ্ছে তাই... খালি বাড়িয়ে বল। তাদের সম্পর্কটি উভয়ের পরিবারের সদস্যরাই জানে।
সৈকতের পরিবার থেকে আপত্তি না থাকলেও ঘোর আপত্তি তুলে অনামিকার বাবা অজিদ চৌধুরী।
গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার
পর তার সাহস ও শক্তি যেন একশ গুণ বেড়ে যায়। এখন আর তাকে ফিরায় কে! কোন ঘটকের
দারস্থ না হয়ে এই শুভ সংবাদসহ আজ নিজেই যাচ্ছে নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।
তিন
অনামিকার পরিবারের শুধু তার বাবা অজিদ চৌধুরী রাজি নয়। বেকারত্বের কারণে সৈকতকে
নানাভাবে কটাক্ষ করা হয়েছে। এসব কথাও তার অজানা নয়। আজ মনে মনে ভাবছে সেসবের
প্রতিশোধও নেওয়া যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরিটাই তার তুরুপের টেক্কা! এমনি নানা
ভাবনা তার মনে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। একটু সামনে যেতই দেখল রাস্তার ডানদিকে বেশ জটলা। একটি
প্রাইভেটকারকে কেন্দ্র করে প্রায় কয়েকশ মানুষ জমায়েত হয়েছে। একটি ভ্রাম্যমান
পুলিশের গাড়িও রয়েছে। কৌতূহলবশত ভীর ঠেলে কাছে যেতেই দেখে একটি একটি মেয়েকে
প্রাইভেটকারে তোলা হচ্ছে। মেয়ের জামাটি বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে। কাছে যেতেই স্পষ্ট
হয়ে ওঠে অনামিকার মুখ!
বাবা অজিদ চৌধুরী সম্ভ্রান্ত তালুকদার বংশের এক অর্ধশিক্ষিত ছেলের সাথে
বিয়ে ঠিক করে। আর তাতেই বেকে বসে অনামিকা। বিয়েতে রাজি হওয়ার জন্য একপর্যায়ে তার
ওপর শারিরীক নির্যাতনও করা হয়। শেষে কোন উপায় অন্তর না দেখে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়
অনামিকা। সৈকতের ডানদিকে দাঁড়িয়ে থাকা এক
মহিলা ক্ষীণস্বরে ফিসফিস করে তার সাথের মহিলাকে বলছে। দৈবাৎ কথাটি শুনে ফেলল সৈকত।
জীবনের সব স্বপের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। তার
শরীর মৃদু কাঁপতে থাকে। কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে। পৃথিবীর সমস্ত ক্লেদ, যন্ত্রনা
তার চোখ বেয়ে শরীরে নেমে আসে। হতাশার ক্ষরণে দগ্ধিভূত হতে থাকে তার আবেষ্টিত
পিঞ্জর। ভরা আলোতেও তার চোখ বেয়ে নামে সীমাহীন অন্ধকার। তার দেহপিঞ্জর যেন
টিবটিব চলছে। অপ্রত্যাশিত শঙ্কায় একেবারেই নিথর নিস্তব্দ হয়ে যায় তার দেহ। অনামিকার
ওড়নার দিকে তাকাতেই তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। চক্ষু দহন করে এই বুঝি বৃষ্টি
নামবে। ডান হাত দিয়ে চোখ মুছতে যাওয়ার সময়ই পুলিশ এসে তার হাতে হাতকড়া পরায়। অজিদ
চৌধুরী বলে – ইন্সপেক্টর সাব, এই ছেলেটিই আমার মেয়ের খুনি! নিয়ে যান ওকে।
নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে কোন প্রকারের আবেদন কিংবা উচ্চবাচ্য তার মুখ থেকে
বের হল না। উপরন্তু সবাইকে রীতিমত অবাক করে দিয়ে পুলিশের সাথে নীরবে গাড়িতে গিয়ে
বসে। গাড়ি স্ট্রাট নেয়। দেখতে দেখতেই সৈকতসহ এক সময় গাড়িটি চোখের আড়াল হয়ে যায়।
মুনশি আলিম
পূর্ব শিবগঞ্জ, সিলেট