সুকুমার রায়
পাত্রগণ
ভাবুক দাদা | দ্বিতীয় ভাবুক |
প্রথম ভাবুক | ভাবুক দল |
[ ভাবুকদাদা নিদ্রাবিষ্ট - ছোকরা ভাবুকদলের প্রবেশ ]
প্রথম ভাবুক । | ইকি ভাই লম্বকেশ, দেখছ নাকি ব্যাপারটা? ভাবুকদাদা মূর্ছাগত, মাথায় গুজে র্যাপারটা! |
দ্বিতীয় ভাবুক । | তাই তো বটে! আমি বলি এত কি হয় সহ্য? সকাল বিকাল এমন ধারা ভাবের আতিশয্য! |
প্রথম ভাবুক । | অবাক কল্লে! ঠিক যেমন শাস্ত্রে আছে উক্ত— ভাবের ঝোঁকে একেবারে বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত। সাংঘাতিক এ ভাবের খেলা বুঝতে নারে মূর্খ— ভাবরাজ্যের তত্ত্ব রে ভাই সূক্ষ্মাদপি সূক্ষ্ম! |
দ্বিতীয় ভাবুক । | ভাবটা যখন গাঢ় হয়- বলে গেছেন ভক্ত, হৃদয়টাকে এঁটে ধরে আঠার মতো শক্ত। |
প্রথম ভাবুক । | (যখন) ভাবের বেগে জোয়ার লেগে বন্যা আসে তেড়ে, আত্মারূপী সূক্ষ্ম শরীর পালায় দেহ ছেড়ে— (কিন্তু হেথায় যেমন গতিক দেখছি শঙ্কা হচ্ছে খুবই আত্মা পুরুষ গেছেন হয়তো ভাবের স্রোতে ডুবি। যেমন ধারা পড়ছে দেখ গুরু-গুরু নিঃশ্বাস, বেশিক্ষণ বাঁচবে এমন কোরো নাকো বিশ্বাস। কোনখানে হায় ছিঁড়ে গেছে সূক্ষ্ম কোনো স্নায়ু ক্ষণজন্মা পুরুষ কিনা, তাইতে অল্প আয়ু। |
[ বিলাপ সঙ্গীত ] ভবনদী পার হবি কে চড়ে ভাবের নায়? ভাবের ভাবনা ভাবতে-ভাবতে ভবের পারে যায় রে ভাবুক ভবের পারে যায়। ভবের হাটে ভাবের খেলা, ভাবুক কেন ভোল? ভাবের জমি চাষ দিয়ে ভাই ভবের পটোল তোল রে ভাই ভবের পটোল তোল। শান বাঁধানো মনের ভিটেয় ভাবের ঘুঘু চরে— ভাবের মাথায় টোক্কা দিলে বাক্য-মানিক ঝরে রে মন বাক্য-মাণিক ঝরে। ভাবের ভারে হদ্দ কাবু ভাবুক বলে তায় ভাব-তাকিয়ায় হেলান দিয়ে ভাবের খাবি খায় রে ভাবুক ভাবের খাবি খায়। [ কীর্তন 'জমাট' হওয়ায় ভাবুকদাদার নিদ্রাচ্যুতি ] | |
ভাবুক দাদা। | জুতিয়ে সব সিধে করব, বলে রাখছি পষ্ট— চ্যাঁচামেচি করে ব্যাটা ঘুমটি কল্লি নষ্ট? |
প্রথম ভাবুক। | ঘুম কি হে? সিকি কথা? আবাক কল্লে খুব! ঘুমোওনি তো— ভাবের স্রোতে মেরেছিলে ডুব। ঘুমোয় যত ইতর লোকে— তেলী মুদী চাষা— তুমি আমি ভাবুক মানুষ ভাবের রাজ্যে বাসা। |
ভাবুক দাদা। | সে ঘুম নয়, সে ঘুম নয়, ভাবের ঝোঁকে টং ভাবের কাজল চোখে দিয়ে দেখছি ভাবের রঙ; মহিষ যেমন পড়ে রে ভাই শুকনো নদীর পাঁকে, ভাবের পাঁকে নাকটি দিয়ে ভাবুক পড়ে থাকে। |
প্রথম ভাবুক। | তাই তো বটে, মনের নাকে ভাবের তৈল গুঁজি ভাবের ঘোরে ভোঁ হয়ে যাই চক্ষু দুটি বুজি! |
দ্বিতীয় ভাবুক। | হাঃ হাঃ হা— দাদা তোমার বচনগুলো খাসা, ভাবের চাপে জমাট, আবার হাস্য রসে ঠাসা। |
ভাবুক দাদা। | ভাবের ঝোঁকে দেখতেছিলেম স্বপ্ন চমৎকার কোমর বেঁধে ভাবুক জগৎ ভবের পগার পার। আকাশ জুড়ে তুফান চলে, বাতাস বহে দমকায়, গাছের পাতা শিহরি কাঁপে, বিজলী ঘন চমকায় মাভৈ রবে ডাকছি সবে খুঁজছি ভাবের রাস্তা (এই) ভণ্ডগুলোর গণ্ডগোলে স্বপ্ন হল ভ্যাস্তা। |
প্রথম ভাবুক। | যা হবার তা হয়ে গেছে— বলে গেছেন আর্য— গতস্য শোচনা নাস্তি বুদ্ধিমানের কার্য। |
দ্বিতীয় ভাবুক। | কি আশ্চর্য, ভাবতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে মশায় এমনি করে মহাত্মারা পড়েন ভাবের দশায়! |
ভাবুক দাদা। | অন্তরে যার মজুত আছে ভাবের খোরাকি— (তার) ভাবের নাচন মরণ বাঁচন বুঝবি তোরা কি? |
দ্বিতীয় ভাবুক। | পরাবিদ্যা ভাবের নিদ্রা— আর কি প্রমাণ বাকি পায়ের ধুলো দাও তো দাদা মাথায় একটু মাখি! |
ভাবুক দাদা। | সবুর কর স্থিরোভব, রাখ এখন টিপ্পনী, ভাবের একটা ধাক্কা আসছে, সরে দাঁড়াও এক্ষুনি। [ ভাবের ধাক্কা ] |
প্রথম ভাবুক। | বিনিদ্র চক্ষু, মুখে নাহি অন্ন আক্কেল বুঝি জড়তাপন্ন! স্নানবিহীন যে চেহারা রুক্ষ— এত কি চিন্তা— এত কি দুঃখ? |
দ্বিতীয় ভাবুক। | সঘন বহিছে নিশ্বাস তপ্ত— মগজে ছুটিছে উদ্দাম রক্ত। দিন নাই রাত নাই— লিখে লিখে হাত ক্ষয়— একেবারে পড়ে গেলে ভাবের পাতকোয়! |
ভাবুক দাদা। | শৃঙ্খল টুটিয়া উন্মাদ চিত্ত আঁকুপাঁকু ছন্দে করিছে নৃত্য— নাচে ল্যাগব্যাগ তাণ্ডব তালে ঝলক জ্যোতি জ্বলিছে ভালে। জাগ্রত ভাবের শব্দ পিপাসা শূন্যে শূন্যে খুঁজিছে ভাষা। সংহত ভাবের ঝংকার মাঝে বিদ্রোহ ডম্বরু অনাহত বাজে। |
দ্বিতীয় ভাবুক। | (হ্যাঁ-হ্যাঁ) ঐ শোনো দুড়দাড় মার-মার শব্দ দেবাসুর পশুনর ত্রিভুবন স্তব্ধ। |
প্রথম ভাবুক। | বাজে শিঙা ডম্বরু শাঁখ জগঝম্প, ঘন মেঘ গর্জন, ঘোর ভূমিকম্প—। |
ভাবুক দাদা। | কিসের তরে দিশেহারা ভাবের ঢেঁকি পাগল পারা আপনি নাচে নাচে রে! ছন্দে ওঠে ছন্দে নামে নিত্যধ্বনি চিত্তধামে গভীর সুরে বাজে রে। নাচে ঢেঁকি তালে তালে যুগে-যুগে কালে-কালে বিশ্ব নাচে সাথে রে! রক্ত-আঁখি নাচে ঢেঁকি, চিত্ত নাচে দেখাদেখি নৃত্য মাতে মাতে রে! |
প্রথম ভাবুক। | চিন্তা পরাহতা বুদ্ধি বিশুষ্কা মগজে পড়েছে ভীষণ ফোসকা! সরিষার ফুল যেন দেখি দুই চক্ষে! ডুবজলে হাবুডুবু কর দাদা রক্ষে! |
দ্বিতীয় ভাবুক। | সূক্ষ্ম নিগূঢ় নব ঢেঁকিতত্ত্ব, ভাবিয়া-ভাবিয়া নাহি পাই অর্থ! |
ভাবুক দাদা। | অর্থ! অর্থ তো অনর্থের গোড়া! ভাবুকের ভাত-মারা সুখ-মোক্ষ-চোরা; যত সব তালকানা অঘামারা আনাড়ে 'অর্থ-অর্থ' করি খুঁজে মরে ভাগাড়ে! (আরে) অর্থের শেষ কোথা কোথা তার জন্ম অভিধান ঘাঁটা, সে কি ভাবুকের কম্ম? অভিধান, ব্যাকরণ, আর ঐ পঞ্জিকা— ষোল আনা বুজরুকী আগাগোড়া গঞ্জিকা। মাখন-তোলা দুগ্ধ, আর লবণহীন খাদ্য, (আর) ভাবশূন্য গবেষণা— একি ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ? [ ভাবের নামতা ] ভাবের পিঠে রস তার উপরে শূন্যি— ভাবের নামতা পড় মাণিক বাড়বে কত পুন্যি— (ওরে মানিক মানিক রে নামতা পড় খানিক রে) ভাব এক্কে ভাব, ভাব দুগুণে ধোঁয়া, তিন ভাবে ডিসপেপ্শিয়া— ঢেকুর উঠবে চোঁয়া (ওরে মানিক মানিক রে চুপটি কর খানিক রে) চার ভাবে চতুর্ভুজ ভাবের গাছে চড়— পাঁচ ভাবে পঞ্চত্ব পাও গাছের থেকে পড়। (ওরে মানিক মানিক রে এবার গাছে চড় খানিক রে) ।। যবনিকা ।। |