সত্য ও সহোদর
আমার খাঁচায় বাঘ, বাঘের খাঁচায় আমি,
আমরা একই উদরে জন্মেছিলাম,
আমরা একে অন্যকে খেতে চাই;
আমাদের মা—প্রকৃতি— বলেছেন: এর চেয়ে আর কোনো সত্য নেই;
এক জীবন নাশ-এর মধ্যেই নিহিত থাকে আরেক জীবনের বীজ,
আমরা তাই একে অন্যকে সংহার করে চলি, বপন করে চলি বীজ;
আর মৃত সহোদরের মাথার কাছে শোকাতুর হয়ে বলি:
ক্ষমা করো ও প্রিয় বাঘ
ক্ষমা করো ও প্রিয় মানুষ
ক্ষমা করো ও প্রিয় ফুল
ক্ষমা করো ও প্রিয় ফল
ক্ষমা করো ও প্রিয় বীজ;
আমরা প্রাণধর্ম পালন করে চলেছি মাত্র।
ভালোবাসা
এমন করুণ দিনে তবু বাবুই ডেকে যায়
ঝুঁটি দুলিয়ে দুলিয়ে রোদ্রে হাঁটে লাল মোরগ
রঙিন ডালিয়া ফুলের কাছে এসে শিশু হেসে ওঠে
কোকিলের ডাকে সাড়া দিয়ে ডাকে আরেকটি কোকিল।
আমার বুকের মধ্যে ছড়াচ্ছে বিষ বন্ধুর ছোঁড়া তীর
আমার চোখ হয়ে আছে রুদ্রপলাশ
তবু এই চোখের ফুলে পাখি হয়ে এসে বসে
মায়ামুখ; আমি তাকে পারি না তাড়াতে?
পাখির ঠোঁটের ঘায়ে রক্তাক্ত যে ফুল
রোদের মায়ার ঘায়ে বিদ্ধ দুপুরের যে লাল মোরগ
তাকে দিও না ফুলের তোড়া, চকলেটের বাক্স উপহার
বসন্তবউরি
এই অবশ দুপুরে আমার যাবার জায়গা নেই
এই বিকেল করুণ চোখে আমাকে বিদ্ধ করে রোজ
আমি আর পারছি না ধরে রাখতে আমার ভার
আর পারছি না চেপে চেপে নিঃশব্দে ফেলতে দীর্ঘশ্বাস
আর পারছি না সংসারে খুঁজে পেতে এমন কোনো কাজ যা
তার মধ্যে পিষে আমাকে নিংড়ে নিয়ে ভুলিয়ে দেবে
এই অবশ দুপুর নিজের মধ্যে বয়ে চলার ভার।
তোমার ঠোঁটে করে আমাকে মৃত্যুর সমান দূরে নিয়ে যাও
আম গাছের ডালে বসে সময়-অসময়ে ডাকতে থাকা বসন্তবউরি
তোমার স্বরে লীন হয়ে মানুষের বুকের মধ্যে আমি থাকবো মায়ায়।
বঙ্গোপসাগরের প্রতি
শত শত বাঁও জলের গহীনে
পলি জমে হাজার বছর
সাগরে জেগেছে যে দুবলার চর, তার তো জননী তুমি,
কিন্তু মা, আমার আশ্রয় কই?
সুলেমানী তরবারী হতে চাই নি কখনো
তোমার অতল তল থেকে জেগে ওঠা
নিঃশব্দ 'আলোর কোল' চর হতে চেয়েছি কেবল,
চেয়েছি বারবার সুন্দরবনে বেড়ে ওঠা
একটা বেনামী গাছ হতে, ঘুঘু হতে;
কেষ্ট নামের যে মাঝি ছেলেটা
বিজন দ্বীপে নৗকা সারাতে সারাতে
ভর দুপুরে গেয়ে ওঠে:
'হরি নামে সুর বেঁধে দাও দেহ একতারায়'
তার মতো বেভুল হতে চেয়েছি।
শাঁখারী বাজারে ব্যবসায়ীদের ভীড়ের ভেতর
গোপাল নামে যে দোকানী লোকটার গায়ে
কেমন যেনো নদী নদী গন্ধ--
তার মতো একটা খুব গোপাল হতে চেয়েছি;
প্রবল বিজয়ী হতে তো চাই নি কোনো দিন;
চেয়েছি সহাবস্থান,
চোখে চোখে প্রাণের ইশারা;
তবু কেন স্লেজ টানা কুকুর হয়ে ওঠছি
ক্ষেপে উঠছি পরস্পরের বিপরীতে?
নিজেদেরই রক্তে কেনো রাঙিয়ে তুলছি বরফ?
এখন তো ফুরোবার সময় নয়,
জীবন জীবন করে কাঙালীপনার সময় নয় জীবনের পিছু পিছু;
এখন আমরা গাছ হবো
রোদ এসে জিরোবে তার পত্র-পল্লবে
সমুদ্র হবো -- রহস্য তৈরি হবে সাগর ঘিরে
সাগরের প্রাণী শঙ্খকে ঘিরে তৈরি হবে
শাঁখা ও সধবার মিথ;
কিন্তু এমন কেন হচ্ছে মা?
প্রাণ কেন পড়ে যাচ্ছে মুঠো উছলে!
যে রয়েছে ব্যথার আড়ালে
যে গেয়েছে একাকীত্বের গান
থাকুক সে গহীনে নিবিড়
থাকুক সে একা এক তারা হয়ে দূরে উজ্জ্বল।
এইখানে ঝলমলে আলোর নিচে মিহি মিহি মোহনীয় অন্ধকার
সকলে সহাস্যে করেছে বরণ; যে পারে নি হাসতে অমন,
অভিমানে যে আছে টুইটুম্বুর, উৎসব হতে যে আছে দূরে,
যে আছে ব্যথার আড়ালে— অনুজ্জ্বল একাকীত্বে ম্লান—
গভীর ক্ষতের দিকে তার— তাকানোর সময় তো নাই।
তবু মনে পড়ে গেলে আজ দিঘী ভরা শ্যাওলার দিন
মনে এসে গেলে আজ খয়েরি শালিকের গান
আমি টুপ করে ডুবে যাই পদ্মপাতার তলে
জলে ডুবে মনে মনে বলি বারবার
যে কথা চোখের সামনে বলি নাই।