ঢাকার নিউ মার্কেটের নাম তো কখনো পুরাতন মার্কেট
হওয়ার নয়, সিলেটের নতুন ব্রিজ বিশ বছর হওয়ার পরও তো তা পুরাতন
নামে ঢাকার নামগন্ধও নাই!
সাহিত্যে কিন্তু এর উল্টো
চিত্র। প্রকৃতি
যেমন শূন্যস্থানে বিশ্বাস করে না তেমনি সাহিত্যও মেধাশূন্যতায়, অবক্ষয়ে স্থায়ী কালযাপনে বিশ্বাস করে না।
পুলক পাল ‘উত্তরাধুনিকতা
এ সবুজ করুণ ডাঙায়’ শীর্ষক গ্রন্থের ভূমিকা অংশে বলেন, “আধুনিকতার সর্বপ্লাবি আগ্রাসনের দাপট যখন অনেকটা ক্ষয় হতে শুরু করেছে এবং বিশেষ
করে কবিতার প্রাণ যখন সংকীর্ণ বৃত্তে আটকা পড়ে হাঁসফাঁস করছে অবক্ষয় যখন তার একমাত্র
গন্তব্য তখন সচেতনতা হিসেবে বাংলা কবিতার প্রাণভোমরাটিকে অবমুক্ত করণের লক্ষে নানা
মাত্রিক চিন্তাভাবনা শুরু হয়। সেখানে ক্রমশ প্রধান প্রতিভাত হয়ে উঠেছে উত্তরাধুনিকতা। আজ এটিই একমাত্র ডোমিনেট প্যারাডাইম”।
ইউরোপকেন্দ্রিক জ্ঞানতত্ত্বের বিপরীতে নিজেদের
একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক প্যারাডাইম নির্মাণে রচিত হতে থাকে নানা গদ্য। এদিকে
বিশ্বজুড়ে আধুনিকতাও তার বিপরীতে গড়ে ওঠেছে নতুন ডিসকোর্স। সেই ডিসকোর্সের নাম
আধুনিকোত্তরবাদ বা পোস্টমর্ডানিজম। চর্চা চলছে নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি,
লোককথা ও পুরাণকে সমসাময়িকতায় জারিত করে নিজস্ব ভাষ্য নির্মাণের।
উত্তরাধুনিকতা নিয়ে যতজন সাহিত্যবোদ্ধাই
পর্যালোচনা করেছেন কেউই উত্তরাধুনিকতার একেবারে স্পষ্ট রূপ দেখাতে পারেন নি। যেমন
ধরুন, কোন দাড়িওয়ালা ব্যক্তি যদি পায়জামা
পাঞ্জাবি পড়ে আর সেই সাথে মাথায় টুপি পরিধান করে তবে তাকে অনায়াসেই মুসলিম বলে
পরিগণিত হয়। আবার কোন ভদ্রলোককে যদি ধুতি পায়জামা পরিধান করার পর গলায় পৈতা পরতে
দেখি তাহলে আমরা কিন্তু অনায়াসেই তাকে চিনতে পারি যে, সে হিন্দুধর্মাবলম্বী।
অর্থাৎ বাহ্যিক কিছু উপসর্গ দেখে ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচয় বের করার মত উত্তরাধুনিক
কবিতাও কিছু বৈশিষ্ট্য বা উপসর্গের মাধ্যমে বের করতে হয়। যদিও অবস্থান ভেদে তা
পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংকোচনের বিষিয়টিও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমার
ক্ষুদ্রবোধের পর্যালোচনায় উত্তরাধুনিক কবিতা চিনার কিছু বৈশিষ্ট্য নিম্নে তুলে ধরা
হল:
·
কবিতায়
গতিময়তা থাকবে
·
কবিতা
স্বরের বদলে বিশ্বাস করে
·
সুরের
বদলেও বিশ্বাস করে
·
শব্দপ্রকরণের
বৈচিত্র্য থাকবে
·
কাব্যদর্শন
থাকতে পারে
·
কৃষিকাজ
সম্পর্কিত হতে পারে
·
নদী
জীবন সম্পর্কিত হতে পারে
·
ধর্মীয়
সংস্কার সম্পর্কীয় হতে পারে
·
লোক
ঐতিহ্য সম্পর্কে হতে পারে
·
পুঁথিপুরাণ
হতে পারে
·
প্রকৃতির
অবাধ উপস্থিতি
·
তৎসম
ও তৎভব শব্দের ব্যবহারে দ্বিধাগ্রস্থ নয়
·
কবিতার
কোন সীমাব্ধতা থাকবে না
·
কবিতার
প্রকরণের চূড়ান্ততা বলে কিছু নেই
·
কবিতা
তার নিজের অস্তিত্বের দিকে ফিরে তাকায়
·
কবিতায়
মিথের ব্যবহার থাকতে পারে
·
নিজেদের
ঐতিহ্য থাকবে
·
প্রাকৃতিক
সৌরভ থাকবে
·
নিজেদের
কৃষ্টি লালন, প্রচার ও প্রসার
·
শুধু
শহর কেন্দ্রিক নয় আবার শুধু গ্রাম কেন্দ্রিকও নয়
·
মূলত
এর পরিসীমা হবে সামগ্রিক
·
বিশ্বায়নের
রূপের প্রকাশ থাকতে পারে
·
বিজ্ঞান
সম্মত হতেও কোন আপত্তি নেই
·
বৃদ্ধিবৃত্তিক
হতেও কোন আপত্তি নেই
·
পাশ্চাত্যের
অনুসরণ ও অনুকরণ নয়
·
আচারধর্ম
ও লোকাচারকে প্রাধান্য
·
ধর্মের
সরাসরি বলি নয় বরং ভিন্ন কৌশলে তার বহিঃপ্রকাশ
·
মৌলবাদ
ও সাম্প্রদায়িকতার গন্ধহীন
·
বোধের
জগৎকে যা টঙ্কার দেবে, বিগড়ে দেবে না
·
প্রকৃতি
থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়া
·
জাতীয়তাবাদের
চেতনা
·
জাতিপ্রীতি
·
দেশপ্রেম
·
অনুপম
ভঙ্গিতে শব্দ ও উচ্চারণ প্রকাশ
·
বিশ্বাস
ও সংস্কার থাকতে পারে
·
পাঠক
হৃদয়ের কাছাকাছি আসা
·
প্রাঞ্জল
করে তোলা
·
একক
অঞ্চলের প্রাধান্য নয়
·
বৈচিত্রতায়
বিশ্বাসি,
·
প্রসারিত প্রজ্ঞার প্রকাশ
·
দার্শনিক
দ্বন্দ্বের উপস্থাপনা
·
চরিত্রের
অন্তর্বয়ন
·
পক্ষপাতহীনতা
·
উপমা
কাব্যের শরীর হয়ে আসবে
·
সংস্কৃতির
সংস্কার
·
সংস্কৃতির
স্বপ্নের সংস্কার
·
এটা
গণতন্ত্রের মত মোটেও একনায়কতন্ত্র নয়
·
বৃহৎ
বিষয় বস্তুর সাথে ক্ষুদ্র বস্তু আসে
·
এই
জাতীয় কবিতা কোন প্রকার সিন্ডিকেটে বিশ্বাস করে না
·
বিশ্বভ্রমাণ্ডের
সঠিক ধারণার বিকাশ থাকতে পারে
·
শব্দের
ঠাসাঠাসি থেকে মুক্ত থাকবে
·
দুর্বোধ্যতা
থেকে মুক্ত
·
ভাষার
সরলীকরণ
·
জীবনঘনিষ্ঠ
ও জীবনমুখী বিষয় উপস্থাপন
·
ব্যাকরণ
মানতে বাধ্য নয়
·
অর্থবহ
শব্দ শিল্পের নিখুঁত ব্যবহার
সমালোচনারও সমালোচনা থাকতে পারে অসম্ভব কিছু
নয়। রাজনীতে যেমন শেষ কথা বলে কিছু নেই তেমনি সাহিত্যেও চূড়ান্ত বলে কিছু নেই।
সাহিত্য বিচারের একক কোন মানদণ্ড নেই। সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করেই
সাহিত্যকে পর্যালোচনা করাতে হয়। আজকের যুগের সাহিত্যও যেমন আগামিতে প্রশ্নের
সম্মুখীন হতে পারে তেমনি সমালোচনাও সমালোচিত হতে পারে এও অসম্ভব নয়। আর সমালোচনার
ক্ষেত্রে সাহিত্যবোদ্ধাদের পৃথক পৃথক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে শিল্পবিচারও বৈবিত্রপূর্ণ
হয়ে থাকে।
স্বর্ণ পুড়েই যেমন মৌলিকত্ব লাভ করে তেমনি
সমালোচনার ভেতর দিয়েই প্রকৃত সাহিত্যের রূপ ফুটে ওঠে। তবে গঠনমূলক সমালোচনার মধ্য
দিয়ে কবির সৃষ্টিশীলতার পথকে সুগম করে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে যা অহরহ হয়
বা হয়ে থাকে তা হল সমালোচনার নামে বিরোধিতা করা হয়। যার কারণে অনেক ভাল প্রতিভা
সম্পন্ন সাহিত্যিকও অকালে ঝরে পড়ে কিংবা পরবর্তীতে আর সাহিত্য রচনার প্রতি আগ্রহ
হারিয়ে ফেলে। সুতরাং আমরা যারা সমালোচনা করি আমাদেরও কিন্তু সমাজের প্রতি,
রাষ্ট্রের প্রতি, সর্বোপরি ভবিষ্যৎ সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক এবং সচেতন পাঠকদের প্রতিও
একধরনের দায়বোধ থাকে। যদিও এই চরম সত্যটি অনেক সাহিত্য সমালোচকই অস্বীকার করেন।
উত্তরাধুনিক কবিদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
কবি জফির সেতু। ‘বহুবর্ণ রক্তবীজ’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে কবির কাব্য জগতে পদার্পণ।
একসময় আসিফ আকবর যেমন তার প্রথম অডিও অ্যালবাম ‘ও প্রিয়া ও প্রিয়া তুমি কোথায়’
দিয়ে অডিও শিল্পে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন, তেমনি জফির সেতুর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বহুবর্ণ
রক্তবীজ’ দ্বারাও কাব্যভুবনে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেন। যদিও অডিও শিল্পের মত কাব্য
শিল্প নয়। অডিও শিল্পের প্রচার প্রসার হয় চিতাবাঘের গতিতে আর সাহিত্যের প্রচার
প্রসার হয় কচ্চপের গতিতে। এতদ্বসত্ত্বেও তাঁর এই প্রথম বইটি দিয়েই তিনি সুধী মহলের
দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেন। তার প্রথম কাব্যের মধ্যেই তিনি তার প্রতিভার সাক্ষর রাখতে
সক্ষম হন। যদিও তার বইটিতে আঙ্গিক ও প্রকরণগত দিক দিয়ে কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে
তথাপিও তা উত্তরাধুনিক যুগের কালিক বার্তার নিশানা স্বরূপ। বইটি ২০০৪ সালে
ফেব্রুয়ারিতে শুদ্ধস্বর প্রকাশনী কৃতক প্রকাশিত হয়েছিল। কাব্যগ্রন্থটিতে মোট ৩৩টি
কবিতা রয়েছে। তার কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে ৩টি ভাগে ভাগ করা
যায়। যথা-
১. পুরাণ ও তত্ত্বজ্ঞানমূলক
২.প্রেমমূলক ও গীতিমূলক-
৩. আমিত্ব বিষয়ক বা আত্মকেন্দ্রিক
৪.বিবিধ
তবে অপ্রিয় হলেও সত্য যে, তার সবগুলো কবিতায়ই
আধুনিকতার নিগঢ় থেকে সম্পূর্ণ বের হতে পারে নি। তবে বের হওয়ার স্বতস্ফূর্ত প্রয়াস
তাঁর কাব্যের মধ্যে লক্ষ্যণীয়। মূলত আধুনিকবাদীদের সীমাবদ্ধতাই উত্তরাধুনিক কবিদের
নতুন করে চিন্তাভাবনা করার দিকে ধাবিত করেছে।
অবক্ষয়ী আধুনিকতার স্বরূপ হচ্ছে মূলত রম্যবাদী
এবং সেই সঙ্গে ইংরেজ/ফরসি ইউরো আমেরিকার হাংরি, বিট, অ্যাংরি কবিদের অনুকরণ।
পরাবাস্তববাদ এদের কল্পনায় ও ভাব প্রেরণায় যৌনতার দিকে মোড় নেয়। কবির নৈতিক
সামাজিক দায়িত্ব তারা স্বীকার করে না। কবিতায় পাওয়া যায় কাতরতা আর আর্তনাদ।
অবক্ষয়ী কবিদের পছন্দ ব্যাকরণসম্মত পদ্যছন্দ। আর প্রেক্ষাপটের উপর দাঁড়িয়ে
উত্তরাধুনিকতাকে বলতে হয় অরম্যবাদী কথনের স্পন্দনের পক্ষপাতী। এরা নৈতিক রাজনীতিক দায়িত্ব স্বীকার করেন এবং
কল্পনা ও বাস্তবের দ্বন্দ্বকে কবিতায় চিত্রায়িত করায় সচেষ্ট। উত্তরাধুনিকেরা
প্রাধান্য দিচ্ছেন সামগ্রিক অনুভূতিকে অবক্ষয়ীদের মত শাররীক অনুভূতিকে নয়।
আধুনিক বাঙলা কবিতার যে সাংস্কৃতিক প্রতিরূপ
তা একান্তভাবেই কসমোপলিটান নাগরিক সংস্কৃতি। কিন্তু আমরা যে কবিতার কথা বলছি তা আর
সীমাবদ্ধ নয় নগরের ইটের পাঁচিলে। কবির আত্মকথন কিংবা স্বগত ভাষণ যতটা না কবিতা তার
চেয়ে তার প্রলাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে
বেশি। ব্যাকরণের সেই মেপে দেয়া ছক- স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত- কিংবা বিরাম চিহ্নের
বহুল ব্যবহার উত্তরাধুনিক কবিতাতে খুবই সীমিত। জফির সেতুর নিম্নোক্ত কবিতায়
সেরকমই চিত্রই যেন দেখতে পাই-
শীতের পাতা আর নদীর জল
যেভাবে নাও, তেমনি তোমাকে তুলে নাও
তোমার হাতের ভেতরে
তোমার মেদ মজ্জা যদি
ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাও তুলে নাও নিবিড় মমতায়
একবারই তুমি নিজেকে পাবে
এমন মধুর মাটিতে
নিজেকে থেঁতলে দাও
দুপায়ের নিচে, তোমার রক্ত মেদ গড়িয়ে পড়ুক
ঘাসে
ঘাসে
এমন নিষ্ঠুর যজ্ঞ একবারই
তোমাকে নেবে জগতের হরিৎ শস্যক্ষেত্রে
আমাকে আমি একবার বহুবার
হাতের মুঠোতে নিয়েছি আর
থেতলেও দিয়েছি
(মর্মজ্ঞান, পৃষ্ঠা নং ৭)
ছন্দ বললেই একটা মাপজোকের সীমাবদ্ধতার কথা মনে
পড়ে যায়, সামগ্রিক কবিতা এই সীমাবদ্ধতা মানে না। উত্তরাধুনিক কবিরা নেই ওসব
বন্দীত্বে। তাদের প্রত্যাশা ছন্দ হোক আপন প্রাণের ভেতর বেজে ওঠা কথনের সুর। তাঁর
কবিতায় তেমনি যেন প্রতিরূপ দেখতে পাই-
এই দেহ থেকে কিছু মাংস কেটে নাও
টাটকা আমিষের ভেতর যে চর্বির স্রোত তা সমেত
গেথে নাও
প্রতিদিনের শানানোর দিকে
কয়লার গনগনে চুলোয় ঝলসিয়ে নাও ঝাঝালো ভেজা
মসলার সাথে
দেখবে আগুনে দগ্ধ কেমন আমি, আমার শরীর
(কাবাব, পৃষ্ঠা ১০)
উত্তরাধুনিক কবিতা পাণ্ডিত্যের প্রচার প্রসারে
বিশ্বাস করে না। তবে তারা এইটুকু বিশ্বাস করে পরম শিল্পের কাছে পৌঁছতে হবে
মানুষকে। কবি জফির সেতুর কবিতায় সে দিকটি
খুবই স্পষ্ট। উত্তরাধুনিক কবিতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভাষার সরলীকরণ।
জফির সেতুর কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে যেন সে বিষয়টিই স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। এছাড়া
জীবনানন্দের কবিতার সেই পরিচিত বাক্যগুলোও অন্তর্বয়নের মাধ্যমে স্পষ্ট থেকে
স্পষ্টতর হয়ে ফুটে ওঠেছে তাঁর কবিতায়। যেমন-
মেদ মাংস থেকে উৎসারিত যে রক্ত আমি তা দিয়ে দিয়েছি
আল্পনা করে যাত্রাপথে-আমি বুঝে গিয়েছি গোলাপও রাঙা হতে
পারে না প্রেমিকের রক্তের চেয়ে। ভেবেছি যারা জন্মান্ধ
তারা যেন
চক্ষুষ্মান হয়ে ওঠে; কেননা পৃথিবীতে এখনো অন্ধের সংখ্যাই
বেশি
পাখির গান আর দূরাগত ঝরণার শব্দ শুনে যারা আজও চমক ও
আনন্দ
পায়, তাদেরই বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
(প্রতিতুলনা, পৃষ্ঠা ১১)
আধুনিক সাহিত্যের নামে
যা এতদিন আদৃত হয়েছে এই ভূখণ্ডে তার অধিকাংশই পরের ধনে পোদ্দারির মত। কেউ যখন
আধুনিক শব্দটা ব্যবহার করেন তখন সেই ধারণার উৎস কখনোই ভারতবর্ষ বা বাঙলার নিজস্বত
বাস্তবতা হতে পারে না, সর্বদাই তো য়ুরোপীয়, সঠিক অর্থে তারও ইংরেজিসংস্করণ। একদিন
এই মন আরশের চেয়েও অটল স্থৈর্যে বুনে গেছে কাব্যজাল আজ যার ফোঁকর গলে বেরিয়ে পড়েছে
দুর্বলতার হা এবং অর্বাচীনতার হাহাকার। চূড়ান্ত রূপ ও সীমাবদ্ধতাই ছিল আধুনিকতার
মূল ভিত্তিভূমি।
প্রকৃত পক্ষে কবিতায়
চূড়ান্ত কোন রূপ ঘোষণা দেওয়া অসম্ভব এবং বিজ্ঞানবিরুদ্ধ। তাছাড়া চূড়ান্ত কোন রূপ
তৈরি করা মানেই তো কবিতাকে বন্দী করা, যা আধুনিকদের পাঠশালায় হয়েছে। কবি জফির
সেতুর কবিতা তা থেকে মুক্তিরই যেন বার্তা প্রকাশ করে। তাঁর কাব্যে আধুনিকতার মত
উপমা হিসেবে নয় শরীর কাঠামো হয়ে জেগে ওঠেছে মিথ। যা বিশুদ্ধ উত্তরাধুনিক কবিতার
বৈশিষ্ট্য বহন করে। যেমন-
আমি ধর্মপুত্র,
মন্ত্রপাঠ ভুলে ছায়াশিকারীর সাথে ঘোরাফেরা করি
স্তনের সাদা ফেনায় যারা
উন্মাদ তাদের দৃষ্টিকে লোকালয় ভেবে
..........................................
তাই আমার ভেতরেই সন্ধান
করি পদ্মযোনি পরমার্থ ঘরবাড়ি
(নির্বাসনের আগে, পৃষ্ঠা
৩০)
কবিতার অধেয়ই তার রূপ
ঠিক করে দেয়। দীর্ঘ বয়ানের পর তবে ক্ষান্ত হোক স্মৃতির পুংক্তিরা। পাঠকের মনের মত
ক্লান্ত মাঠ পৃথিবীতে কম। আমি শুধু বলতে পারি উত্তরাধুনিকতার চেতনা এই কবিতাগুলো
ধারণ করে। এবং সময়ের সাথে এর উৎকর্ষ এবং আঙ্গিকের পরিবর্তন হবে, এ কথা বলাই বাহুল্য।
কবিতা নিরন্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্রমশ এগিয়ে যাবে। রূপ নেবে নতুন আঙ্গিকের আরো
গ্রহণযোগ্য কোন চেতনার।
(চলবে)
মুনশি আলিম
জাফলং, গোয়াইনঘাট, সিলেট
জাফলং, গোয়াইনঘাট, সিলেট