ব্যারিস্টারি
পাশ করে কয়েক দিন হল দেশে ফিরেছি। দেশে ফিরতে না ফিরতেই পরিবারের সবাই উঠে পড়ে
লেগে গেল আমার বিয়ের জন্য। কিন্তু আমার কাছে থেকে তারা তেমন কোন উৎসাহ না পেয়ে অনেকটা
ঝিমিয়ে গেল। লজ্জাবতী গাছ স্পর্শ পেয়ে যেমন ঝিমায় তেমনি আর কি! আমি কোলাহলটা যেমন
উপভোগ করি তেমনি একাকিত্বটাও। একবার অপরাহ্নে বাসা থেকে বের হলাম। উদ্দেশ্য নতুন
আইনের বই ক্রয় করা। কেন যেন সেদিন নিজের গাড়িটা নিতে ইচ্ছে করল না। খুব হাঁটতে
ইচ্ছে হল। আমার ইচ্ছেটাকেই প্রাধান্য দিলাম। আমি হাঁটছি, আপন মনে হেঁটেই চলছি।
মেইন রাস্তার পাশে দাঁড়াতেই দেখলাম রাস্তার বিপরীত দিকে এক টোকাই ড্রেনের পাশে
ফেলে দেয়া পরিত্যক্ত উচ্ছ্বিষ্ট খাবার তুলে তুলে খাচ্ছে।
আমার
খুব ইচ্ছে হল তার সঙ্গে কথা বলার। আমি তাকে হাত উচিয়ে ডাকার চেষ্টা করছি কিন্তু
কেন যেন কোন প্রকার শব্দই করতে পারলাম না। কিন্তু তারপরেও কাকাতালীয়ভাবে ছেলেটি
আমার দিকে তাকাল। আমার হাত ইশারার মানেও বুঝল।
ছেলেটির
বয়স আনুমানিক আট কিংবা নয় হবে। পরনে
জোড়াতালি দেয়া হাফপ্যান্ট আর একটি ছেড়া গ্যাঞ্জি। উসখুস চুল। কি মনে করে যেন
ছেলেটি আমার কাছে আসার জন্য রওয়ানা দিল। আমি তখনও তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে
রয়েছি। এমন সময় কে যেন পিছন দিক থেকে আমাকে হ্যাচক্যা একটা টান দিল। আমি আকাশের
দিকে তাকাতে চেষ্টা করলাম।
বাসন্তীয়
আকাশ। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আকাশের কোলজুড়ে কোথাও কোথাও সাদামেঘের ভেলার
অনিন্দ্য রূপ সমস্ত আকাশকেই যেন অন্যরকম অদ্ভুত সুন্দর সাজে রাঙিয়ে তুলেছে।
ফুরফুরে বাতাসও বইছে। রাস্তার দু’ধারের সারি সারি গাছগুলোর পাতার সাথে প্রবাহিত
বাসন্তীয় বাতাসের যেন গভীর মিতালি। শতাব্দীর নিংড়ানো ভালবাসার স্নিগ্ধ আবেশে যেন
একেবারেই মাখামাখি। ভালবাসার আবেশ ছড়িয়ে নুইয়ে দিচ্ছে গাছের পাতা। প্রকৃতি দেখে
ভাললাগলেও কোন অভদ্রের হ্যাচকা পশ্চাদটানের জন্য খুব খারাপ লাগতে লাগলো। মনে মনে
খুব চটে গেলাম।
পণ
করলাম যতবড় ক্যাডারই হোক আজ এক লংকাকাণ্ড বাঁধিয়ে ছাড়ব। কিন্তু পরক্ষণেই আমার
পিঠের দিকে খুব নরম অনুভব করলাম। আমি মাথা উল্টিয়ে লোকটিকে দেখতে চেষ্টা করলাম।
কিন্তু দুবাহুতে এমন ভাবে ধরেছে যে মাথা নাড়ানো সম্ভব ছিল না। বাধ্য হয়ে সামনের
দিকেই তাকাতে হল। মুহূর্তের মধ্যেই দেখলাম আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং যেদিকে
তাকিয়ে ছিলাম তার বিপরীত দিক থেকে কর্কশ শব্দ করে একটি ট্রাক ধেয়ে গেল। আমি হাফ
ছেড়ে বাঁচলাম। আমার বুঝতে বাকী রইলো না যে, কেউ এ যাত্রায় দৈত্য ট্রাকের কবল থেকে
আমাকে বাঁচিয়েছে।
আমি
উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই দেখলাম লোকটি আমাকে ছেড়ে দিল। আমি অনেকটা অপ্রস্তুত
হয়েই লোকটির দিকে তাকাই। কৃতজ্ঞতাবোধ আমার ভেতর উথলে ওঠতে থাকে। ওমা! একি! এ যে
আঠার উনিশ বছরের টগবগে তরুণী! বেশ ভূষায় একেবারে পশ্চিমা ছাপ। কী দারুন দেখতে।
আমাকে বাঁচাতে গিয়ে আমার মাথার সাথে ওর চিবুক ও ঠোঁটের চোট লাগে। আর তাতেই ফেটে
যায় তার ঠোঁটের কোমল ত্বক। হালকা রক্ত ঝরছে।
আমার
নিজেকে তখন খুব অপরাধী লাগতে লাগলো। আমি পকেট থেকে টিস্যু বের করে এগিয়ে দিয়ে আমতা
আমতা করে বললাম- I am … I am
Sorry. A am very unconscious. you are sufarur
for my own mistack. I am extermly sorry. please take this and ...
আমি
হাত দিয়ে তার ঠোঁটের রক্ত পড়ার ইঙ্গিত দেই। সে টিস্যু নিতে যাবে এমন সময় রাস্তার
বিপরীত দিক থেকে এক তীব্র চিৎকারের শব্দ ভেসে এল। আমি সেদিকে তাকাতেই দেখি ঘাতক
ট্রাকের নিচে পিষ্ট হয়েছে সে টোকাই ছেলেটি। চোখের সামনেই ছেলেটির ক্ষতবিক্ষত দেহ।
মুহূর্তেই পৃথিবীর সমস্ত অপরাধবোধ আমার ভেতর যেন ভর করল। নিজের ভেতর নিজেরই যেন
ক্ষরণ শুরু হল। আমার জন্যই আজ ছেলেটির...। নাহ্ ! আর ভাবতে পারছি না। আমার রুক্ষ
চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে। ঝাপসা হয়ে ওঠে আমার চোখ, বিবেকের পৃথিবী।
মুনশি আলিম
জাফলং, সিলেট