সুকুমার রায়
সে সাড়ে তিনশত বৎসর আগেকার কথা। ইটালি দেশে পিসা নগরে সম্ভ্রান্ত বংশে গ্যালিলিও-র জন্ম হয়। গ্যালিলিওর পিতা অঙ্কশাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন, শিল্প সংগীত প্রভৃতি নানা বিদ্যায় তাঁহার দখল ছিল। কিন্তু তবু সংসারে তাঁহার টাকা পয়সার অভাব লাগিয়াই ছিল। সুতরাং তিনি ভাবিলেন, পুত্রকে এমন কোন বিদ্যা শিখাইবেন, যাহাতে ঘরে দুপয়সা আসিতে পারে। স্থির হইল, গ্যালিলিও চিকিৎসা শিখিবেন।কিন্তু বাল্যকাল হইতেই গ্যালিলিওর মনের ঝোঁক অন্যদিকে। ডাক্তারি বই পড়ার চাইতে তিনি কলকব্জা লইয়া নাড়াচাড়া করিতেই বেশি ভালবাসিতেন। সকলে বলিত, "ওসব শিখিয়া লাভ কি? যাহাতে প্যসা হয় তাই শিখিতে চেষ্টা কর।" উনিশ বৎসর বয়সে একদিন ঘটনাক্রমে জ্যামিতি বিষয়ে এক বক্তৃতা শুনিয়া, গ্যালিলিও সেইদিন হইতেই জ্যামিতি শিখিতে লাগিয়া গেলেন। কিন্তু বেশিদিন তাঁহার কলেজে পড়া হইল না। তাঁহার পিতার দুরবস্থা ক্রমে বাড়িয়া শেষটায় এমন হইল যে, তিনি আর পড়ার খরচ দিতে পারেন না। কলেজের কর্তারাও দেখিলেন, এ ছোকরা নিজের পরাশুনার চাইতে জ্যামিতি ও অন্যান্য 'বাজে' বইয়েতেই বেশি সময় নষ্ট করে। বুঝাইতে গেলে উল্টা তর্ক করে, আপনার জেদ ছাড়িতে চায় না। সুতরাং গ্যালিলিওর কলেজে টেকা দায় হইল। তিনি বাড়িতে ফিরিয়া আবার অঙ্কশাস্ত্রে মন দিলেন। তারপর পঁচিশ বৎসর বয়সে অনেক চেষ্টার পর, তিনি মাসিক ষোল টাকা বেতনে সামান্য এক মাস্টারির চাকরী লইলেন।
কিন্তু এক চাকরীও তাঁহার বেশিদিন টিকিল না। কেন টিকিল না, সে এক অদ্ভুত কাহিনী। সে সময়ে লোকের ধারণা ছিল, এবং পণ্ডিতেরাও এইরূপ বিশ্বাস করিতেন যে, যে-জিনিস যত ভারি, শূন্যে ছাড়িয়া দিলে সে তত তাড়াতাড়ি মাটিতে পড়ে। গ্যালিলিও একটা উঁচু চূড়া হইতে নানারকম জিনিস ফেলিয়া দেখাইলেন যে, একথা মোটেও সত্য নয়। সব জিনিসই ঠিক সমান হিসাবে মাটিতে পড়ে। তবে, কাগজ পালক প্রভৃতি নিতান্ত হালকা জিনিস যে আস্তে আস্তে পড়ে তার কারন এই যে, হালকা জিনিসকে বাতাসের ধাক্কায় ঠেলিয়া রাখে। ঠিক কিরকমভাবে জিনিস কত সেকেন্ডে কতখানি পড়ে, তাহারও তিনি চমৎকার হিসাব বাহির করিলেন। কিন্তু এত বড় আবিষ্কারে লোকে খুশি না হইয়া বরং সকলে গ্যালিলিওর উপর চটিয়া গেল। পণ্ডিতেরা পর্যন্ত গ্যালিলিওর হিসাব প্রমাণ কিছু না দেখিয়াই সব আজগুবি বলিয়া উড়াইয়া দিলেন। এবং তাহার ফলে ঘোর তর্ক উঠিয়া গ্যালিলিওর চাকরীটি গেল।
যাহা হউক অনেক চেষ্টায় গ্যালিলিও আবার একটি চাকরী জোগাড় করিলেন এবং কয়েক বৎসর একরূপ শান্তিতে কাটাইলেন। কিন্তু বিনা গোলমালে চুপচাপ করিয়া থাকা তাঁহার স্বভাব ছিল না। ১৬০৪ খৃষ্টাব্দে ৪০ বৎসর বয়েসে তিনি কোপার্নিকাসের মত সমর্থন করিয়া তুমুল তর্ক তুলিলেন। কোপার্নিকাসের পূর্বে লোকে বলিত, "পৃথিবী শূন্যে স্থির আছে—সূর্য গ্রহ চন্দ্র তারা সব মিলিয়া তাহার চারিদিকে ঘুরেতেছে।" কোপার্নিকাস যখন বলিলেন যে, 'পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে' তখন লোকে তাঁহার কথা গ্রাহ্য করে নাই। সুতরাং গ্যালিলিও যখন আবার সেই মত প্রচার করিতে আরম্ভ করিলেন, তখন আবার একটা হৈ চৈ পড়িয়া গেল। সে সময়কার পণ্ডিতেরা প্রায় সকলেই গ্যালিলিওর বিরুদ্ধে—কিন্তু গ্যালিলিও একাই তেজের সহিত তর্ক চালাইয়া সকলকে নিরস্ত করিতে লাগিলেন।
এই সময়ে গ্যালিলিও দূরবীক্ষণের আবিষ্কার করেন। হল্যান্ড দেশের এক চশমাওয়ালা কেমন করিয়া দুইখানা কাচ লইয়া আন্দাজে পরীক্ষা করিতে গিয়া দৈবাৎ একটা দূরবীক্ষণ বানাইয়া ফেলে। এই সংবাদ ক্রমে ইটালি পর্যন্ত ছড়াইয়া পড়িল; গ্যালিলিও শুনিলেন যে, একরকম যন্ত্র বাহির হইয়াছে, তাহাতে দূরের জিনিস খুব নিকটে দেখা যায়। শুনিয়াই তিনি ভাবিতে বসিলেন এবং রাতারাতি জিনিসটার সংকেত বাহির করিয়া নিজেই একটা দূরবীণ বানাইয়া ফেলিলেন। হল্যান্ডের চশমাওয়ালাটি দূরবীণ দিয়া দূরের ঘরবাড়ি দেখিয়াই সন্তুষ্ট ছিল, গ্যালিলিও তাহাকে আকাশের দিকে ফিরাইলেন।
দূরবীনে আকাশ দেখিয়া তাঁহার মনে কি যে আনন্দ হইল, সে আর বলা যায় না। তিনি যেদিকে দূরবীণ ফিরান, যাহা কিছু দেখিতে যান সবই আশ্চর্য দেখেন। চাঁদের উপর দূরবীণ কষিয়া দেখা গেল, তার সর্বাঙ্গে ফোস্কা! কোন জন্মের সব আগ্নেয় পাহাড় তার সারাটি গায়ে যেন চাক বাঁধিয়া আছে। বৃহস্পতিকে দেখা গেল একটা চ্যাপ্টা গোলার মতো—তার আবার চার চারটি চাঁদ। সূর্যের গায়ে কালো কালো দাগ! ছায়াপথের ঝাপ্সা আলোয় যেন হাজার হাজার তারার গুঁড়া ছড়াইয়া আছে। শুক্রগ্রহ যে ঠিক আমাদের চাঁদের মতো বাড়ে কমে, দূরবীণে তাহাও ধরা পড়িল। এমনি করিয়া গ্যালিলিও কত যে আশ্চর্য ব্যাপার দেখিতে লাগিলেন তাহার আর শেষ নাই। অবশ্য এসব কথাও লোকে বিশ্বাস করিতে চাহিল না—কোন কোন পণ্ডিত গ্যালিলিওর সঙ্গে তর্ক করিতে আসিয়া, তাঁহার দূরবীণ দেখিয়া তবে সব বিশ্বাস করিলেন। কেহ কেহ সব দেখিয়াও বলিলেন, "ওসব কেবল দেখার ভুল—চোখে ধাঁধা লাগিয়া ঐরূপ দেখায়—আসলে আকাশে ওরকম কিছু নাই।" একজন পণ্ডিত দূরবীণ দিয়া বৃহস্পতির চাঁদ দেখিতে সাফ অস্বীকার করিলেন।
ক্রমে কথাটা গুরুতর হইয়া উঠিল। লোকে বলিতে লাগিল গ্যালিলিও এইরকম ভাবে যা-তা প্রচার করিতে থাকিলে লোকের ধর্মবিশ্বাস আর টিকিবে না। পৃথিবী স্থির হইয়া আছে, এ কথাই যদি লোকে বিশ্বাস না করে তবে কিসে তাহারা বিশ্বাস করিবে? স্বয়ং ধর্মগুরু পোপ আদেশ দিলেন, "তুমি এই সকল জিনিস লীয়া বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করিও না। তোমার যা বিশ্বাস, তা তোমারই থাক। তাহা লইয়া যদি লোকের মনে নানারকম সন্দেহ জন্মাইতে যাও, তবে ভাল হইবে না।" গ্যালিলিও বুঝিলেন যে 'ভাল হইবে না' কথাটার অর্থ বড় সহজ নয়। নিজের প্রাণটি বাঁচাইতে হইলে আর গোলমাল না করাই ভাল। কয়েক বৎসর গ্যালিলিও চুপ করিয়া রহিলেন—অর্থাৎ ঐ বিষয়ে চুপ করিয়া রহিলেন। কিন্তু তাঁহার মনের রাগ ও ক্ষোভ গেল না। কিছুদিন জোয়ার ভাঁটা ধূমকেতু ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা করিয়া, তিনি আবার সেই পৃথিবী ঘোরার কথা লইয়া নাড়াচাড়া আরম্ভ করিলেন। কিন্তু এবারে 'পৃথিবী ঘোরে' একথা স্পষ্টভাবে না বলিয়া, তিনি তাঁহার বিরুদ্ধদলকে নানারকমে ঠাট্টা বিদ্রূপ করিয়া সকলকে ক্ষেপাইয়া তুলিলেন। তখন পাদ্রির দল তাঁহার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনিল যে, গ্যালিলিও ধর্মগুরু পোপকে অপমান করিয়াছেন। অভিযোগটা সম্পূর্ণ মিথ্যা, কিন্তু পাদ্রিদের ধর্ম্বিচার সভায় গ্যালিলিওর উপর তাঁহার সমস্ত কথা ফিরাইয়া লাইবার হুকুম হইল—না হইলে প্রাণদণ্ড। গ্যালিলিওর বয়স তখন প্রায় ৭০ বৎসর। অনেক অত্যাচারের পর তিনি তাঁহার কথা ফিরাইয়া লইলেন। সভায় সকলের সম্মুখে বলিলেন, "আমি যাহা শিক্ষা দিয়াছি, তাহা ভুল বলিয়া স্বীকার করিলাম।" কিন্তু মুখে একথা বলিলেও তাঁহার মন তাহা মানিল না—তিনি পাশের একটি বন্ধুকে দৃঢ়তার সহিত বলিলেন, "আস্বীকার করিলে হইবে কি? এই পৃথিবী এখনও চলিতেছে।"
এইরূপে নিজের জীবনের উপার্জিত সমস্ত সত্যকে অস্বীকার করিয়া, তিনি মনের ক্ষোভে ভগ্নদেহে বাড়ি ফিরিয়া গেলেন। তারপর যে কয়েক বৎসর বাঁচিয়া ছিলেন, তাঁহাকে আর বাহিরে কোথাও বড় দেখা যাইত না। নিজে সারাজীবন সাধনা করিয়া যাহা সত্য বুঝিয়াছেন, তাহা প্রাণ খুলিয়া প্রচার করিতে পারিলেন না, এই দুঃখ লইয়াই তাঁহার জীবন শেষ হইল। যদি গ্যালিলিও জানিতেন আজ জগতের লোকে তাঁহার শিক্ষা এমন সম্মান ও শ্রদ্ধার সহিত গ্রহণ করিবে, তবে বোধহয় বৃদ্ধের শেষ জীবন এত কষ্টের হইত না।